সম্বুদ্ধ দত্ত
বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কত যে রত্ন ভান্ডার ছডি়য়ে আছে তাঁর খোঁজ আমরা কজনইবা রাখি৷ সে রত্ন ভান্ডার কোথাও সংগীত মাধুর্যে আবার কোথাও শিল্পের আঙ্গিকে আমাদের মুগ্ধ করে৷ এমনই বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে বাতাসে যেমন আজও বয়ে বেড়ায় নিধুবাবুর টপ্পা এবং ঠুমরীর তাল এবং লয়ের তরঙ্গ তেমনি পোরামাটির অপরূপ শিল্পকলা৷ যার পোশাকি নাম টেরাকোটা৷ টেরাকোটা নামের সঙ্গে জডি়য়ে আছে এক গ্রামের নাম৷ পাঁচমুড়া৷ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহর থেকে মাত্র ১২ থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এই পাঁচমুড়া গ্রাম৷ যাকে আক্ষরিক অর্থে টেরাকোটার আঁতুড়ঘর বলা যায়৷
দীর্ঘ দিনের বাসনা সার্থক করতে বিষ্ণুপুর থেকে বেশ কিছুটা জঙ্গলের বুক চিরে পৌঁছে গেলাম টেরাকোটা গ্রাম পাঁচমুড়ায় ৷ বেলা তখন প্রায় ১১টা৷ গ্রামবাসীদের থেকে খবর নিয়ে জানতে পারলাম এই গ্রামে কমবেশি আশি থেকে নব্বইটি পরিবারের বাস৷ যারা প্রায় সকলেই কুম্ভকার সম্প্রদায়ের মানুষ৷ এই গ্রামের শিল্পীরা তাঁদের শিল্প দ্বারা কেবলমাত্র তাঁদের গ্রাম পাঁচমুড়াকে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই বিখ্যাত করেননি, বিখ্যাত করেছে সমগ্র দেশের কাছে৷ এই গ্রামের অপরূপ শিল্পকলা রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে বহুবার পুরুস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে৷ ইদানিং পাঁচমুড়ার টেরাকোটার খ্যতি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছডি়য়ে পডে়ছে৷ এবং সেই সুত্র ধরেই পাঁচমুড়ার বেশ কিছু শিল্পী বিদেশে তাঁদের শিল্প নিয়ে পারি দিয়েছে৷
পাঁচমুড়ায় বেশ কিছু শিল্পীর কর্মশালায় ঘুরে বুঝতে অসুবিধা হল না, পুরুষদের সঙ্গে এই গ্রামের মহিলারও সমান ভাবে এই শিল্পের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত৷ কাঁদা মাটিতে পরিমাণ মতো বালি মিশিয়ে বিভিন্ন মূর্তি তৈরির উপযোগী করে তোলা থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে একেবারে শেষে অর্থাৎ তিন পর্যায়ে রঙ করা এবং পরিশেষে বিক্রি প্রর্যন্ত মহিলারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ এই গ্রামে এমন একটিও ঘর চোখে পড়ল না যেখানে টেরাকোটার কাজ হয় না৷ এখানে প্রতিটি ঘরের সামনে রয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি বেশ বড় বড় উনুন এবং মাটির মন্ড ঘোরাবার চাকা৷ যার সাহায্যে আঙ্গুলের পরশে মৃৎ শিল্পীরা তাঁদের পছন্দ মতো জিনিস অনায়াসে তৈরি করে৷ পরবর্তী পর্যায়ে রোদে শুকনো মাটির সামগ্রীগুলো উনুনে একটা নির্দিষ্ট তাপে পোড়ানো হয় ৷ তাপের তারতম্য এই শিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়৷ কুম্ভকার পরিবারের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া সদস্যরাও লেখাপড়ার অবসরে তাঁদের পারিবারিক পেশায় হাত লাগায়৷ এইভাবে পরিবারের অভিভাবকদের কাজে সাহায্য করতে করতে একদিন তাঁরাও পূর্ণ শিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করে৷
পাঁচমুড়া শিল্প গ্রামের ঘুরতে ঘুরতে শিল্পী ভূতনাথ কুম্ভকার, ব্রজনাথ কুম্ভকার, মহাদেব কুম্ভকার, নিমাই কুম্ভকার ,চন্ডী কুম্ভকার এবং বয়সে প্রবীন ধীরেন্দ্রনাথ কুম্ভকারের মতো প্রতিযশা শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় হল ৷ তাঁদের থেকে জানতে পারলাম ,পাঁচমুড়া গ্রামের নামের ইতিহাস৷ পাঁচ মাথা অর্থাৎ পাঁচ জন (স্থানীয় ভাষায় মাথা মানে মুড়া) ব্যক্তি সন্মিলিত ভাবে এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন৷ তাই এই গ্রামের নাম পাঁচমুড়া৷ এই গ্রামের টেরাকোটা শিল্পী রাসবিহারী কুম্ভকার পাঁচমুড়া গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতার গর্ব ৷ ভারতবর্ষের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ জাকির হোসেনের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের রাসবিহারী কুম্ভকারের ছবি আজও পাঁচমুড়ার প্রায় সব মৎশিল্পীর কর্মশালায় শোভা পাচ্ছে৷
লোকশিল্প গবেষকদের মতে পাঁচমুড়া টেরাকোটা শিল্পের উৎপাদন কেন্দ্র গডে় ওঠার কারণ প্রথমত এই অঞ্চলের মাটির চরিত্র৷ এখানকার লালচে মাঠের মাটি মৃৎ শিল্পের উপযোগী ৷ এবং দ্বিতীয়ত মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা৷ বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে যে সকল টেরাকোটার কাজ দেখা যায় তা এই পাঁচমুড়া গ্রামাঞ্চল ও তার আশেপাশের অঞ্চলে তৈরি করা হতো৷ এবং সময়ে সঙ্গে সঙ্গে এই পাঁচমুড়া গ্রামের মানুষের কাছে এই শিল্প জীবিকা হয়ে ওঠে৷
এখানকার শিল্পী ভূতনাথ কুম্ভকারের থেকে জানা গেল তাঁদের তৈরি দুর্গা প্রতিমা প্রায় প্রতি বছর কলকাতার বেশকিছু নামকরা পুজো উদ্যোগতারা নিয়ে যায়৷ চিরাচরিত শিল্পের পাশাপাশি ইদানিং টেরাকোটা শিল্পে একটা নতুন ধারার সূচনা হয়েছে৷ সেই ধারা হল রঙের ব্যবহার না করে ধুয়ের সাহায্যে কালো রঙের ব্যবহার৷ এবং নানা চিত্র সম্বলিত টেরাকোটার টাইলস৷ এই টাইলসে ফুটিয়ে তোলা চিত্রগুলোর মধ্যে বেশ নতুনত্বের স্বাদ রয়েছে৷ যেমন রয়েছে দেব-দেবী, কৃষি কাজ, নৃত্যরত বাউল পশু শিকার , সহজ পাঠের প্রচ্ছদ এবং পৌরাণিক কাহিনী৷ অর্থাৎ প্রতিটি টাইলস একটি বার্তা বহন করেছে ৷
এক অসাধারণ গ্রাম এই পাঁচমুড়া৷ গ্রামের মধ্যে এগোতেই চোখে পড়বে মহাউৎসব তলা৷ এখানেই গ্রামের সব রকমের ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়৷ সুতরাং মহাউৎসব তলাকে বলা যেতে পারে পাঁচমুড়া গ্রামের প্রানকেন্দ্র৷ এই মহাউৎসব তলার ভিতরের দেওয়ালে টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে অপরূপ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনী এবং ঐতিহাসিক কাহিনী৷ যাকে মনমুগ্ধকর বললে কম বলা হবে৷ মহাউৎসব তলা দেখে গ্রামের ভিতর এগিয়ে চললাম৷ চোঁখে পড়ল কোথাও জলন্ত উনুনে মাটির তৈরী সামগ্রী পুরছে৷ কোথাও আগুনহীন উনুন থেকে শুধুই ধোঁয়া উঠছে৷ আবার কোথাও বড় উনুনের মধ্যে মাটির সামগ্রী সাজিয়ে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে৷ চলছে পোড়ামাটির দেব – দেবীর মূর্তি থেকে হাতি, ঘোড়ার মতো প্রানী এবং গৃহসজ্জার সামগ্রী রঙ করে ফিনিশিং এর কাজ৷ কি তৈরি হয় না এখানে,- একদম ছোট থেকে বেশ বড় আকারের ঘোড়া,হাতি, পেঁচা, বাঘ, সিংহ৷ দেব দেবীর মধ্যে দুর্গা, কালি, শিব, লক্ষী, সরস্বতী,গনেশ ও মনসা৷ তবে বিভিন্ন ভঙ্গিমার গনেশের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি৷ পাঁচমুড়ার শিল্পীদের তৈরি আর একটি অসাধারণ সৃষ্টি মা মনসা৷ এখানকার মনসার বৈশিষ্ট্য হল সাপ পরিবৃত৷ এমনকি দেবী মনসার চালচিত্রটিও ছোট ছোট সাপ দিয়ে সাজানো৷ এমন নাগদেবী বা মনসা কিন্ত্ত কেবল রাঢ় বাংলাতেই পূজা করা হয়৷
কথায় আছে সময়ের দাবি অখন্ডনীয়৷ তাই বর্তমান সময়ের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এখানকার শিল্পীরা দেওয়ালে ঝোলানো নতুন এক ধরনের টেরাকোটার কাজ করছে ৷ কাঠের ফ্রেমের মধ্য পাটের কাপডে়র মধ্যে ফুটিয়ে তুলছে পোড়ামাটির বাউল থেকে রবীন্দ্রনাথ , রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের মতো মনিষী ও দেবতাদের মূর্তি৷ দেওয়ালে ঝুলন্ত এই মূর্তি গুলোকে দেখলে মনে হয় ক্যানভাসে আঁকা ছবি৷ এছাড়াও পাঁচমুড়ার শিল্পীদের তৈরি পোড়ামাটির ঘন্টা এবং শঙ্খ এক আশ্চর্য সৃষ্টি৷ যা পুজোর কাজে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়৷ পাঁচমুড়ার শিল্পীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো তাঁদের কুম্ভকার জীবনের সুখ- দুঃখ, আনন্দ ও বেদনার কথা৷ বাংলার ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের তৈরি শিল্প প্রর্দশন, বিক্রি, বাজারজাত করনের পদ্ধতি এবং নানা অভিজ্ঞতার কথা৷ বর্তমান প্রজন্মের এই কাজের প্রতি অনাগ্রহের কথা৷ কেউ আজ আর কাঁদামাটি ঘাটতে চায় না৷ এখন সকালেই একটাই লক্ষ্য, চাকরি ৷ তবুও আশার কথা এখনও বেশকিছু কলেজ পড়ুয়া ছাত্র- ছাত্রী এই শিল্প নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে পেশা করতে চাইছে৷
পাঁচমুড়া গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মতো৷ উৎসাহী মানুষদের তাঁরা তাঁদের কর্মশালা শুধু পরিদর্শন করান না, যত্ন সহকারে দেখান এবং বুঝিয়ে বলেন টেরাকোটা শিল্পের কলা কৌশল ৷ তাঁদের তৈরি জিনিসপত্র না কিনলেও কেউ বিরক্ত প্রকাশ করেন না৷ টেরাকোটা শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে তাঁদের নিজস্ব সংগঠন, পাঁচমুড়া মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতি৷
পাঁচমুড়ায় টেরাকোটার শিল্পকলা দেখতে দেখতে মনে হয় এখানকার শিল্পীদের তৈরি সামগ্রী শুধু শিল্প নয়, তাঁদের শিল্পের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে শিল্পীর সৃষ্টির উন্মাদনা এবং শিল্পের প্রতি নিষ্ঠা আর অন্তরের ভালোবাসা৷
পাঁচমুড়ার দর্শনীয় টেরাকোটার শিল্পের পাশে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও মাঠের মাঝে দাঁডি়য়ে আছে একটি জীর্ণ দেউল ৷ মল্লভূমে এক সময় যে জৈন ধর্মের ব্যপক প্রসার ঘটেছিল৷ এই দেউল তাঁরই নিদর্শন৷ যা ছিল পারশনাথ বা পরেশনাথের মন্দির৷ ফেরার পথে এই দেউলের সামনে কিছুক্ষন দাঁড়ালাম৷ মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল ৷ দেউলের ক্ষেয়ে যাওয়া ছোট ছোট ইটের দিকে তাকিয়ে পাঁচমুড়ার অতীতকে যখন খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন হঠাৎই আমাদের গাডি়র চালকের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো৷ এদিকে সূর্য ততক্ষনে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে, এবার যে ফিরতে হবে৷ ফিরেও এলাম , কিন্ত্ত সঙ্গে নিয়ে এলাম পাঁচমুড়া গ্রামের অমূল্য স্মৃতি৷