কলকাতা , ৩১ মে – হোয়াটস আপ অস্ত্রে ইডির হাতে ঘায়েল ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। এদিন আদালতে তাঁর ১৪ দিনের ইডি হেফাজত হয় । বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ তাঁকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়। দু’পক্ষের আইনজীবীর সওয়াল জবাব শুনে আদালত তাঁকে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দেয় । ইডির দাবি,, মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল সুজয় ভদ্রের। মানিকের ফোনের হোয়াটস আপ চ্যাট দেখিয়ে সুজয়কৃষ্ণকে জেরা করে ইডি। ইডির দাবি, মানিক ভট্টাচাযকে তিনিই বলে দিতেন কাদের কাদের চাকরি দিতে হবে। ফোন চ্যাট দেখিয়ে এ বিষয়ে কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয় ভদ্রকে প্রশ্ন করা হলেও অস্বীকার করেন তিনি।
ইডির দাবি , ফেব্রুয়ারী মাসে জেরার সময় কুন্তল জানিয়েছিলেন, , ২০১৪ সালের টেট প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি ‘কালীঘাটের কাকু’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কয়েক জন চাকরিপ্রার্থীকে বেআইনি ভাবে টেট পাশ করিয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করানোর জন্যই কুন্তল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সুজয় তখন কুন্তলকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, পার্থের সঙ্গে কথা বললেই তাঁর কাজ হয়ে যাবে। সেই সময়েই কুন্তল সুজয়কে ৭০ লক্ষ টাকা দেন। সুজয়ের কথাতেই তিনি পার্থকে দেন আরও ১০ লক্ষ টাকা। যদিও ইডি জানায় , ৩০ মে ‘কালীঘাটের কাকু’ এই আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্স, ১২ ঘণ্টা ম্যারাথন জেরা, এরপর রাত ১১ টা নাগাদ খবর আসে গ্রেফতার করা হয়েছে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র অর্থাৎ কালীঘাটের কাকু-কে। ইডি সূত্রে জানা গেছে , গত ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে , কিন্তু কিচ্ছু খাচ্ছেন না কালীঘাটের কাকু। গ্রেফতারির পর বুধবার সকালেও যখন ইডির তরফ থেকে সুজয়কে খাবার দেওয়া হয়, তিনি খেতে অস্বীকার করেন । সেই নিয়ে সমস্যায় তদন্তকারীরা। ইডির আশঙ্কা, এর ফলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন তিনি। অন্যদিকে, ইডি আইনজীবীর দাবি, প্রশ্ন এড়াতেই এই কাজ করছেন সুজয়কৃষ্ণ। অসুস্থ হলে ইডি হেফাজতের বদলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। সেটাই চাইছেন কালীঘাটের কাকু বলে দাবি ইডির।
কালীঘাটের কাকু অর্থাৎ সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে বুধবার সকালে সল্টলেক সিজিও কমপ্লেক্স ইডি দফতর থেকে প্রথমে তাকে জোকা ইএসআই হাসপাতালে তার মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর রক্তচাপ ওঠা নামা করায় ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় লাগে তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষায়। এরপর দুপুর আড়াইটে নাগাদ তাঁকে আদালতে পেশ করা হয়।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের নাম সামনে আসতেই তাঁকে তলব করে সিবিআই। প্রথমে তলব এড়ালেও পরে হাজিরা দেন তিনি। ইতিমধ্যেই একাধিকবার দফায় দফায় ‘কালীঘাটের কাকু’-এর বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালায় সিবিআই ও ইডি। গত ২০ মে যেদিন কুন্তল ঘোষের চিঠি প্রসঙ্গে তৃণমূলের সর্বভারতী সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল ইডি, ওই দিনই আবারও তল্লাশি চলে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি, অফিস সহ বিভিন্ন সম্পত্তিতে চলে তল্লাশি।
দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ, টানা ১২ ঘণ্টা জেরা, বাড়ি ও অফিসে বারংবার তল্লাশির পর ইডির হাতে গ্রেফতার ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। তদন্তে অসহযোগিতা, আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির অসামঞ্জস্য-সহ তথ্যে গোপনীয়তার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। গোপাল দলপতি থেকে শুরু করে তাপস মণ্ডলের মুখে শোনা যায় ‘কালীঘাটের কাকু’ সম্বোধন। কুন্তলের মুখেও শোনা যায় এই নাম। পরে তাপসই বলেন কালিঘাটের কাকুর নাম সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র।
ইডি সূত্রে খবর, নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অন্যতম কিং পিন সুজয়কৃ্ষ্ণ ভদ্র । তাঁর মাধ্যমেই কালো টাকা সাদা হয়েছে। আদালতের বাইরে তাপস সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘সুজয়ের কাছে এজেন্টদের তালিকা ও টাকা পৌঁছে যেত।’তবে গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। মঙ্গলবার ইডির দফতরে হাজিরা দেওয়ার আগেও তিনি জোর গলায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
আগে ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলে দাবি করেন, ‘তাপস মণ্ডলকে চিনি না। কালীঘাটের কেন বলা হচ্ছে তাও আমার জানা নেই। টিভিতে দেখেছি। আমার কাছে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা কী ভাবে আসবে? আমার নিজের মেজদার মেয়ে এমএ-বিএড। তার কোনও চাকরি হয়নি। আমার নিজের একমাত্র মেয়ে, টেট পরীক্ষা দিয়েছিল, কিন্তু চাকরি হয়নি। আমার ক্ষমতা থাকলে আমার মেয়ে, দাদার মেয়ের চাকরি হত না ? দাদার মেয়ের তো সব যোগ্যতাই ছিল। তিনি আরও বলেন , ‘আমার সাহেবকে পৃথিবীর কারও ক্ষমতা নেই ছুঁতে পারবে। আমার সাহেব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কী চেষ্টা হচ্ছে আপনারা বুঝবেন। তাই আমার কাছ অবধি এসে থেমে যেতে হচ্ছে। আমি অভিষেকের অফিসে চাকরি করি, ২০০৯ সাল থেকে আছি।’
মঙ্গলবার সকাল ১১ টা নাগাদ কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় সুজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘বেরিয়ে এসে কথা বলব। সবরকম ভাবে সহযোগিতা করব।’ ইডি সূত্রে খবর, দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য তুলে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কাকুকে । কিন্তু বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। এমনকি মোবাইল ফোনে তাঁর সামনে বহু তথ্য তুলে ধরা হলেও, তিনি মানতে অস্বীকার করেন। নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে তাঁকে জেরা করে জরুরি অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আগেই কালীঘাটের কাকুর মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সেখানেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওযা গিয়েছে।
জানা গিয়েছে, বুধবার মেডিক্যাল টেস্টের পর সুজয়কৃ্ষ্ণকে আদালতে তোলা হবে। ১৪ দিন হেফাজতে নিতে চেয়ে আবেদন জানাবে । এদিন তাঁকে জোকা ইএসআই -হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
গত ২০ মে সুজয়ের বেহালার ফকিরপাড়া রোডের ফ্ল্যাট, বাড়ি, অফিস-সহ বহু জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। ওই দিনই নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। সুজয় এক সময় অভিষেকের অফিসে কাজ করতেন। ‘কাকু’র সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন ৩টি সংস্থাতেও তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। সেই সংস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই ৩টি সংস্থার মধ্যে একটি সংস্থা বিশেষ করে নজরে রয়েছে তদন্তকারীদের। সেই সংস্থা ‘কালীঘাটের কাকু’ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে তদন্তকারীদের ধারণা। ওই সংস্থাগুলির ডিরেক্টর এবং অ্যাকাউন্ট্যান্টদের তলব করা হয় আগেই। এর পরেই মঙ্গলবার তলব করা হয় সুজয়কে।
এদিকে সুজয়কৃষ্ণের গ্রেপ্তারির পর কটাক্ষ করতে ছাড়েননি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছে, এবার মাথা বাকি। মুখ্যমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে।” অন্যদিকে দিলীপের কটাক্ষ ,‘কাকু-জেঠু হয়ে গিয়েছে, পিসি-ভাইপো বাকি’।