হঠাৎ হাত-পা ফোলা উদ্বেগের বিষয় কিন্তু

অনেক সময় হঠাৎ পা ফুলে যায়৷ এ নিয়ে রোগীর উদ্বেগ বেড়ে যায়৷ হঠাৎ হাত-পা ফোলা অবহেলার বিষয় নয়৷ বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হল দুই পা, নাকি এক পা ফোলা৷ দুই পা একসঙ্গে ফুলে যাওয়া দেখলে সাধারণত নিচের কারণগুলো বিবেচনায় নিতে হয়-
* হার্ট ফেইলিউর
* কিডনি ফেইলিউর
* লিভার ফেইলিউর
* থাইরয়েড হরমোনের অভাব
* কোনো ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া৷ এদের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব অনুসঙ্গ থাকবে৷ যেমন শ্বাসকষ্ট, মুখ ফোলা, পেট ফোলা, জন্ডিস, প্রস্রাব কম হওয়া বা না হওয়া, গলার স্বরে পরির্বতন ইত্যাদি৷ হার্ট, লিভার বা কিডনির কার্যক্ষমতায় উন্নতি হলে এসব ফোলাও কমে যায়৷
হঠাৎ পা ফোলার কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কৌশিক কুমার দাস৷
যে পথগুলো দিয়ে রক্ত হূৎপিণ্ডে ফিরে যায়, সেগুলোকে শিরা বলা হয়, ইংরেজিতে ভেইন৷ শিরাগুলো দু’ স্তরে বিন্যস্ত; চামড়ার নিচে ও মাংসের বা দেহগহ্বরের ভেতরে৷ গভীরে অবস্থিত শিরাগুলোই রক্ত ফেরত নেওয়ার মূল কাজটা করে৷ এরা আকারেও অনেক বড়৷ কোনো কারণে যদি এসব মোটা শিরার মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যায়, তাকে ‘ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস’ বা সংক্ষেপে ডিভিটি বলে৷ এর ফলে রক্ত ফেরত যাওয়ার মূল পথটাই বন্ধ হয়ে যায়৷ ধমনীর মাধ্যমে রক্ত পায়ে আসছে কিন্ত্ত ফেরত যেতে পারছে না, তাই পা ফুলে যায়৷ ফোলা যখন এক পায়ে হয়, তখন ডিভিটি’র কথা মাথায় আনতে হয়৷ প্রশ্ন উঠতে পারে ডিভিটি দুই পায়ে একসঙ্গে হতে পারে না? পারে৷ তবে সাধারণত হয় না৷
লক্ষণ:
হঠাৎ ব্যথার সঙ্গে পা ফুলে শক্ত হয়ে যাওয়া ডিভিটির মূল লক্ষণ৷ এর সঙ্গে কারণ সংক্রান্ত কিছু অনুসঙ্গ রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করতে পারে৷ যেমন রোগী দীর্ঘদিন বিছানা বন্দি ছিলেন কিনা, রোগী ক্যান্সারে ভুগছেন কিনা, পায়ে কোনো আঘাত পেয়েছেন কিনা, উড়োজাহাজ, ট্রেন বা বাসে লম্বা পথ ভ্রমণ করেছেন কিনা ইত্যাদি৷ অনেক সময় অবশ্য এসবের কিছুই থাকে না, বিশেষত অল্প বয়স্কদের হঠাৎ পা ফুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে৷ এসব ক্ষেত্রে রক্তের উপাদানগত ক্রটির কথা ভাবতে হয়৷
লিম্ফ ইডিমা বা সেলুলাইটিস নয় তো
এক পা ফুলে গেলেই ডিভিটি সব সময় হবে তা নয়৷ মাঝে মাঝে লসিকা নালীতে ব্লক (লিম্ফ ইডিমা), প্রদাহ বা জীবাণুর সংক্রমণে হাত-পা ফুলতে পারে৷ ভারকো’স ট্রায়াড ডিভিটির কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়৷ এগুলোকে বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসক রুডলফ ভারকো’র নামানুযায়ী ভারকো’স ট্রায়াড নামে অভিহিত করা হয় যদিও তিনি নিজে কখনও এগুলোকে বর্ণনা করেননি৷ রক্তপ্রবাহে স্থবিরতা রক্ত চলাচল স্থবির হয়ে পড়লে ডিভিটি’র আশঙ্কা বেড়ে যায়৷ অসুস্থতা, অপারেশন বা অন্য যে কোনো কারণে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ব্যক্তি এবং বিমান বা সড়ক পথে দীর্ঘ ভ্রমণেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে৷
ইকোনমি ক্লাস সিনড্রোম
বিমানে দীর্ঘপথ ভ্রমণে অনেক সময় ডিভিটি হয়৷ এক্ষেত্রেও কারণ ওইটাই৷ পায়ের নড়াচাড়া দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকার কারণে রক্ত চলাচল স্থরির হয়ে পড়ে৷ ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণে হাত-পা নড়াচাড়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম হওয়াতে এদের ডিভিটি বেশি হয়৷ বিজিনেস ক্লাসে জায়গা বেশি, নড়াচাড়ার সুযোগও বেশি, ডিভিটিও তাই কম হওয়ার কথা৷
শিরার ভেতরের দেয়ালে ক্ষত
শিরার ভেতরের দেয়ালে এক বিশেষ ধরনের আস্তরণ থাকে যা স্বাভাবিক অবস্থায় শিরার ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে৷ কোনো কারণে এই আস্তরণে ক্ষত সৃষ্টি হলে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়৷ আঘাত, রক্তচাপ, জীবাণু, রক্তবাহিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বা রক্তপ্রবাহে কোনো কৃত্রিম পদার্থের উপস্থিতি এ ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে৷
রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা
উপাদানগত ত্রুটির কারণে অনেক সময় রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়৷ প্রোটিন সি, প্রোটিস এস, অ্যান্টি থ্রম্বিন-৩, ফ্যাক্টর-৫ লিডেন এসব উপাদান রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে৷ জন্মগত তথা জিনের ত্রুটি বিচু্যতির কারণে এরকম হয়ে থাকে৷ রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধিও এর জমাট বেঁধে যাবার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়৷ জলশূন্যতা থেকেও এমনটা হতে পারে৷
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রক্তনালীর আল্ট্রাসনোগ্রাম বা ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স স্টাডির মাধ্যমে প্রায় ৯৯% ক্ষেত্রে এই রোগ নিরুপণ করা সম্ভব৷ ’ডি ডাইমার’ নামের এক ধরনের রক্ত পরীক্ষাও এ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে৷
চিকিৎসা
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ডিভিটির চিকিৎসা মূলত ওষুধের মাধ্যমে করা হয়৷ হেপারিন নামে এক ধরনের ওষুধ আছে যা রক্তকে জমাট বাঁঁধতে বাঁধা দেয়৷ শুরুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়৷ সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা গেলে এই ওষুধের ফলাফল বেশ ভালো৷ সম্প্রতি এই ইনজেকশনের বিকল্প মুখে খাবার ওষুধ বাজারে এসেছে৷ এর কার্যকারিতা ইনজেকশনের মতোই৷ আরও এক ধরনের ওষুধ ডিভিটি’র চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়৷ ওয়ারফারিন নামের এই ওষুধও যথেষ্ট কার্যকর, দামও কম৷ কিন্ত্ত ওষুধটি শরীরে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে এবং অন্য অনেক ওষুধের সঙ্গে এর বিক্রিয়া রয়েছে যার ফলে নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ নিয়মিত খাওয়া সত্ত্বেও রক্তে এর মাত্রা কমে বা বেড়ে যেতে পারে৷ তাই মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে এর মাত্রা দেখে নিতে হয়৷ অন্যথায় মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে৷
ডিভিটি’র আধুনিক চিকিৎসা
থ্রম্বোলাইসিস
আধুনিক চিকিৎসায় শিরাতে স্যালাইনের মাধ্যেমে বা ডিভিটি আক্রান্ত শিরার মধ্যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে তার মাধ্যমে এমন ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যার কাজ জমাট রক্তকে তরলায়িত করা৷ অনেক সময় আবার জমাট রক্তকে যন্ত্রের মাধ্যমে চূর্ণ করে বাইরে বের করে নিয়ে আসা হয়৷ ডিভিটি শুরু হওয়ার সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহের মধ্যে এসব চিকিৎসা শুরু করার সুযোগ থাকে৷ এসব চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়াতে বাংলাদেশে এখনও সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি৷
ডিভিটি থেকে পালমোনারি এম্বোলিজম
ডিভিটি মূলত পায়ের সমস্যা হলেও কখনও কখনও এটা প্রাণঘাতি হয়ে উঠতে পারে৷ পায়ের শিরা থেকে জমাট রক্তের বড় চাকা ছুটে গিয়ে রক্ত স্রোতের সঙ্গে ভেসে ফুসফুসের রক্তনালীতে গিয়ে আটকে যেতে পারে৷ তাতে হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে রোগীর মৃতু্য পর্যন্ত হতে পারে৷ ডিভিটি’র অর্ধেকেরও বেশি রোগী পালমোনারি এম্বোলিজম নামে পরিচিত এই জটিলতায় আক্রান্ত হন, তবে সব সময় তা প্রাণঘাতি হয় না৷ এই জটিলতা প্রতিরোধের উপায় আছে৷ পালমোনারি এম্বোলিজম প্রতিরোধে ধাতুর জাল দিয়ে তৈরি ছাতা জাতীয় এক ধরনের ফিল্টার পেটের মধ্যে শিরার প্রবাহপথে  স্থাপন করা হয়৷ পায়ের শিরা থেকে জমাট রক্ত ছুটে গেলেও ফুসফুসে পৌঁছানোর আগেই এই ফিল্টারে আটকে যায়৷ বেশ খরচসাপেক্ষ হওয়াতে আমাদের দেশে খুব একটা ব্যবহূত হয় না৷পোস্ট থ্রম্বোটিক সিনড্রোমএক সময় পা ফোলা ছিল এখন ফোলা খুব একটা নেই তবে পা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে৷ মাঝে মাঝে ঘা হচ্ছে, শুকাচ্ছে, আবার হচ্ছে৷ ডিভিটি’র পরে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে৷ মূলত ডিভিটি রোগীদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এই পোস্ট থ্রম্বোটিক সিনড্রোম নামক জটিলতায় ভুগে থাকেন৷ এর চিকিৎসা সহজ নয়৷
অল্প বয়সে ডিভিটিঅল্প বয়সীদের ডিভিটি রোগ হলে উপরে বর্ণিত রক্তের উপাদানগত ক্রটির (যেমন প্রোটিন সি, প্রোটিন এস, অ্যান্টি থ্রম্বিন-৩ ইত্যাদির ঘাটতি) কথা মাথায় রাখতে হয়৷ এসব রোগীদের সারাজীবন রক্ত তরল রাখার ওষুধ সেবন করতে হতে পারে৷ একিউট ডিভিটি, ক্রনিক ডিভিটিপ্রথম দু’সপ্তাহের ভেতরে ডিভিটিকে একিউট ডিভিটি বলা হয় এর পর এটা ক্রনিক পর্যায়ে চলে যায়৷ একিউট ডিভিটির চিকিৎসা যতটা সন্তোষজনক, ক্রনিক ডিভিটি ততটা নয়৷ থ্রম্বোলাইসিস জাতীয় আধুনিক চিকিৎসা ক্রনিক ডিভিটিতে কাজ করে না৷ আধুনিক চিকিৎসায় অনেক সময় ক্রনিক ডিভিটিতে আক্রান্ত পায়ের উপরের দিকে বন্ধ শিরা বেলুন/রিং ব্যবহার করে খুলে দেয়া হয় তাতে রক্ত উপরিবহনের উন্নতি হয়ে পা ফোলাসহ অন্যান্য লক্ষণগুলোর উন্নতি হয়৷ ব্যয়বহুল হওয়াতে এই চিকিৎসার প্রয়োগ আমাদের দেশে খুবই কম৷
হাতের ডিভিটি
পায়ের তুলনায় হাতের ডিভিটি তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক কম৷ বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে হাতেও ডিভিটি হতে পারে৷ যেমন, কোনো কারণে যদি ঘাড়ের কাছে হাত থেকে রক্ত নিয়ে যাওয়া শিরায় বাঁধার সৃষ্টি হয়৷ এরকম বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে যদি জন্মগতভাবে ঘাড়ের কোনো পাশে সারভাইকাল রিব নামের বাড়তি হাড় থাকে৷ ফুসফুসের উপরের দিকে বড় ধরনের টিউমার থাকলে সেটাও শিরার উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে হাতের ডিভিটির কারণ হতে পারে৷