শিক্ষক দিবস পালনে রাধাকৃষ্ণনের পরিবর্তে বিদ্যাসাগরের নাম নিয়ে বিতর্কটি অত্যন্ত জরুরি

অনেকেই বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালনের পক্ষপাতী। তাঁর অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের পরশে বাংলার শিক্ষাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। শুধু তাই নয়, আজীবন তিনি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, আমজনতার মধ্যে বিদ্যা-শিক্ষার আলো জ্বালানোয় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। সেখানে তাঁর অকল্পনীয় সুদৃঢ় নীতি-আদর্শ ও আত্মত্যাগের স্বমহিমায় আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় খুঁজে নেওয়ায় অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস পালন করা উচিত মনে হচ্ছে অনেকের। অন্যদিকে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস প্রচলনের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কুম্ভিলকতার অভিযোগের আলোয় নতুন করে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস পালনে স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকের আদর্শ পরিচয়ে বিদ্যাসাগরের ভূমিকাটি একবার ফিরে দেখা জরুরি হয়ে ওঠে। কাউকে ছোট করার জন্য তাকে বিরূপ সমালোচনার চেয়ে নিজেকে বড় প্রমাণ করলেই তা সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। কোনো রেখাকে না মুছেও পাশে একটি বড় দাগ টানলেই সেটি ছোট হয়ে যায়। এজন্য শিক্ষক বিদ্যাসাগরের পরিচয় আবশ্যক মনে হয়।

শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা যত চর্চার আলোয় নানা ভাবে স্পষ্টতা লাভে মুখর, তাঁর শিক্ষক সত্তা ততই অনালোকিত আঁধারে নীরব। সেখানে তাঁর শিক্ষা বিস্তারের অবদান শুধু বিস্ময় সৃষ্টি করেনি, সেই বিস্ময়ের আবর্তে তাঁর শিক্ষক সত্তার পরিচয়ও আমাদের কৌতূহল নিবারণ করেছে। বিদ্যাসাগরের বিদ্যাবিভূতি ক্রমশ তাঁর নামকেই মুছে দিয়েছে। সেদিক থেকে তাঁর শিক্ষাজীবনের চর্চা নানাভাবেই প্রকাশমুখর। অথচ তাঁর কর্মজীবনে শিক্ষকতার পরিচয় তথ্যমাত্র পরিচয়ে শেষ হয়ে যায়, শিক্ষা বিস্তারেই সরব হয়ে ওঠে। বটগাছের শ্রীবৃদ্ধিতে তার মূলের চেয়ে জটার মূলের প্রাচুর্যে আসল মূলের দৃষ্টি সরে যাওয়ার মতো বিদ্যাসাগরের শিক্ষক সত্তা আজও অধরা মাধুরী। সেক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষক প্রকৃতি বাঙালি মানসে নিবিড়তা লাভ করেনি। শিক্ষক বিদ্যাসাগরের পরিচয় শুধু মাত্র কিছু তথ্যের সমাহারেই বর্তমান, তার অতীত নেই, ভবিষ্যত অনিশ্চিত।

আসলে বিদ্যাসাগরের জীবনীকাররাও সেখানে অসহায়। তাঁরা সকলেই বিদ্যাসাগরের উন্মেষ ও বিকাশ ভালো করে দেখার অবকাশ পাননি। তাঁর প্রথম জীবনীকার শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন নিজের দাদাকে অনেকটাই বাবাকে ছেলের মতো জেনেছিলেন। কাছে থেকেও দূরের মানুষ। কলকাতায় শিক্ষক বিদ্যাসাগরের পরিচয় তাঁর কাছেও সুলভ ছিল না। এছাড়া অন্যান্য জীবনীকাররাও তাঁর জীবনের উপান্তে তাঁকে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া তথ্যের অভাবও প্রকট সেখানে। শিক্ষকের যথার্থ বিশ্বস্ত পরিচয় ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিদ্যাসাগরের পরিচয় দুর্লভ। শুধু তাই নয়, তাঁর অপার দয়ায়, দানে উপকৃত জনসাধারণের মধ্যে থেকে সেই ছাত্রদের স্বতন্ত্র করে দেখা অসমীচীন। সেখানে তাঁর সবার জন্যই অবারিত দ্বার। সেদিক থেকে শিক্ষক বিদ্যাসাগরের স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে ওঠেনি। অথচ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ মিলিয়ে তাঁর প্রায় সতেরো বছরের কর্মজীবনে বর্তমান।


দুদুটো স্বনামধন্য কলেজে শিক্ষকতা করেও বিদ্যাসাগরের শিক্ষকতার পরিচয় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি। গুরুশিষ্যের পরম্পরায় শিষ্যের গৌরবে গুরুর আলোকোজ্জ্বল বিভূতি ছড়িয়ে পড়েনি। আসলে তার অবকাশও ছিল না। তাঁর শিক্ষক জীবন আর পাঁচজন শিক্ষকের মতো নয়। সেখানেও বিদ্যাসাগরের তেজস্বী ব্যক্তিত্বের পরশ, ঘটনাবহুল অস্থিরতা, ব্যক্তিত্বের তীব্র সংঘাত ও শিক্ষা বিস্তারে বহুমুখী লক্ষ্যসাধনের তৎপরতা বর্তমান। সেক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষক জীবন তাঁর শিক্ষক সত্তার আনুকূল্য লাভের চেয়ে শিক্ষার সংকট ও তার উত্তরণের প্রতি দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি উভয়ই সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৪১-এর ২৯ ডিসেম্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিযুক্ত হন। প্রথমে হিসাব রক্ষক ও পরে বাংলা বিভাগের হেড পণ্ডিত হয়েছেন। তারপর সেখান থেকে সংস্কৃত কলেজে আবার সংস্কৃত কলেজ থেকে ফোর্ট কলেজ ফিরে আসা। এভাবেই আবার সংস্কৃত কলেজে ফিরে অধ্যক্ষ হয়ে কয়েক বছর পর পদত্যাগ করেন। শুধু অস্থিরতাই নয়, আকস্মিকতাও তাঁকে শিক্ষকতায় নিবিড় করে তোলেনি। যখনই তিনি কাজ করা ও আত্মমর্যাদার অভাববোধ করেছেন, তখনই তাঁর পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে তিনি শুধু শিক্ষকতাতেই নিযুক্ত হননি, নানা সময়ে একাধিক পদেই তাঁকে প্রতিষ্ঠানদুটির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে শিক্ষকতার চেয়ে শিক্ষার সম্প্রসারণের দিকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এজন্য প্রশাসনিক পদের প্রতি বিদ্যাসাগরের তাঁর আগ্রহ লক্ষ করা যায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনার পঞ্চাশ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে একই মাইনের সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদক পদে সামিল হন ১৮৪৬-এর ৬ এপ্রিল। আবার ১৮৪৭-এর ১৬ জুলাই সেখানে সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মনোমালিন্যে সেখান থেকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ১৮৪৯-এর ১মার্চ হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে ফিরে আসেন। অবশ্য তাঁর আকস্মিক অস্থিরতার জন্য আর্থিক মূল্যও চোকাতে হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ফিরে আসতে মাসিক আশি টাকা বেতনের চাকরির জন্য পাঁচ হাজার টাকা জামিন রাখতে হয়েছে। আবার বছর গড়াতেই পদত্যাগ (১৮৫০-এর ৪ ডিসেম্বর) ও সংস্কৃত কলেজে আবার ফিরে যাওয়া (১৮৫১-এর ৫ জানুয়ারি)। তবে এবার বিদ্যাসাগর সাহিত্যের অধ্যাপক। সেইসঙ্গে অস্থায়ী ভাবে তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সপ্তাহদুয়েক পরেই ২২ জানুয়ারি তিনি অধ্যক্ষের আসনে সমাসীন হন। সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের সরাসরি শিক্ষকতার পরিসর শুধু সীমিত নয়, অস্থির ও অনিবিড়।

বিদ্যাসাগরের লক্ষ্য যে শিক্ষকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অচিরেই তাঁর বহুমুখী কর্মমুখর জীবনধারাতেই প্রতীয়মান। সেখানে শিক্ষকতার চেয়ে শিক্ষার সংস্কার থেকে শিক্ষা বিস্তারেই তাঁর শিক্ষাব্রতী মনের পরিচয় নানা ভাবেই সেই পরিসরেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে তাঁর কাছে শিক্ষকতা নয়, শিক্ষায় প্রশাসকের ভূমিকা অধিক গুরুত্ব লাভ করে। অনতি বিলম্বে সহকারী সম্পাদক থেকে অধ্যক্ষ সবতেই তাঁর বিস্তার। সেখানে অধ্যক্ষ হয়ে অসংখ্য সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাকে যেমন উন্মুক্ত করতে চেয়েছেন, তেমনই শিক্ষায় সকলের জন্য দ্বার মুক্ত করার প্রয়াসী হয়েছেন। সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণদের ক্রমে শিক্ষার অধিকার প্রদান করা(১৮৫১) ছিল তাঁর যুগান্তকারী পদক্ষেপ। রবিবারের ছুটির প্রচলন তিনিই করেন। আধুনিক উপযোগী সিলেবাস থেকে গোঁড়ামিমুক্ত শিক্ষাই শুধু নয়, বিদ্যার (Education) ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার (Learning) মেলবন্ধন তিনিই করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রদুটিতে বিদ্যাসাগর শিক্ষকতার মহান আদর্শে নিজেকে মেলে ধরার চেয়ে শিক্ষার সংস্কার ও প্রসারের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করেছিলেন। এজন্য যখনই তার সুযোগ পেয়েছেন, তখনই তিনি লক্ষ্যভেদী অর্জুন হয়ে উঠেছেন। সেদিক থেকেও তাঁর শিক্ষক সত্তার চেয়ে শিক্ষার সম্প্রসারকের ভূমিকা উৎকর্ষমুখর হয়ে উঠেছে। তাঁর শিক্ষক জীবনের মধ্যেই তাঁর সেই ভূমিকা ক্রমশ তীব্রতা লাভ করে। ১৮৪৯-এ-ই নারীশিক্ষার প্রচলনে তাঁর ভূমিকা সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ১৮৫৫-র ১ মে বিদ্যাসাগর দক্ষিণ বঙ্গের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসাবে নিযুক্ত হন। তখন তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ। দুই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি স্বচ্ছন্দে আপন করে নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্রত কত তীব্র ছিল, তা তাঁর বহুমুখী কর্মতৎপরতাতেই সহজবোধ্য মনে হয়। পরিদর্শকের কাজে বেরিয়ে পাল্কীতে বসে বসেই তাঁর ‘বর্ণপরিচয়'(১ম ও ২য়, ১৮৫৫) লেখা। তাঁর পরিকল্পনা কত সুদূরপ্রসারী ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপেই তার পরিচয় বর্তমান। ১৮৪৭-এ মদনমোহন তর্কলঙ্কারকে সঙ্গে নিয়ে ছাপাখানা খুলে ছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন ‘সংস্কৃত যন্ত্র’। তাতে বিদ্যালয় পাঠ্য বই প্রকাশে তাঁর স্বকীয় পরিকল্পনা ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। অন্যদিকে কলেজ স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর একটি বইয়ের দোকানও (‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’) খুলেছিলেন। এসবই তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। ক্রমশ তাঁর লক্ষ্য পূরণে সেই সব পরিকল্পনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। শিক্ষায় পাঠ্য বইয়ের অভাব পূরণে তিনি নিজেই লেখনী ধারণ করেন। তাঁর সৃজনী প্রতিভায় একের পর এক পাঠ্য বইয়ের প্রকাশে শিক্ষাক্ষেত্রের তার অভাব দূর হতে থাকে। কলেজের কাজে সক্রিয় থাকার পরিসরেই তাঁর ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি'(১৮৪৭), ‘বাঙ্গালার ইতিহাস'(২য় ভাগ১৮৪৮), ‘জীবনচরিত'(১৮৪৯), ‘বোধোদয়'(শিশুশিক্ষা, ৪র্থ ভাগ ১৮৫১), ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা'(১৮৫১), ‘ঋজুপাঠ’ (১ম১৮৫১, ২য় ১৮৫২, , ৩য় ১৮৫৩), ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব(১৮৫৩), ‘ব্যাকরণ কৌমুদী (১ম, ২য় ও ৩য়, ১৮৫৩), ‘শকুন্তলা'(১৮৫৪) প্রভৃতি বই প্রকাশিত হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থেই লেখা বইগুলোর জন্য বিদ্যাসাগরকে মূল্যবান সময় ব্যয় করতে হয়েছে। অন্যদিকে ১৮৫৫-তেই তাঁর স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য তীব্র গতিতে এগিয়ে চলে। সেই বছরেই বিদ্যাসাগর দক্ষিণ বঙ্গে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুরে ১৯টি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য তার অনেক পূর্বেই বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজর তরুণ অধ্যাপক। তাঁর পরামর্শে শিক্ষা সমিতির অধ্যক্ষ ড. মোয়াট, ছোটলাট হ্যালিডে ও বড়লাট হার্ডিঞ্জের সক্রিয় সহযোগিতায় চার বছরে (১৮৪৪-১৮৪৮) ১০১টি পাঠশালা বা বঙ্গ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। আবার তার আগেই বিদ্যাসাগর নিজের অর্থে ১৮৫৩-তেই বীরসিংহ গ্রামে একটি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া সেখানে একটি নাইট স্কুলও গড়ে তোলেন যা দেশের মধ্যে প্রথম নাইট স্কুল বা রাখাল বিদ্যালয়। অন্যদিকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলে। নারীশিক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগে বিদ্যাসাগরের লক্ষ্য বিস্তার লাভ করে। ১৮৫৭-এর ২৪ নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-এর ১৫মে পর্যন্ত তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুরে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষার অগ্রগতিতে শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের জন্যও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫৫-এর ১৭ জুলাই তাঁর তত্ত্বাবধানে সেই স্কুল হিন্দু কলেজের বাংলা পাঠশালায় গড়ে ওঠে, নাম ‘নর্মাল স্কুল’।
আসলে বিদ্যাসাগরের শিক্ষক জীবন সেই অর্থে ছাত্র পড়াতে নয়, শিক্ষায় সংস্কার ও প্রসারেই অতিবাহিত হয়। তাঁর দৃষ্টি তাই কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বৃহত্তর ও মহত্তর চেতনায় ক্রমশ শিক্ষা বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ গড়ে তুলতে যে শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকা বর্তমান, তা তিনি প্রথমাবধি সচেতন ছিলেন। এজন্য কলেজদুটি তার কাছে অভিজ্ঞতার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেখানে আদর্শ শিক্ষকের চেয়ে তাঁর মন পড়েছিল আদর্শ শিক্ষায়। যেখানে বিষয়ের অভাব তীব্র, সেখানে বিষয়ীর আভিজাত্যের গৌরব মনকে প্রশান্তি দেয় না। খাদ্যের অভাবে পীড়িত মানুষের কাছে খাদ্যই অপরিহার্য, সুখাদ্যের বিচার বিশ্লেষণ করা শুধু বিলাসিতা নয়, বিকৃত মানসিকতাও। শিক্ষার অভাবে দেশের দৈন্য দশার মধ্যে কলকাতার শিক্ষার সৌরভ আসলে শরীরের রক্ত মুখে ওঠার সামিল। শিক্ষক বিদ্যাসাগর সেই কলকাতার সীমাবদ্ধ আলোকে ছড়িয়ে দেওয়ায় সক্রিয় ছিলেন। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে শিক্ষার অভাবে সমাজে কুসংস্কারে সবচেয়ে বেশি শিকার দেশের নারীরা। এজন্য নারীশিক্ষার বিস্তারের পাশাপাশি ১৮৫৫-তেই বিধবা বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন, বিতর্কের শিকার হয়ে সরকারি ভাবে বিধবা বিবাহের আইন প্রণয়নে(১৮৫৬-এর ১৬ জুলাই) সফল হন। শুধু তাই নয়, রক্ষণশীল সমাজে তার প্রচলনে তাঁকে জীবনপণ করে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর এসব তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীনই করেছেন। তাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, বিধ্বস্ত হয়েও হাল ছাড়েননি।

সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের শিক্ষক জীবনের সংগ্রামমুখর, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও অস্বস্তিকর উত্তেজনাময়। তার পরেও তাঁর শিক্ষাব্রতী পরিচয় চির অম্লান। বিদ্যালয় পরিদর্শক ও অধ্যক্ষ পদ থেকে সরে এলেও আজীবন ব্রতচূত হননি। দারিদ্রে, অভাব অনটনে, অসহায়তার মধ্যেই জীবনের আদর্শ ও ব্রতের আসল পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে বিদ্যাসাগর শুধু অনন্য নন, অতুলনীয় মহাত্মা। চাকরি ছেড়ে দিলে তাঁকে আলুপটলের দোকান করে খেতে হবে বলে রসময় দত্তের কটাক্ষও বিদ্যাসাগরকে বিরত করতে পারেনি, তাঁর আদর্শ-ব্রতেরও বিরতি ঘটেনি। পরিদর্শকের দুশো আর অধ্যক্ষের দেড়শো সব দিয়ে সাড়ে তিনশো টাকার মাসিক আয় বন্ধ হয়ে গেলেও তাঁর আরাধ্য কাজ সচল ছিল। আর্থিক সংকটের মধ্যেও মেট্রোপলিটন স্কুল ও কলেজ (বর্তমানে ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’) গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, বীরসিংহ গ্রামেও মায়ের স্মৃতিতে ভগবতী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সমাজসংস্কার সবই অব্যাহত থাকে। সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের শিক্ষকতার পরিসর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, শিক্ষার সার্বিক বিকাশে তাঁর বহুমুখী ও বহুরূপী বিচিত্র কর্মধারায় তার বিস্তৃতি শুধু বিস্ময়কর নয়, অকল্পনীয় অমানুষিক পরিচয় জাগিয়ে তোলে। এজন্য প্রচলিত শিক্ষকের ধারণায় তাঁকে মূল্যায়ন করা যায় না, কোনো পরিমাপক যন্ত্রই তাঁর মূল্যমান নির্ধারণে যথেষ্ট নয়।

বিদ্যাসাগর শিক্ষক হিসাবে কেমন ছিলেন, তার পরিচয় সুলভ নয়, জরুরি হয়েও ওঠে না। গুরুর পরিচয় শিষ্যে হলেও যে গুরুই হতে চাননি, তার পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর কথায় প্রচলিত ছড়ায় রয়েছে, ‘মনে রেখো জগৎটাতে সকলেই গরু / যে যাকে ঠকাতে পারে, সেই তার গুরু।’ সেক্ষেত্রে ঠকানো গুরুর চেয়ে যাতে সেই গুরুর কাছেই ঠকতে না হয়, সেই জেতানোর শিক্ষাই তিনি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তাঁর জনা তিনেক ছাত্রের নাম জানা যায়। হ্যালিডে, সিটনকার ও সিসিল বিডন। কিন্তু সেখানে ছাত্রের চোখে শিক্ষকের পরিচয় দুর্লভ। অবশ্য শিক্ষকের দেরিতে আসা নিয়ে কড়া মনোভাব থেকে ছাত্রদের শারীরিক শাস্তিবিরোধী মানসিকতাসহ নানা কথা প্রচলিত আছে। তাছাড়া তাঁর ছাত্রদরদি মনের পরিচয়ও সুবিদিত। কিন্তু তাতে ‘দয়ার সাগর’ বিদ্যাসাগরই জেগে ওঠে, শিক্ষক বিদ্যাসাগর তারই প্রতিভূ মনে হবে। সেক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষক সত্তার আদিদিগন্ত বিস্তারী সব্যসাচী প্রকৃতি সবুজ সজীবতা লাভ করে না।
আসলে বিদ্যাসাগরের শিক্ষক প্রকৃতি কোনো কালের সঙ্গেই প্রতিতুলনা করা চলে না। তিনি যেমন ‘গতি’হীন পণ্ডিতি করেননি, তেমনই বুনো রামনাথের মতো পণ্ডিতের সাত্ত্বিকতায় নিবিষ্ট ছিলেন না। আবার শিক্ষকের শিষ্টাচার, ক্ষমাসহিষ্ণু আর কর্তব্যপরায়ণ প্রভৃতি গুণ তাঁর চরিত্রের বহুধাব্যাপ্ত মহত্ত্বের ঔজ্জ্বল্যে ম্লান হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার সোপানে শিক্ষকের ছকবন্দি পরিচয়ে Friend, Philosopher & Guide-এর সঙ্গেও বিদ্যাসাগরে মেলানো যায় না। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের মহতী প্রকৃতি এত উচ্চে যে, সেখানে কোনো আদর্শের সিঁড়ি দিয়েও তাঁর শীর্ষে পৌঁছানো অসম্ভব। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুঃখজয়ীর দল’ বইয়ে একজন মহৎ শিক্ষকের পরিচয় দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ইটন স্কুলের একজন হেডমাস্টার ছিলেন যিনি ক্লাসে ঢুকে নিজেই প্রথমে ছাত্রদের অভিবাদন করতেন। এতে অন্য শিক্ষকের কৌতূহলের উত্তরে তিনি ভবিষ্যতের নিউটন, ফ্যারাডে বা মিলটনদের আগাম অভিনন্দন জানানোর কথা জানান। সেই হেডমাস্টার অজানা সম্ভাবনার লালনপালনে ব্রতী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের সব জেনেই শিক্ষাব্রতী হয়েছিলেন। যেখানে একজন আদর্শ শিক্ষক নিজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিজেকে খোঁজেন, বিপুল সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার ব্রতে আজীবন সনিষ্ঠ থাকেন, সেখানে বিদ্যাসাগর নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমানা অতিক্রম করে সারা দেশের মানুষের মনে আলো জ্বেলে স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকেননি, তার রূপায়ণেও জীবনপণ করেছেন।

আদর্শ শিক্ষক শুধু পথ দেখায় না, সেই পথের পথিকও তিনি। সেখানে বিদ্যাসাগর পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু প্রথম নন, একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর ছাত্র হওয়ার জন্যেও যোগ্যতা জরুরি। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডিতেই শিক্ষকের আদর্শ ও ব্রত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, সেখানে বিদ্যাসাগর সর্বস্তরের আমজনতার শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। তাঁর লক্ষ্যে ছাত্র নয়, ছিল মানুষ। সেখানে মানুষ গড়ার কারিগর নয়, মানুষ করার সর্বজনীন অভিভাবকের দায় তাঁকে সক্রিয় রেখেছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী নিজেকে ‘বিদ্যাসাগরের চেলা’ বলেছেন। বিদ্যাসাগরের বহুধাবিস্তৃত ব্যক্তিত্বের পরশ তিনি পেয়েছিলেন। সেখানে বিদ্যাসাগরের শিষ্য বলাতেও তাঁর দ্বিধাবোধ লক্ষণীয়। শিক্ষকের সীমায় তাঁকে বাঁধা যায় না, গুরুর আদর্শে তিনি তুলনারহিত। বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিই ছিল সর্বতোভাবে মানবমুখী। ঈশ্বরমুখী চেতনা তাঁকে পেয়ে বসেনি। গুরুর গুরুত্ব তিনি পেতে চাননি, চেয়েছিলেন শুধু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের মঙ্গলসাধন। আধুনিক শিক্ষা যেখানে ‘বাঁচো ও বাঁচাও’, বিদ্যাসাগর সেখানেও ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র। অন্যকে বাঁচানোর জন্যই নিজেকে সঁপে দেওয়াই তাঁর জীবনাদর্শ। সেখানে ভোগসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর ছাত্র বা শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা হয়ে ওঠে। বছরখানেক আগে বিদ্যাসাগর কলেজের মধ্যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে ছাত্রদের সমস্বরে ‘বিদ্যাসাগরের ছাত্র’ উঠে আসায় মনটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। তাঁর ছাত্র হওয়া তো দুর্লভ সৌভাগ্য বললেও কম বলা হয়।
আমাদের দৃষ্টি যেখানে আপনাতেই আবর্তিত, ঈশ্বর হওয়ার চেতনায় প্রসারিত, সেখানে বিদ্যাসাগর পরহিতে ঈশ্বরকেই অবিশ্বাস করেছেন। শুধু তাই নয়, ঈশ্বরকেই তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম্যে ছোট করে তুলেছেন। ঈশ্বরের পূজা চাই, ভজনা চাই, নিদেনপক্ষে চাই ভক্তি। বিদ্যাসাগর সেসব না চেয়েই অকাতরে বিলিয়েছেন, নিজেকেই সঁপে দিয়েছেন, স্বমূর্তি ধারণ করে অসহায়কে তুষ্ট করায় ব্রতী হয়েছেন। সেই সর্বত্রগামী শিক্ষার আলোকদিশারি মানবহিতৈষী বিদ্যাসাগরের শিক্ষক পরিচয় তাঁর জীবনে সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর শিক্ষার আদর্শ ও ব্রতের নিষ্ঠা ও সততার পরিচয়ই শিক্ষকের পরিচয়কে অসীমে বিস্তার করেছে। বিদ্যায় তিনি কত বড় সাগর ছিলেন, তার পরিচয় অনেকেরই অজানা। অথচ শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকের ভূমিকাকে যে তিনি মহাসাগরের বিস্তার করেছেন, তা একটু সচেতন হলেই বোঝা যায়। সবদিক থেকে তাঁর জন্মদিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করলে শুধু তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হবে না, তাঁর কাছে চির ঋণী বাঙালি তার অপরিশোধ্য ঋণ স্বীকারে কথা অন্তত স্মরণ করার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে বিদ্যাসাগরকে আদর্শ শিক্ষক বললে তাঁকে ছোট করা হয়। তিনি আসলে শিক্ষকের অতুলনীয় আদর্শও প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন।