অশ্লীলতার দায়ে দুই কবি: চিত্তরঞ্জন দাশ ও জীবনানন্দ দাশ

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও কবি জীবনানন্দ দাশ। ফাইল চিত্র

অপূর্বকুমার চট্টোপাধ্যায়

বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে অশ্লীলতার দায়ে কবিকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে এমন ঘটনার উদাহরণ মনে হয় এই দুটি ছাড়া আর নেই। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই কবির কথা এখানে উল্লেখ করতে চলেছি। প্রথমজন হলেন চিত্তরঞ্জন ওরফে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আর অপরজন হলেন নির্জনতার কবি বলে খ্যাত জীবনানন্দ দাশ। প্রথমজন পরবর্তীকালে ব্যারিস্টার হয়ে রাজনীতিবিদ এবং যাঁর রাজনৈতিক শিষ্য হলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। আর অপরজন কবি, গল্পকার, গদ্যকার ও ঔপন্যাসিক। তবে তাঁকে আমরা দিতে পারিনি সময়োচিত মূল্যায়ন। কিন্তু প্রথমজন সম্মান মর্যাদা পেয়েছেন এবং তার বড় প্রমাণ তার মৃত্যুর পর বিশ্বকবি স্বয়ং বলেছেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে— ” এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। “প্রথমে কবি চিত্তরঞ্জন দাশের কথা বলি। চিত্তরঞ্জনের জন্ম ৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৫৪ বছর আগে। এ বছর তার ১৫৫ তম জন্মদিবস। তাঁর পিতার নাম ভুবনমোহন দাশ এবং মাতার নাম নিস্তারিণী দেবী। বাঙালির সন্তান; বয়সের একটা সময় কবিতা লিখবেন না, এমনটা ভাবাই যায় না। তিনি অনেক কবিতা লিখেছিলেন যার দু একটা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। যেমন- অন্তিমে, তুমি ও আমি , স্বর্গের স্বপন প্রভৃতি। ‘নারায়ণ’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি এবং সেকালে তা বোদ্ধাদের প্রশংসা অর্জনও করেছিল। দুঃখের বিষয় তাঁর কবিতা বা অন্য লেখা এখন আর সিলেবাসের অন্তর্ভুক্তি করা হয় না। আরো বলতে পারি তিনি যে একজন কবি ছিলেন, তাঁর রাজনীতির বাইরে এই পরিচয়ের কথা আমরা অনেকেই জানি না। বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। আরো একটি বড় ঘটনা, তিনি নরেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন। সেই সময় নরেন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট-এ শিক্ষকতা করতেন।

স্বামীজীর প্রভাব তাঁর জীবনে বিরাট ছায়া ফেলেছিল। জাতি- ধর্ম -ধনী -নির্ধনী নির্বিশেষে একসাথে পংক্তি ভোজনের বিষয়টি তিনি প্রথম চাক্ষুষ করেন বেলুড় মঠে। সে অনেককাল আগের কথা। তখন এরকমটির চল ছিল না সমাজে। এটি একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা বলে পরিগণিত হয়ে এসেছে; তথা সমাজে এর জন্য শাস্তি বিধানের ব্যবস্থাও ছিল। সেদিন বেলুড় মঠে কোন এক উৎসব ছিল; যাতে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল ভক্ত শিষ্যদের জন্য। দেশবন্ধুর জন্য আলাদাভাবে বসে খাবার ব্যবস্থা থাকলেও তিনি তাতে অস্বীকৃত হন এবং সকলের সাথে পংক্তিভোজনে বসে ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন। আগেই বলেছি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তার রাজনৈতিক শিষ্য এবং তিনি তাঁকে সন্তানের মত স্নেহ করতেন। দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে সুভাষচন্দ্র ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। একথা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। কবি চিত্তরঞ্জন সম্পর্কে আরো একটি ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, “আমার যখন আট নয় বছর বয়স তখন চিত্তরঞ্জন দাশকে আমাদের বাড়িতে সর্বদাই দেখতুম। তখন তিনি সবে বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতার হাইকোর্ট লাইব্রেরিতে বসতে আরম্ভ করেছেন। সমস্ত দিন ‘ব্রিফ’ পাবার জন্য অপেক্ষা করে বিকেল বেলায় ক্লান্ত হয়ে ছুটে আসতেন জোড়াসাঁকোয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই চেঁচিয়ে বলতেন, ‘কাকিমা আমি এসেছি। লুচি মাংস কই ?’ তিনি খেতে ভালোবাসতেন, মাও তাঁকে খাইয়ে তৃপ্তি পেতেন। খাওয়া হয়ে গেলে পকেট থেকে একটা খাতা বের করতেন এবং বাবাকে তাঁর টাটকা টাটকা লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন। চিত্তরঞ্জনের মন তখনও পলিটিক্সে যায়নি। কোন্ কবিতার কি রকম অদল বদল করলে ভালো হয়, বাবা বলে দিতেন, দাশ সাহেব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতেন। “কাজেই আমরা জানতে পারছি কবিতা লিখেই তিনি সন্তুষ্ট হ’তেন না। স্বয়ং উপস্থিত থেকে কবি রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটি কী পরিবর্তন করলে আরো উৎকৃষ্ট হতে পারে , তার জন্য পরামর্শও প্রার্থনা করতেন। এবারে চিত্তরঞ্জন কবিতা লেখার কারণে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে যে শাস্তি ভোগ করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে আসি। সালটা ১৮৯৭। চিত্তরঞ্জনের বয়স তখন ২৬-২৭ বছর প্রায়।


লন্ডন থেকে দেশে ফেরা প্রায় বছর চারেক হয়েছে। পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী আই.সি.এস হবেন বলে ইউরোপ যাত্রা ছিল তাঁর। এটা সেই সময় সমাজের ‘এলিট বাঙালির’ একটি অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেখানে ১৮৯২ এবং ১৮৯৩ সালে দু’বার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হলেন। অবশেষে ‘মিডল টেম্পল’ থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরলেন ১৮৯৩ সালের শেষের দিকে। ওখানে থেকে ফিরলেন রাজনীতির স্বাদ প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করে। এখানে ফেরার চার বছর পর তাঁর বিয়ের বিষয়ে কথাবার্তা চালাচালি শুরু হল। তখন তিনি দেউলিয়া পিতার দেউলিয়া সন্তান। কোর্টে যান ঠিকই কিন্তু অর্থ রোজগারের কোন খবর থাকে না। কাজেই নিজের তথা বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই সুখকর ছিল না সেই সময়টিতে। এছাড়া ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হয়েও যথেষ্ট পরিমাণে ব্রাহ্ম তিনি নন (অনেকটা মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো যথেষ্ট খ্রিস্টান না হওয়া।) কিছু আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর দুটি কবিতা– ঈশ্বর, বারবিলাসিনী। দুটি কবিতাই ‘মালঞ্চ’ তে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতা দুটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল এবং তৎকালীন সমাজ এগুলিকে ভালো চোখে দেখেনি (তাঁর লেখা আরও একটি কবিতা ‘সোহম’ এর বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ উঠেছিল।)

এদিকে বিয়ের পাত্রী তো নির্দিষ্ট করেছেন দুই পরিবারের অভিভাবকগণ মিলিতভাবে। পাত্রীর নাম বাসন্তী হালদার; পিতা বরদানাথ হালদার। তাঁর বড় মেয়ে বাসন্তী। চিত্তরঞ্জনের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহনের বিশেষ বন্ধু ছিলেন এই বরদানাথ হালদার। দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল সেই বরিশালে বসবাসের কাল থেকেই। বরদানাথ যথেষ্ট নামি তথা ধনী ব্যক্তি ছিলেন। আসামের বিজনি স্টেটের দেওয়ান ছিলেন তিনি; ব্রাহ্ম পরিবার। এই বিয়েতে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রবল আপত্তি উঠল। তাঁরা বললেন যে, আরে ছেলে তো নেশা করে, অশ্লীল কবিতা লেখে আবার নাস্তিকও। সংসারের অবস্থাও একদমই ভালো নয়। তিন বছর থেকে চেষ্টা চালিয়েও কলকাতা হাইকোর্টে এখন একজন অসফল ব্যারিস্টার হিসেবে খ্যাত। এই ঘরে বরদানাথ হালদার কেন কন্যা দান করবেন? শেষে এই রায় দিলো ব্রাহ্মসমাজ যে, এ বিয়ে হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জনের কন্যার লেখা স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন “কন্যাদানের সংকল্প যখন ব্রাহ্মসমাজ জানতে পারলো তখন তুমুল কলরব পড়ে গেল। বরদানাথ কি পাগল? যাদের ঘরে খাবার সংস্থান নেই, যে ছেলে ঈশ্বরের বিদ্রোহী, নাস্তিক, মাতাল, তার হাতে পড়বে কি না ধনী কন্যা সোনার পুতুলি বাসন্তী? এ কিছুতেই হবে না, হতে পারে না, অসম্ভব।

বাবা ঈশ্বর বিদ্রোহী ও মাতাল আখ্যা এই সমাজ থেকে পেয়েছিলেন তাঁর ‘মালঞ্চে’ প্রকাশিত ঈশ্বর ও বারবিলাশিনী কবিতার জন্য। “সেকালে ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় যাঁরা যেমন, শিবনাথ শাস্ত্রী, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, উমেশ চন্দ্র দত্ত প্রমুখ একযোগে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁরা এই বিয়ে অনুমোদন করছেন না; কাজেই সমাজের কেউ এ বিয়েতে পৌরোহিত্যও করবেন না। ইতোমধ্যে কৃষ্ণকুমার মিত্রর পত্রিকা ‘সঞ্জীবনী’তেও এই বিয়ে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে অনেক অনুরোধ করার পর পৌরহিত্যে রাজি হলেন নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। ইনি রাজা রামমোহনের জীবনীকার।

তবে এর আগে তিনি মালঞ্চর কবিতা দুটি পড়লেন এবং দেখলেন সেখানে ‘প্রার্থনা’র মত কবিতাও চিত্তরঞ্জন লিখেছেন। অবশেষে একটি শর্ত তিনি আরোপ করলেন এই যে, চিত্তরঞ্জনকে একটি মুচলেকা লিখে দিতে হবে, যেখানে লেখা থাকবে ‘আমি হিন্দু নই’। এছাড়াও লিখতে হয়েছিল যে, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। এই ঘটনার জন্য মানসিক যন্ত্রণা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আজীবন ভোগ করেছিলেন। যাই হোক, বিয়েতে ব্রাহ্মরা কেউই আসেননি; এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। যদিও অনেক বছর পর চিত্তরঞ্জন কন্যা অপর্ণার বিয়েতে কবি রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এবং ততদিনে কলকাতার নামি ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ দেশবন্ধু হয়ে উঠেছেন ; হয়ে উঠেছেন কলকাতা তথা দেশের এক নামি তথা প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

এবার জীবনানন্দ দাশ এর কথা। জীবনানন্দ দাশ হলেন রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের একজন বিশিষ্টতম কবি। রবীন্দ্রনাথের সমসময়েই তিনি তৈরি করেছিলেন এক অন্য ধারার কবিতা। তাঁর সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “তিনি বাংলা কাব্যের ঐতিহ্য স্রোতের মধ্যে একটি মায়াবী দ্বীপের মতো উজ্জ্বল।” দেশভাগের কারণেই তিনি পূর্ব বাংলার বরিশাল ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাত্র ৫৬ বছরের জীবন। তাঁর কবিতা ছিল তার আজীবনের সাধনা। আজও তাঁর পাঠক দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন অজস্র সংখ্যায়। জীবনানন্দের জন্ম ১৭ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সাল। ওই বছরই জন্মগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। জীবনানন্দের পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ এবং মায়ের নাম কুসুমকুমারী দেবী। ইনি ও কবিতা রচনা করেছেন এবং কবিতা লিখতে পুত্রকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের পরিবারের সকলেই প্রায় শিক্ষক ছিলেন। লাজুক এবং স্বল্পবাক্ চরিত্রের মানুষ ছিলেন কবি জীবনানন্দ।

কলকাতায় এসে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয় নিয়ে বি. এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ পাস করেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় পরিবারের স্বচ্ছলতা ছিল না। সামান্য কিছু রোজগারের জন্য টিউশনিও তাঁকে করতে হয়েছিল। এত কিছুর মধ্যেও লেখার অভ্যাস তিনি বন্ধ করেননি। কবিতা ছাড়াও রচনা করেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং উপন্যাস। সমস্ত কিছুই তাঁর সযত্নে রক্ষিত ছিল গোপনে। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পর সে সমস্ত প্রকাশিত হয়েছে। আজও তাই তাঁকে অনুসন্ধানের শেষ নেই। ১৯২২ সালে জীবনানন্দ সিটি কলেজে অস্থায়ী শিক্ষক রূপে যোগদান করলেন। ১৯২৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরা পালক”প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ প্রকাশের সাথে সাথেই তা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁর কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ প্রচলিত পথের অনুসারী নয়। সকলেই যে মুগ্ধ হলেন তা নয়, কেউ কেউ তির্যক দৃষ্টিও হানলেন। তাঁরা কাব্যগ্রন্থটির একটি বিশেষ কবিতাতে অশ্লীলতার গন্ধ আবিষ্কার করলেন। তাঁদের মনে হল, বাংলা সাহিত্যে এরকম দূষণ চলতে দেওয়া যায় না। কাজেই নীতিবাদী কিছু মানুষ কবিতার অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে না পারায় সমালোচনা বেড়ে গেল। আড়ালে আবডালে ফিসফাস কালচার শুরু হয়ে গেল। কলেজ কর্তৃপক্ষের কানেও এ সমস্ত কথা পৌঁছেগেল। এমন মুহূর্তে কলেজে সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। ১৯২৮ সালের ২৭ জানুয়ারি কলেজের রামমোহন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করে ফেলল।

এর আগে ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত ও প্রতিষ্ঠিত কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি সভা ডাকেন। ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ। হিন্দুদের পক্ষে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ সেন, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ৫০ বছরের ঐতিহ্যশালী এই কলেজে ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম যেমন চলছে সেই রকমই চলুক। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্ম বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এত নীচে কি করে নামলেন আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম”। অবশেষে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত।

যদিও এই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি এবং হিন্দু ছাত্ররা কলেজ ত্যাগ করতে শুরু করে। ছাত্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেলে কর্তৃপক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা কমাতে বাধ্য হন এবং ১১ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। এই বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী শিক্ষক জীবনানন্দ দাশ পড়ে যান। কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র জীবনানন্দের পিতাকে একটি পত্র দেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন যে, আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেওয়া হবে। কিন্তু জীবনানন্দের ভাগ্যে আর সেই দিনটি ফিরে আসেনি। অনেকেই মনে করেন কলেজের অর্থনৈতিক অসুবিধার কথাটি ঠিক নয়। জীবনানন্দকে কলেজের থেকে সরিয়ে দেওয়ার আসল কারণটি ছিল অশ্লীল কবিতা রচনা। যে কবিতাটির কথা বলা হয় সেটির নাম “ক্যাম্পে”। ধারণাটি দৃঢ় হয় বুদ্ধদেব বসুর একটি লেখায়। তিনি লিখেছিলেন, “আমার যতদূর মনে পড়ে আমি জীবনানন্দের মুখেই শুনেছিলাম যে, ‘ঘাই হরিণী’ লেখার জন্য তিনি তার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মহাশয় এর দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিলেন (চরম চিকিৎসা, কবিতার শত্রু; মিত্র- বুদ্ধদেব বসু, এম সি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা ,আগস্ট ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৭৪ )। জীবনানন্দের প্রিয়তম ঋতু ছিল হেমন্ত। ওই হেমন্ত ঋতুরই একরাত্রে বাইশে অক্টোবর ১৯৫৪ তিনি বুকভরা বেদনা নিয়ে চলে গিয়েছেন। প্রসঙ্গত চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর জীবনানন্দ একটি কবিতা লিখেছিলেন এবং সেটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ গ্রন্থে সংযুক্ত করেন।

তথ্যসূত্র:- ১] কোরক, সাহিত্য পত্রিকা, প্রাক্ – শারদ সংখ্যা , ২০২৪, পৃষ্ঠা- ৭৫২ ] দেশ , ২ জুলাই-২০২৪৩] বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস