স্বপনকুমার মণ্ডল
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বইমেলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন দেহের সব রক্ত মুখে চলে এলে তা কখনওই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ হতে পারে না। কবি জীবিতকালেই সেই বইমেলা কলকাতা ছেড়ে রাজ্যের জেলা থেকে ব্লকে, শহর থেকে শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিক থেকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি প্রয়াসেও বইমেলার পরিসর যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তার সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। বিশ্বভারতীকে বাদ দিলে সুদীর্ঘকাল কলকাতাই উচ্চশিক্ষার অবিকল্প শিক্ষাতীর্থের আলোতে সমীহ আদায় করেছে। স্বাধীনতালাভের পরে পাঁচ-ছয়ের দশকে যে-কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তার অর্ধেকই কলকাতার সান্নিধ্যে স্থাপিত হয়। সেদিক থেকে কলকাতার শিক্ষা-সংস্কৃতির বনেদি আলোতে রাজ্যের প্রান্তিক জেলাগুলির ব্রাত্য পরিসর আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
সেখানে রাজধানীর গরিমার আলোয় রাজ্যের সুদূর ব্যবধানও আলোকিত হয়ে পড়ে। অথচ সেই আলোর অভাববোধ জনমানসে নিবিড় হয়ে তীব্রতা লাভ করেনি। সেই প্রত্যাশার তীব্রতাকে যেমন আবেদনমুখরতায় সক্রিয় রাখা সম্ভব হয়নি, তেমনই তা সময়ান্তরে উদাসীনতায় বিমুখ করে তুলেছে। অন্যদিকে দেশের মানোন্নয়নেই শুধু নয়, দেশের পরিচয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য, সভ্যতাগর্বী আধুনিকতায় তার বহুমুখী আবেদনক্ষম প্রকৃতিতেই তা প্রতীয়মান। এ সম্পর্কে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহুরু বলেছেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।‘ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুবচনের মাত্রাই সীমায়ত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে, তার ভালোমন্দের প্রশ্ন আপনাতেই আপেক্ষিক হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৬-তে ইউজিসি-তে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ২০১৮-র জুলাই-তে সেই সংখ্যা ৯০০-তে পৌঁছায়। সেই ১৯৫৬-র ১ নভেম্বর বিহারের মানভূমের দেহবিচ্ছিন্ন করে পুরুলিয়া নাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ যে জেলাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তার দেহে ছিল বিচ্ছেদের ক্ষত, মনে দীর্ঘ আন্দোলনের গরিমা, আত্মায় নতুন প্রাণের পরশ। সময়ান্তরে ক্ষত শুকিয়ে যায়, গরিমাবোধে শিথিলতা চলে আসে আর নতুন প্রাণ অভ্যাসে আত্মগোপন করে।
শুধু নাই নয়, তার বাংলাভাষাকে নিয়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন দেশের মধ্যে প্রথম হওয়া সত্বেও স্বদেশেই ব্রাত্য হয়ে পড়ে। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবাংলার এই জেলাটির প্রান্তিকায়নের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়ে পড়ে। সেখানে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে স্থানিক দূরত্বের পরিসর স্বাভাবিকভাবেই উপেক্ষার আধারকে আরও তীব্র করে তোলে। ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুমপাড়ানো গেলেও তার স্বপ্নকে বিতাড়ন করা যায় না, সদিচ্ছাও জেগে থাকে। সেই স্বপ্নই সদিচ্ছার মাধ্যমে ২০১০-এর ৬ জুলাই জেলার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়।
অহ্ল্যাভূমিতে নবপ্রাণের পরশ ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার নেতিবাচকতা নিয়ে চর্চার পরিসর সুদূরপ্রসারী। তার কৃত্তিমতা নিয়ে সবাক্মূর্তি নানা রূপেই সামনে এসে যায়। অবশ্য তা স্থায়ী হতে পারে না। ভলতের রুশোর ‘প্রকৃতিতে প্রত্যার্তন’-এ যে সাড়া দেওয়া সম্ভব নয়, তা তাঁর সেসময়ে আর চার পায়ে হাঁটতে না-পারার রসিকতাতেই সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শিক্ষায় কীভাবে নীতিহীনতা গ্রাস করে, তার পরিচয় দিতে রুশো যে ‘Emile’ উপন্যাস রচনা করেছেন, তাতেই বরং আধুনিক জীবনে শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকাকে পরোক্ষে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কেননা অগ্রসরগামী মানবসভ্যতায় শুধু টিকে থাকাই নয়, সভ্যতাকে প্রাগ্রসর করতে হলেও উন্নত শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার অভিমুখই মানবিক। সেই মানবিক অস্তিত্বে মানবসম্পদের শ্রীবৃদ্ধিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেই শিক্ষার উচ্চ সোপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী মানবকল্যাণের হাতছানি জেলার শিক্ষাশোভন পরিসরে তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে স্থানিক দূরত্ব মানসিক দূরত্বকে সক্রিয় করে তোলে। সেদিক থেকে যে হারে জেলার উচ্চশিক্ষায় শ্রীবৃদ্ধির কথা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দারিদ্র্যপীড়িত জেলাটিতে অসংখ্য কৃতী ছাত্রছাত্রী ফুল হয়ে ফোটার আগেই কলিতেই ঝরে যায়। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনের আয়োজনে যখন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন ঘটেছে, তখন তা আপন আভিজাত্যবোধেই আবির্ভাবে পরিণত হয়েছে। ক্ষুধায় পীড়িত অবসন্ন মনে শুধু সুখাদ্যের আঘ্রাণ নতুন করে রসনাকে সক্রিয় করে তোলে না, মননকেও সরসতায় বৈচিত্র্যস্বাদী করে তোলে। জেলার টুসু-ভাদু-ঝুমুর-নাচনী-ছো-এর বনেদি লোকসংস্কৃতি আধুনিক শিক্ষাশোভন নাগরিক সংস্কৃতির আলোতে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার অবকাশ পেল। শুধু তাই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির সোপানে তার অস্তিত্ব যেমন সুরক্ষা লাভ করে, তেমনই তার বিস্তার সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে প্রথাগত উচ্চশিক্ষার সোপানে গবেষণার উন্মুক্ত দ্বারে তার আন্তর্জাতিক বিস্তার শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। শিক্ষার স্বাধিকার, আত্মসম্মান, আত্মপ্রতিষ্ঠার ত্রিবেণী সঙ্গমের বৃহত্তম প্রয়াগক্ষেত্র হল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠাই প্রশস্ত করে না, আত্মিক প্রতিষ্ঠাও সুগম করে তোলে। অস্তিত্বের সোপানেI am থেকে I know-এর পরিসর বিশ্ববিদ্যালয়ে চূড়ান্তরূপেI express-কে পরিণত ও ত্বরান্বিত করে।
আর সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষমুখর প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যাচর্চার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। সেখানে বিদ্যার তাপ নয়, তার আলোর দিকে তার সতৃষ্ণ দৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা হয়, তৃষ্ণার্ত ঘোড়াকে কুয়োর ধারে নিয়ে আসা যেখানে ঘোড়াটি জল দেখতে পেয়ে আরও তৃষ্ণার্ত হলেও জলস্পর্শ করতে পারে না। সেদিক থেকে ক্ষুধাকে বাড়িয়ে তোলার স্বার্থকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন আভিজাত্য লাভ করে। কলা-বাণিজ্য ও বিজ্ঞান নিয়ে পনেরোটি বিভাগ নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সময়ান্তরে আরও তিনটি বিভাগ চালু হয়েছে। সেই ধারা উচ্চ শিক্ষার চাহিদায় ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। বর্তমানে (সেপ্টেম্বর ২০২৪) তার সাতাশটি (কলায় ১৪টি, বিজ্ঞানে ১০টি ও বাণিজ্যে ৩টি) বিভাগ রয়েছে।
এছাড়া ছো, ঝুমুর, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ও ওমেন স্টাডিজ-এর উপরে ডিপ্লোমা কোর্সও সুনামের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। সময়ের চাহিদা ও সমাজের প্রয়োজনে আরও নটি কোর্স শুরু হয়েছে। চলছে নিত্যনতুন বিষয়ের সংযোজনের অভিজাত ভাবনা ও জেলার ঐতিহ্যকে সুরক্ষা প্রদানের নানা আয়োজন। সেদিক থেকে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে তার আয়োজন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি, বরং তীব্র গতিতে মননের দীপ্তিতে দিগন্তবিস্তারি আলোর পরশ প্রদানে তার অভিমুখ সক্রিয় রয়েছে। সেখানে ‘আপন হতে বাহির’র হওয়ার আমন্ত্রণে ‘উপেক্ষিত’ জেলাটি যেমন সাড়া দিয়ে চলেছে, তেমনই ‘সীমার মাঝে অসীম’-এর হাতছানিতে তার সাদর আহ্বান ছড়িয়ে পড়ছে। অবশ্য এজন্য তার বিশ্ববিদ্যালয়টির হাতছানিকে সর্বাথেই আন্তরিকতার অকৃত্রিমতায় ধরে রাখা একান্ত কাম্য। তার সৌরভের বিস্তার তো অকৃত্রিমতার পরশেই। ইলেকট্রিক বা ইলেকট্রনিকের আলোর রোশনাই মনোহারি হলেও প্রদীপ বা মোমবাতির আলোর মতো অসংখ্য আলোর বিস্তারের ক্ষমতা তার নেই। অপরের সংগুপ্ত প্রতিভার আলোর প্রকাশেই যে বিশ্ববিদ্যালয় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে!