স্বপনকুমার মণ্ডল
স্কুলজীবনে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী’ একথা আকছার শোনা যায়৷ লক্ষ্য যে একটা থাকতেই হবে, শুধু তাই নয়, তা বেশ একটু বড়সড় ধরনের, হতে না পারলেও ক্ষতি নেই, তবে থাকাটা দস্তুর৷ ছোটবেলা থেকেই বড় হওয়ার বাতিক শিক্ষার আঙিনায় শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে৷ সেখানে তার ফুলে-ফলে বিস্তৃতির অবকাশ যেমন কচিমনে আকাশ হয়ে ওঠে, তেমনই তার প্রকাশে থাকে আভিজাত্যের হাতছানি৷ এজন্য হওয়ার সাধ এবং সাধ্যের সন্ধি হোক বা না-হোক, হতে চাওয়ার মধ্যে আকাশকুসুমেও কেউ অখুশি হয় না, বরং তার চাহিদাবোধেই লোকে মনের উৎকর্ষ খোঁজে৷ শুধু তাই নয়, সেখানে ইচ্ছেপূরণের গল্পে রূপকথা ভর করলেও লোকে অবিশ্বাসের হাসি হাসে না, বরং সাধ ও স্বপ্নের মধ্যে মনের আকাশ ও বুদ্ধির প্রকাশে জীবনের উত্তরণের ছবি মিলিয়ে দেখার সদিচ্ছায় সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ গতানুগতিক ইচ্ছের বাইরে কেউ যদি স্বামী বিবেকানন্দের মতো ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান হতে চায়, তার প্রতিও অবজ্ঞা বা উপেক্ষা আসে না, উল্টে তার মধ্যে ভবিষ্যতের চালককে মনের রঙে রঙিন করে তোলে৷ সেদিক থেকে জীবনের লক্ষ্যেই ইচ্ছেপূরণের গল্পকে রূপকথা মনে হয়৷ জীবনের মধ্যে যে রূপকথার নিবিড় হাতছানি৷ হতে চাওয়ার লক্ষ্যে তার আগাম পরিচয় স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের নিজের রাজ্যের রাজা হওয়ার বাসনায় বুদ্ধির দৌড় প্রতিযোগিতা অনিবার্য হয়ে ওঠে৷ সেখানে ‘কী হতে চাও’ থেকে ‘কেন হতে চাও’-এর মতো প্রশ্নের আগমন ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরের আয়োজন স্বাভাবিকতা লাভ করে৷ অর্থ, নাম-যশ-খ্যাতি থেকে প্রতিষ্ঠার ছকবন্দি লক্ষ্যের মধ্যে ব্যতিক্রমী পরিচয় সেভাবে লক্ষ করা যায় না৷ সকলের মধ্যেই প্রায় গতানুগতিক ছকবন্দি জীবনের লক্ষ্য আবর্তিত হয়৷ তাতে ধনে-মানে বড় হওয়ার লক্ষ্যেও থাকে অসামান্য বা অসাধারণ হওয়ার বাতিক৷
স্বাভাবিক ভাবেই তাতে ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’-এর প্রশ্নটি অভ্যাসের বশে ছোট হয়ে গেলেও তার উত্তরটা আমাদের নিত্য উৎসুক করে তোলে৷ সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক মহাশয়ের কাছে শিক্ষার্থীর বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয়ে সেই অজানা উত্তরও স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে৷ অথচ সেই উত্তর যে শুধু ব্যতিক্রমী নয়, রীতিমতো অস্বাভাবিক ভাবনার খোরাক হতে পারে, তার পরিচয় সম্প্রতি গণমাধ্যমের একটি সংবাদে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ এপ্রিল ফুলের আয়োজনের আগেই সেই ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে৷ বীরভূমের লাভপুরের শীতলাগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ঋক বাগদি ক্লাসের মধ্যে তাঁর স্যারের প্রশ্নের উত্তরে যখন সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষক-ডাক্তার থেকে উচ্চ পদের পেশার লক্ষ্যের কথা বলে বুদ্ধির আলোতে শ্রীবৃদ্ধির কথা বলেছে, তখনই সে ‘বড় হয়ে বোকা হতে চাই’ বলে সবাইকে অবাক করে দেয়৷ ঋকের শিক্ষক রিপনকান্তি বালার এতক্ষণ ধরে মোবাইলের ক্যামেরাও থেমে যায়, ‘বোকা হতে চাই’-এর ‘কেন’ উত্তরে উদগ্রীব হয়ে ওঠে৷ সেখানে বোকা হয়ে থাকলে অন্যরা তাকে ঠকিয়ে নেওয়ার কথা বলেও শিক্ষক তাঁর ছাত্রটিকে নিরস্ত করতে পারেননি৷ ঋক অকপটে জানায়, সে তো কাউকে ঠকাবে না৷ এহেন বিস্ময়কর উত্তর সমৃদ্ধ ভিডিওটি শিক্ষক মহাশয় সমাজ মাধ্যমে আপলোড করে দেওয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, সংবাদ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে৷
যেখানে এআই(AI) তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবে চিন্তিত বিশ্ব, সেখানে আপাতভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেই বোকা হওয়ার সদিচ্ছা বড় গোলমেলে মনে হয়৷ লোকে যেখানে বুদ্ধিমান প্রমাণ করার জন্য মরীয়া, সেখানে কেউ যেচে বোকা সাজতে চাওয়ার মধ্যেই চালাকির ছদ্মবেশ জেগে ওঠে৷ অথচ জীবনের লক্ষ্যেই কেউ যখন বোকা হতে চায় এবং নিজে ঠকলেও অন্যকে না ঠকানোর কথা বলে অকপটে, তখন তার বোকামি আমাদেরই বোকা করে তোলে৷ যেখানে বোকা বানানোর কৃতিত্বে আভিজাত্যের আলো চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে বোকা হওয়ার লক্ষ্য স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বিস্মিত করে৷ বোকা থেকে চালাকচতুর থেকে স্মার্ট হওয়ার ফন্দিফিকিরে আবর্তিত জীবনে ‘আগে অনেক বোকা ছিলাম’ গোছের কথা আপনগুণেই বেরিয়ে পড়ে৷ শুধু তাই নয়, ঠকানোর পারদর্শিতায় পরাজিত করে আভিজাত্য প্রকাশের আয়োজন সেই সভ্যতার বিকাশ থেকেই শুরু হয়েছে৷ পণ্ডিতে-পণ্ডিতে বুদ্ধির টক্কর থেকে বোকা-চালাকের গল্পের জয়পরাজয় সবেতেই ঠকানোর হর কিসিমের কায়দাকৌশল নানাভাবেই বহাল তবিয়তে৷ সেখানে বিদ্যাসাগরের নামে চলা পঙক্তিটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে ওঠে : ‘মনে রেখো জগৎটাতে সকলেই গরু, / যে যাকে ঠকাতে পারে, সেই তার গুরু৷ ‘ সেই ঠকিয়ে গুরু সাজার চল একালেও সচল৷ শুধু তাই নয়, এখন তা বিদু্যৎগতিতে শ্রীবৃদ্ধিমান৷ সেখানে ঠকানোর কৌশলে আত্মপ্রতিষ্ঠাতেও আমাদের মনে অপরাধবোধ জাগে না, বরং তাকে বুদ্ধিমানের পুরস্কার মনে করে লোকে৷ শুধু তাই নয়, বোকাকে ঠকানোর অধিকারে প্রতারকের মুন্সিয়ানার মধ্যে অনেকে অসাধারণ প্রতিভা খুঁজে পায়৷ অন্যদিকে বিদ্যাসাগরের সমকালেই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যোগ করতে পারলেও বিয়োগ করতে না পারার কথা বলে বিস্মিত করেছিলেন৷ কামনাবাসনাময় জীবনে ধনসম্পদ নয়, সবচেয়ে জরুরি মনসম্পদ৷ সেক্ষেত্রে কল্পতরু হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণর ‘চৈতন্য হোক’ আশীর্বাদী চেতাবনি আজও আমাদের পাথেয়৷ সেদিক থেকে পাড়াগাঁয়ের একজন দিনমজুরের ছেলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বোকা হতে চায় শুনে বিস্মিত হওয়াই স্বাভাবিক৷ বোকা বানানোর কৃতিত্বের দিন উদযাপনে আগে একজন অন্তত সচেতন বোকার পরিচয় পেয়ে এপ্রিল ফুল ফুটেছে কিনা জানি না, কিছুটা হলেও যে আমাদের মনের আলো ফুটেছে, সংবাদ মাধ্যমের চর্চাতেই তা প্রতীয়মান৷
আসলে আমাদের চেতনায় ‘বোকা’ শব্দের অর্থ নিয়ে বোকামির অন্ত নেই৷ যে ঠকে সে বোকা নয়৷ আবার যে ঠকায় সে চালাক বা বুদ্ধিমানও প্রমাণ করে না৷ সে আসলে প্রতারক৷ ঠকার মূলে থাকে গভীর বিশ্বাস আর অজ্ঞতা৷ সেই অজ্ঞতার সুযোগে একে অন্যের বিশ্বাসকে হত্যা করে৷ সেক্ষেত্রে ঠক আবার বিশ্বাসঘাতকও৷ অন্যদিকে ঠকও বুঝতেই চায় না যে ঠকেছে সে সব জেনে যাবে অচিরেই৷ সেখানে সেও অজ্ঞতার শিকারে মস্ত বড় বোকা৷ আবার যে ঠকে সে ক্রমশ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সচেতন হয়ে ওঠে৷ অন্যদিকে যে ঠকায়, সে লোভের বশে আরও বেশি লোভী হয়ে ওঠে, জনমানসে অবিশ্বাসীর ছায়ায় নিজেকে নিঃস্ব করে তোলে৷ সেখানে হারিয়ে যাওয়ার ভয় ওৎ পেতে থাকে৷ ঠকানোর মূলেও থাকে লোভ৷ অতৃপ্ত কামনাবাসনাকে সঙ্গী করে লোভীর দৌরাত্ম্য ক্রমশ বেড়েই চলে৷ সেখানে আধুনিক শিক্ষা আমাদের ক্ষুধা বা চাহিদাকে বাড়িয়ে তোলে, লোভকে দুঃসাহসী করে৷ সেই শিক্ষা চাহিদা যত বাড়িয়েছে, যোগ্যতা তত বাড়েনি, জোগান ততই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ সেখানে ঠকানো বা প্রতারণার মাধ্যমে অতৃপ্ত চাহিদা বা বিকৃত কামনা বাসনা মেটানোর পরিসর বিস্তৃতি লাভ করে৷ যা ছিল ব্যক্তিগত পরিসরের প্রতারণা, তাই অচিরেই ষড়যন্ত্রকরে সংগঠিত অপরাধে পরিণত হয়৷ সেখানে বিদ্যাশিক্ষার নীতিআদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সংগঠিত দুর্নীতির শিকারে পরু্যদস্ত জনজীবনে আজ শুধু অবিশ্বাসী বাতাবরণ, জীবনকে নিঃস্ব করে তোমার আয়োজন৷ সেখানে শিকারীর দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যোগ্যরাই৷ কেননা তারা কখনও ষড়যন্ত্র করে না৷ ষড়যন্ত্রের মূলেই থাকে মনের দুর্বলতা, অযোগ্যতার বোধ৷ যে সবল, সে একাই লড়ে৷ যে দুর্বল, সেই ষড়যন্ত্রে ভিড়ে৷ সেখানে দুর্নীতির লাগামহীন চলনে ঠকানোর ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের আয়োজনে আমরা প্রত্যেকেই নানাভাবে শিকার অথবা শিকারী হয়ে উঠেছি, ভাবা যায়৷ দুর্নীতি শুধু অবৈধ কাজই করে না, শিক্ষার মূল্যবোধ থেকে শিক্ষিতের আত্মবিশ্বাস সর্বত্র তার ধ্বংসকামী শক্তির অবাধ বিচরণ৷ আর সেক্ষেত্রেই তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ঋক বাগদি যেভাবে বড় হয়ে বোকা হতে চেয়েছে, তা আমাদের মূল্যবোধকেই সজোরে আঘাত করে৷ সে অন্তত নিজে ঠকলেও কাউকে না ঠকানো বোকা হতে চেয়েছে৷ সেই তো আসল শিক্ষার আলোর পরশ পেয়েছে৷ বিদ্যাশিক্ষা যে মানুষকে জেতানোর মন্ত্র শেখায়৷ ঋক সেই মন্ত্র শুদ্ধতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছে৷ এ যে আমাদের অনেক বড় প্রাপ্তি, অনেক বড় মনের কথা!