অপূর্ব কুমার চট্টোপাধ্যায়
‘লাইব্রেরি’ শব্দটি যে ল্যাটিন ভাষা থেকে আগত শব্দ, সেটি আগে জেনে নিই। এটি ল্যাটিন ‘লিবার’, ‘বই’ থেকে উদ্ভূত শব্দ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিসে প্রথম ব্যক্তিগত লাইব্রেরির জন্ম হয়; আর ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় কনস্টান্টিনোপল এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় বিশ্বের মহান গ্রন্থাগার জন্ম নেয়। প্রায় ২০০ বছর আগে ইউরোপের ইতিহাসে প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি তৈরির জন্য রোমান সাল অ্যাসিনিয়াস পোলিওকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে প্রাইভেট লাইব্রেরি এর অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। ভারতে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক বলা হয় ডক্টর এস আর রঙ্গনাথন কে (৯ .৮ .১৮৯২-২৭ .৯. ১৯৭২) এবং ১৮৯২ সালে ত্রিবান্দ্রম পাবলিক লাইব্রেরি ভারতের প্রথম প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি।
বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব যে, শিক্ষার প্রধান উপকরণ তিনটি। এই তিনটির একটিকেও বাদ দেওয়া যাবে না। ঐ প্রধান তিনটি উপকরণ হলো, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং বই। শিক্ষক যদি না থাকেন, তাহলে শিক্ষা দেবেন কে? তাই শিক্ষক বা গুরু থাকাটা অবশ্যই দরকার।গুরু কথাটির একটি সুন্দর অর্থ রয়েছে। ‘গু ‘ অর্থাৎ অন্ধকার আর’ রু ‘ অর্থাৎ প্রকাশ বা আলো। অর্থাৎ, অন্ধকার দূর করে যিনি আমাদের আলোর সন্ধান দেন, তিনি গুরু। ছাত্র অর্থাৎ শিষ্য । এদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; একজন অপরজনের নিত্য শুভার্থী। এ প্রসঙ্গে’ তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে একটি শ্লোক রয়েছে, যার বঙ্গার্থটি হ’ল , ” হে পরমাত্মন আপনি আমাদের দু’জনকে (গুরু ও ছাত্র) একসাথে সর্বপ্রকারে রক্ষা করুন। আপনি সমুচিতরূপে আমাদের পালন পোষণ করুন । আমরা যেন একসাথে শক্তি সঞ্চয় করি। আমাদের পঠিত বিদ্যা যেন তেজোপূর্ন হয়; কোথাও পরাস্ত না হই। আমরা যেন সর্বদা পরস্পর স্নেহসূত্রে আবদ্ধ থাকি এবং আমাদের মনে যেন কদাপি দ্বেষ না জন্মে।”
ছাত্র বা শিক্ষার্থী তারাই , যারা দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকে। তারা পাঠ্যবিষয় ছাড়া উত্তম বিচার, উত্তম ব্যবহার ও সততার শিক্ষা নেয়।
তৃতীয় বিষয়টি হল বই।’ পুস্তক’ শব্দটি তদ্ভব শব্দ। এর অপর নাম গ্রন্থ বা বই। এতে পাঠ্য বিষয়গুলি একত্রে গ্রথিত থাকে।
আমরা যদি আমাদের ধর্মপুস্তকগুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখি ‘কোরান’-এর সর্বপ্রথম বাণীটি হল, ” আল্লাম বিল কলমি”। অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন ‘কলমের মাধ্যমে’। আর আমরা তো জানি কলমের আশ্রয় হল পুস্তক বা গ্রন্থ । আবার , ‘বাইবেল’ শব্দটির অর্থ বই। বই- par excellence । সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক, দ্য বুক। অপরদিকে ‘বেদ’ কথাটির একটি অর্থ জ্ঞান। আমরা তাই তিনটি প্রধান ধর্মেই উল্লিখিত বিষয় হিসেবে একটি জিনিসই জানতে পারছি তা হল, কলম -বই- জ্ঞান অর্থাৎ গ্রন্থ সম্পর্কিত। এই গ্রন্থের আশ্রয় হল গ্রন্থালয় বা লাইব্রেরি। কাজেই লাইব্রেরি একটি মহান দান; ঈশ্বরের সর্বকালের ধর্মীয় ইতিহাসে।
এরপরে সুচারু শিক্ষা গ্রহণের জন্য আরো একটি বিষয় থাকা জরুরি; তা হল গ্রন্থাগার। লেখাপড়ায় যেমন প্রয়োজন বিদ্যালয়গৃহ, খেলার মাঠ, ঠিক তেমনি আধুনিক যুগে বিদ্যালয়ে একটি লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার থাকাটা আবশ্যকীয় বিষয়ের মধ্যেই গণ্য। যেকোনো বিদ্যালয় তখনই সম্পূর্ণরূপে শ্রীমণ্ডিত হয়ে ওঠে, যখন সকল কিছুর সাথেই সেখানে একটি সুন্দর লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বিদ্যমান থাকে । বর্তমান সময়ে তো ভাবাই যায় না , লাইব্রেরি বিহীন কোন বিদ্যালয় এর কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লাইব্রেরি প্রবন্ধে বলেছেন যে , (বিচিত্র প্রবন্ধ ) সমুদ্রের শতবর্ষের কল্লোলকে কেউ যদি এমনভাবে বেঁধে রাখতে পারে যে সে মহাঘুমে শিশুর মতো চুপ করে থাকবে; তবে তার সাথে অর্থাৎ ওই সমুদ্রের ওই ঘুমন্ত কল্লোলের সাথে লাইব্রেরির তুলনা চলতে পারে। হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে কতটা বন্যা বাঁধা আছে ,তা পরিমাপ করা যায় না। ঠিক তেমনি লাইব্রেরির মধ্যে কতশত জ্ঞানসমুদ্র নিদ্রিত অবস্থায় রয়েছে তা পরিমাপহীন।
কাজেই গ্রন্থাগার হলো সেই স্থান , যেখানে হাজার হাজার জ্ঞান সমুদ্র দুটি করে মলাটের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জ্ঞানপিপাসুদের অবগাহনের অপেক্ষায় স্থির হয়ে থাকে। আমার তো মনে হয় এই অপেক্ষা দুই তরফেই থাকে; জ্ঞান সন্ধানে ব্রতী ছাত্র সমাজ এবং ভান্ডার আগলে রাখা মলাটবন্দী গ্রন্থরাজি। কোন এক মনীষী বলেছেন যে, ক্ষুধার্ত মানুষ বই হাতে তুলে নাও; এইরকমই কোন কথা। এই ক্ষুধার্ত বলতে কাদের বলা হয়েছে তা , জ্ঞানীরা বোঝেন।
এবার গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির চরিত কথা নিয়ে কিছু বলি। সরকারি গ্রন্থাগার যে শুধুমাত্র বড় বড় শহরেই থাকে তেমনটি নয়; গ্রামে গঞ্জে বা গ্রাম্য স্কুলেও তা থাকে। এছাড়া পাড়া বা গ্রামের কিছু মানুষজন মিলেমিশে ক্লাবের মধ্যে বা ক্লাব সদস্যের গৃহেও গ্রন্থাগার খোলেন । এখানে বইয়ের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হতে পারে। পত্রপত্রিকা ছাড়া পাঠ্যবইও কিছু কিছু থাকতে পারে। সেখানে গ্রামবাসীগণ এখানে তাদের সময় মত এসে বই পড়েন ও বইপত্র আদান-প্রদান করেন। এতে পড়ার অভ্যাসটা অন্তত গড়ে ওঠে। অনভিপ্রেত কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারেন না ।
বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার গুলিতে বইমেলা থেকে বই কেনা হয়। অনেক সময় অভিভাবক বা শিক্ষকেরা স্কুলের গ্রন্থাগারে বই কিনে দেন একান্ত নিজস্ব আগ্রহে; এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণির রুটিনে গ্রন্থাগারের ক্লাস নির্দিষ্ট থাকে। সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা পছন্দমত বই সেখান থেকে নিতে পারে বা সেখানে বসে পড়তে পারে। কাজটি যাতে সুশৃংখলভাবে ঘটতে পারে সেজন্য সেখানে শিক্ষণ প্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক ও থাকেন। লাইব্রেরিতে নতুন বই কেনার সময় পাঠকের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
গ্রন্থাগারের নিস্তব্ধ পরিবেশে শান্তভাবে বই পাঠ করলে মনোযোগ ও একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে ; যা পরবর্তী জীবনে ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে লাগবে। শুধু নিজেরটুকুই নয়; অপরের সুবিধা-অসুবিধা বোঝার দায়িত্ব যে তাদের সেটাও তারা শিখবে ।অযথা সময়ের অপব্যবহার তারা বর্জন করবে। নিজেদের জ্ঞানকে সর্বদা ‘আপটু ডেট’ রাখতে শিখবে; জানার খিদে মেটাতে পারবে।
বিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনের জন্য নির্মিত প্রকল্পে সরকার তথা দেশবাসীর উচিত এই বিষয়টিকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া। শুধুমাত্র গ্রন্থাগার বিষয়ের দপ্তরে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেই হবে না; দেখতে হবে বিদ্যালয়ে তথা সরকার পোষিত গ্রন্থাগার গুলির মান যথাযথভাবে উন্নত হচ্ছে কিনা। সেখানে বই কেনার টাকা, কর্মী নিয়োগ, উপযুক্ত মানের যথাযথ বইপত্র নির্বাচন প্রভৃতি ঠিকমতো উপলব্ধ কিনা তা নজরে রাখতে হবে। যথাযথ শিক্ষাই একটি দেশকে বা একটি জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে দেয়। এই এগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি গ্রন্থাগারের হাত ধরেও হতে পারে।
যদি কোন স্কুলে বা সমাজে গ্রন্থাগারের অগ্রতুলতা থাকে, ঠিকমতো সাহায্যকারীর ভূমিকা পরস্পর বা সমাজ পালন না করে, তাহলে বুঝতে হবে শিক্ষা বিস্তারের পরিপন্থী সরকার বা সমাজ নয়। সেই সমাজের অধঃপতন বা ধ্বংসের বাতাবরণ সৃষ্টির কাজ চালু রয়েছে। কোন একজন মনীষী বলেছিলেন যে, কোন দেশকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহের প্রয়োজন পড়ে না; শুধু শিক্ষার আলোটুকু নিভিয়ে দিলেই তা সম্ভব ।
কাজেই সমাজের মানুষকে শিক্ষার ক্ষেত্রটি বুঝে নিতে হবে; তাদের অধিকার এবং সমৃদ্ধশালী সমাজ তথা দেশ পাবার জন্য নিজেদের কি করণীয় বা কর্তব্য সেইটুকু।
গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে কিছুতেই অস্বীকার করা বা ছোট করে দেখার প্রবণতা যেন আমাদের মনে কখনো না জন্মায়।