ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত সমাজ-মঞ্চে প্রথম বাংলা ভাষণ

তৎকালীন কলকাতার কথা আমরা বিভিন্ন ধরণের মানুষের লেখায় পেয়ে থাকি। এই লেখাগুলি আমাদেরকে কোনও স্থানের অপেক্ষা সেই সমাজে চলতি হওয়ার কথায় জানান দেয় বেশি করে। এই প্রসঙ্গে একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ তথা বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল এর বক্তব্য শোনায়; তিনি লিখেছিলেন, “লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য – সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও কাজই বাঙ্গালায় হয় না। বিদ্যালোচনা ইংরাজিতে। সাধারণ কার্য, মিটিং, লেকচার, এড্রেস, প্রোসিডিংস সমুদায় ইংরাজিতে।” কথা ক’টি বলেছিলেন আপন অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্য সম্রাট তথা বন্দেমাতরম্ মন্ত্রের উদ্গাতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজ রাজত্ব; কাজেই তাঁদের খুশি করা বা তাঁদের সুনজরে থাকার একটা সুপ্ত ইচ্ছে মানুষের মনে বাসা বেঁধে থাকতে পারে। আমরা বিভিন্ন নাটক – থিয়েটার- সিনেমায় দেখেছি যে, কোন একজন মজাদার মানুষ হাস্যকৌতুকের জন্য ইংরেজ সাহেবের সাথে খিচুড়ি ভাষা যোগ করে ইংরেজি বলছে। সেই ভাষাই থাকতো বাংলায় বেশি তবে দু-একটি ইংরেজি শব্দ; শুনতে মজা লাগত। সেই মজার বিষয়টি অন্য আবরণে এখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বাংলার পুরো বাক্যটি প্রায় বলে একটি- দুটি ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করে নিজের শ্রেণি বোঝানোর চেষ্টা; যা সত্যি কৌতুক প্রদান করে। যাই হোক সেই সময়ের সমাজ সংস্কারে ভাষণ কেউই আপন মাতৃভাষা বাংলায় দিতে চাইতেন না। তাঁদের হয়তো মনে হতো যে এতে আপন শ্রেণি বোঝানো যাবে না; তিনি যে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা গোত্রের। সেটা বোঝানোর প্রয়োজনীয়তা তাঁদের কাছে অনেক বেশি ছিল।

সভা মঞ্চে এই বাংলা ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার আগমন ঘটেছিল একজন শিক্ষকের হাত ধরে; তাঁর নাম অক্ষয়কুমার দত্ত। তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক, গ্রন্থপ্রণেতা, তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার প্রধান শিক্ষক, বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত নরমাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতামহ। তার সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। যদিও বিদ্যাসাগর বয়সে আড়াই মাসের মতো ছোট ছিলেন, বন্ধু অক্ষয় কুমার এর চেয়ে। প্রচন্ড দারিদ্রের মধ্যে দু’জনেই বেড়ে উঠেছিলেন। অজ গ্রাম থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদে দু’জনেই কলকাতা শহরে এসে ও থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। নিয়ম করে দু’জনেই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সমাজ সচেতন হয়ে সমাজে শিক্ষার আলো জ্বেলে ছিলেন। দু’জনে শিক্ষা জগতের পাদপীঠে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করেছিলেন। একজন শিশু শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে বাংলা বর্ণ সংস্কার তথা তাদের উপযুক্ত গ্রন্থ রচনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ সহ আরো অনেক সমাজ সংস্কারমুখী কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর অপরজন বিজ্ঞান, ভূগোল, প্রভৃতি বিষয়ে উঁচু মানের বই লিখে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়তে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দু’জনের বই স্কুল পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলনে দু’জনেই অংশ নিয়েছিলেন; আপন আপন গণ্ডি মধ্যে থেকে। দু’জনেই অনুভব করেছিলেন যে শিক্ষার তৎকালীন পথ ছেড়ে সময়োপযোগী ধ্যান ধারণাকে আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষায় কোনরকম গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে বিদেশি শিক্ষা আরো গ্রহণ করতে হবে। শুধু থাকার মতো যেমনই হোক একটি আবাস আর ভর পেট দু’বেলা খাওয়াতেই মানুষের জীবন চলমান থাকে না। সেখানে শিক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান থাকা উচিত। কোন একজন মনীষী বলেছিলেন যে, কোন দেশ বা জাতিকে পরাজিত করার জন্য বা তার অস্তিত্ব সংকটে ফেলার জন্য সর্ব প্রথম তার শিক্ষা ব্যবস্থা বিনষ্টির প্রয়োজন। এই রকমটি করতে পারলে অস্ত্র ধারণ বা রক্তপাতের প্রয়োজন পড়ে না।

রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে তার ‘রাশিয়ার চিঠি’তে বলেছেন, ‘অ-শক্তকে শক্তি দেবার একটি মাত্র উপায় শিক্ষা— অন্ন, স্বাস্থ্য, শান্তি সমস্তই এরই ‘পরে নির্ভর করে।’ কাজেই শিক্ষা যে অমূল্য, সে কথা আমরা আজ সহজেই বুঝতে পারি।
প্রমথ চৌধুরীর তাঁর ‘আত্ম-কথা’য় লিখেছেন, ‘বাবা বাঙ্গালা বই পড়তেন না, কেননা তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি দেদার বই পড়তেন, কিন্তু সে- সবই ইংরেজী বই।’ বাংলা ভাষার এই নিষ্ফলা জমিতে মধুসূদন তো নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন তাঁর সাহিত্য সেবার উষাকালে। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বাংলা ভাষার ঘরে ফিরে আসেন। মধুসূদন তাঁর প্রথম ইংরেজি গ্রন্থ ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ (The Captive Ladie/ মূল্য ছিল দু ‘টাকা) ৫০ কপি বন্ধু গৌরদাস বসাক’কে বিক্রি করেছিলেন। কথা ছিল বইটির কিছু কপি সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষদের উপহার দেওয়া হবে। উপহার প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন রামতনু লাহিড়ী, রামচন্দ্র মিত্র (দুজনেই হিন্দু কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষক) বেথুন সাহেব (এ দেশে নারী শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন) প্রমুখ। বেথুন সাহেব গৌরদাস বসাক -এর মাধ্যমে মধুসূদনকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি রূঢ় জবাব দিয়েছিলেন (20 জুলাই, 1849)। তিনি পত্রে লিখেছিলেন, ” An ambitious young poet could not desire a finer field, for exertion than in taking the Lead in giving his countrymen in their own language a taste for something higher and better.”


সত্যিই তো! একজন মহাত্বাকাঙ্ক্ষী যুবক কবি নিজের দেশবাসীকে তাদেরই ভাষায় কিছু উচ্চ তথা মহৎশ্রেণির বস্তুর স্বাদ দিতে চাইলে নিজের ভাষাতেই দিতে পারে, অপরের ভাষাতে নয়।

এই ঘটনার প্রায় বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। ডেভিড হেয়ার মারা যান ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম দু’বছর স্মৃতিশ্রদ্ধা জানাতে যে স্মরণসভা হয়েছিল তাতে সকলেই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন; কারণ সেটি ছিল তখনকার প্রচলিত রীতি বা ধারা। বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেবার প্রথা তখনও চালুই হয়নি। বাংলা ভাষাতেও যে ভাষণ দেওয়া যেতে পারে এই সমস্ত অনুষ্ঠানে এতে দর্শককুলের ভরসা বা বিশ্বাস কোনোটিই জন্মায়নি। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ডেভিড হেয়ার’-এর তৃতীয় স্মরণ সভার আয়োজন করা হলে বক্তৃতা করার জন্য কমিটি অক্ষয় কুমার দত্ত-কে (তখন তিনি পঁচিশ বছরের নামি যুবক) আহ্বান জানালে অক্ষয় কুমার সোজা সাপটা মুখের উপর জানিয়ে দিলেন যে, তিনি ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করবেন না। যদি কমিটি তাঁকে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করার অনুমতি দেন, তবে তিনি তাঁদের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করতে পারেন। তাঁরা সম্মত হলেন তাঁর কথায়। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল সেই সময়কার কলকাতায় ফৌজদারি বালাখানা হলে ( Hall)। সেকালের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন কোন এক অসম্ভব- সম্ভব এর দোলায় আন্দোলিত হয়ে। দিনটি ছিল ১৮৪৫ সালের পয়লা জুন, রবিবার সন্ধ্যায়। অক্ষয় কুমার দত্তের বক্তৃতার শিরোনামটি ছিল ‘ ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম- স্মরণার্থ তৃতীয় সাম্বৎসরিক সভায় বক্তৃতা’। তিনি ঠিক করেছিলেন, ‘ডেভিড হেয়ারের শিক্ষার আদর্শ’ বিষয়ে বলবেন তাঁর বক্তৃতায়।। বক্তার মধ্যে আরো ছিলেন, ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকার সম্পাদক (১৮৫৯), হিন্দু কলেজের ছাত্র ও ডিরোজিও শিষ্য এবং প্যারীচাঁদ মিত্রর ছোট ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্র (১৮২২-১৮৭৩) যিনি একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। অক্ষয়কুমার দত্ত-র বক্তৃতার মধ্যে মূল কথাটি ছিল, “তিনি (ডেভিড হেয়ার) আমাদিগকে হীরক দেন নাই, স্বর্ণ দেন নাই, রজতও দান করেন নাই, কিন্তু তাহার অপেক্ষা সহস্রগুণ, কোটিগুণ মূল্যবান বিদ্যারত্ন প্রদান করিয়াছেন। তাঁহার চেষ্টা দ্বারা আমরা জ্ঞানের আস্বাদ- প্রাপ্ত হইয়াছি এবং তাহার চরিত্রের দৃষ্টান্ত দ্বারা দয়া ও সত্য ব্যবহার যে কি মহোপকারী, তাহা পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছি। পীড়িতের রোগ শান্তি, বিপদগ্রস্তের দুঃখ মোচন, অবিজ্ঞকে পরামর্শ দান, নিরশ্রয়কে আশ্রয় প্রদান ইত্যাদি হিতকার্য তাঁহার চরিত্রের ভূষণ ছিল।” অক্ষয় কুমার বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, জাতীয় জীবনের সমস্ত চিন্তা ও কর্মের মধ্যে মাতৃভাষাই হলো এক এবং একমাত্র শক্তি।

আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর আগে উপস্থাপন করা বাংলা ভাষায় বক্তৃতাটি সকলকেই মোহিত, চমকিত এবং চমৎকৃত করেছিল। সভার সভাপতি রামগোপাল ঘোষ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘Babu Akshaykumar Datta then rose to deliver a discourse , which was in Bengali language. The subject of it was the changes effected by the agency of Education in the Hindu mind.’ এককথায় সভাপতি অক্ষয়কুমারের বাংলায় করা বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। শেষে তিনি বলেন, “The Babu ( Akshaykumar) sat down amidst loud and enthusiastic cheers.” ( A Biographical Sketch of David Hare by peary chand Mittra)

‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত’ গ্রন্থ প্রণেতা যোগীন্দ্রনাথ বসু তাঁর গ্রন্থে লেখেন, ‘ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত সভা- সমিতির কার্য ইংরেজিতে নিষ্পন্ন হওয়া যেন অবশ্য কর্ত্তব্য বলিয়া পূর্বে অনেকের ধারণা ছিল; বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত সে সংস্কারেরও উচ্ছেদ করিয়াছিলেন।— ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তিদের সভায়, বোধ হয়, ইহার পূর্ব্বে কখনো বাঙ্গালা ভাষায় বক্তৃতা হয় নাই।’