বাংলায় সহ-শিক্ষার সেকাল

আজকাল শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্তর পর্যন্ত সহ-শিক্ষার প্রচলন রয়েছে। ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে শিক্ষক মহাশয়ের কাছে পাঠ নিচ্ছেন। এ নিয়ে কি ছেলেমেয়ে, কি শিক্ষক, কি পরিবার, কি সমাজ কারুরই কোন মাথা ব্যথা নাই। কিন্তু অতীতকালে সহ-শিক্ষা ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না। ছেলেরা ও মেয়েরা পৃথক পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ নিত। আবার ছেলেদের মত মেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিতে পারত না। কারণ মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন উচ্চশিক্ষা প্রদানের কোন ব্যবস্থা ছিল না। শুধুমাত্র ছেলেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা ছিল সংগ্রামের পথ বেয়ে বাংলায় প্রথম সহ-শিক্ষা চালু হয়।

তবে দীর্ঘকাল বঙ্গদেশে বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকার জন্য নারী শিক্ষা ব্যহত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে ছিল অন্ধ কুসংস্কার। নারী শিক্ষা বিস্তারে এদেশে প্রথম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। খ্রিস্টীয় সংঘের মহিলারা ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে কোনও রকম সরকারি সাহায্যের অপেক্ষা না রেখে কলকাতা এবং শহরতলির বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা বিস্তারের কাজ শুরু করেছিলেন। সংঘবদ্ধভাবে কাজ শুরু হয় কলকাতা ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটির নেতৃত্বে ১৮১৯ সালে। তাদের প্রয়াসে কলকাতা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি তৈরি হয়, এবং স্ত্রী শিক্ষার পর্যায়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান ছিল এদের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৮২৪ সাল নাগাদ বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থার উদ্যোগে কলকাতা, চুঁচুড়া, বর্ধমান, ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি স্থানে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমাচার দর্পনের তখন হিসাব মতো শিক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা একাত্তর এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার দুশো সত্তর। উনিশ শতকে বাংলায় নারী শিক্ষার প্রসার এই ভাবে ঘটে। তবে এই শতকে মোটামুটিভাবে সাধারণ জ্ঞানার্জনের মাত্রার বাইরে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মতো মুক্ত বিদ্যার বিষয়ে জ্ঞানার্জন নারীদের জন্যে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। ১৮৩৪ সালে অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্টে পাওয়া যায়, কলকাতাসহ, শ্রীরামপুর, বর্ধমান, কালনা, কাটোয়া, কৃষ্ণনগর, ঢাকা, বাখরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ১৯টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের কথা। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশক পর্যন্ত সরকারি প্রচেষ্টা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। তবে কতিপয় জমিদারের ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। ১৯৩০ সালে বাংলা সরকার Primary Education Act পাশ করার পর সরকারি প্রচেষ্টায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠে। অতএব তখন সহ-শিক্ষার ব্যাপারটি ছিল কষ্টকল্পিত।

বাংলায় প্রথম মেয়েদের পাশ্চাত্য শিক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় সহ-শিক্ষার মাধ্যমে। ব্যাপটিস্ট মিশনের মার্সম্যান ১৮১৭ সালে শ্রীরামপুরে বাঁশের পর্দাদিয়ে প্রথম মেয়েদের সহ-শিক্ষা প্রদান করেন। তবে এরপর দীর্ঘদিন সহ-শিক্ষা ব্যাপারটি আর দেখা যায়নি। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা প্রদান একচেটিয়া ছিল বেথুন কলেজ, ডায়সেশন কলেজ ও লরেটো হাউস এই তিনটি কলেজের।


বিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার আগ্রহ বাড়তে থাকে। স্কটিশ চার্চ কলেজ হল বাংলার প্রথম কলেজ যেখানে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়। বিদেশেও সহ শিক্ষার ব্যাপারটি সহজ সাবলিল ছিল না। পাশ্চাত্যে স্কটল্যান্ডে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেয়েরা শিক্ষার অধিকার অর্জনের চেষ্টা করে। ১৮৬৪ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য তার দরজা খুলে দেয়। তাছাড়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছেলে ও মেয়েদের একসঙ্গে শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ব্রিটেনও সহ-শিক্ষা প্রচলিত রয়েছে এমন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৮৯৭ সালে বাংলার অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম সহ-শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ রো এবং তৎকালীন শিক্ষা অধিকর্তা ড. সি. এ. মার্টিন এর প্রচেষ্টা এবং প্রগতিশীল কিছু ব্রাহ্ম নেতা ও প্রেসিডেন্সি কলেজেরই কোন কোনও অধ্যাপক সহ কিছু ব্যক্তিবর্গের উৎসাহে ১৮৯৭ সালে এফ. এ. ক্লাসের প্রথম বর্ষে দুটি ছাত্রী অমিয়া রায় ও চারুলতা রায়কে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এই সহ-শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়। গ্রীষ্মাবকাশের পরে ছাত্রীদ্বয় ক্লাসে এলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশিত হয় এবং বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি সরকারি স্তরে বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর পর্যন্ত গড়ায়। আর বিষয়টি নিয়ে সচিব ফেলুকেন আধা সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রীভর্তির ব্যাপারে স্থিতাবস্থা রক্ষা করে চলার কথা বলেন।

সরকারি স্থিতাবস্থা রক্ষার কথা বলা হলেও কার্যত সংবাদপত্রের বিরূপ সমালোচনা এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের একাংশের বিরূপতা সব নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের এই সহ- শিক্ষার বিষয়টি স্থায়িত্ব পায়নি। ছাত্রী দুটি কলেজের ও শ্রেণী কক্ষের মধ্যে ছাত্র সহপাঠীদের দ্বারা নানাপ্রকার ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকার হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই দুটি ছাত্রী সম্মানের সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে উৰ্ত্তীণ হয়। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহ-শিক্ষার ব্যাপারটি এই দুটি ছাত্রীর সঙ্গেই সে যাত্রায় শেষ হয়ে যায়। আর নিয়মিতভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহ-শিক্ষা বিষয়টি প্রবর্তিত হয় ১৯৪৪ সালে।

১৮৬৩ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্কটিশ মিশনারি আলেকজেণ্ডার ডাফ স্থায়ীভাবে স্বদেশ ফিরে যাওয়ার পরও স্বটিশ চার্চ কলেজ বহু বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল। কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেণ্ড ড. জেমস ওয়াটের সময় ১৯২১-২২ সাল নাগাদ এদেশে প্রথম কলেজে নিয়মিতভাবে সহ-শিক্ষার প্রবর্তন হয়। এর পূর্বে দু একজন ছাত্রী তাঁর মধ্যে উল্লেখ করার মত হলো, মিস এম এলটন (১৯১০) এবং তার বহু পূর্বে চন্দ্রমুখী বসু নামে এক বঙ্গললনা ফ্রি চার্চ কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। অমিয়লতা ঘোষ স্কটিশ চার্চ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি নবাব আবদুল লতিফ পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে যদিও পূর্বেই সহশিক্ষা প্রবর্তিত
এদিকে সহ-শিক্ষার চাহিদা বাড়ছিল। কিন্তু মহিলা কলেজ সমূহ তা পূরণকরতে ব্যর্থ হয়েছিল। আসন সংখ্যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম। বিভিন্ন সভায় বেঙ্গল এডুকেশন লীগ বারংবার মহিলাদের কলেজে ভর্তির জন্য আসন নেই বলে উল্লেখ করছিল। ইতিমধ্যে ডায়সেশন কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। এরূপ পরিস্থিতিতে দু-একটি কলেজ প্রাত বিভাগ খুলে মেয়েদের ভর্তি করে। বিদ্যাসাগর কলেজে ১৯৩০ সালে ৩১মে এক সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষ থেকেই প্রথমে ৭৫ জন মেয়েকে নিয়ে প্রাতঃকালীন কলেজ শুরু হয় আইএ ও বিএ পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ সমূহের পরিদর্শকদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই কলেজে শুধুমাত্র মেয়েরা ভর্তি হতে পারত। শহর কলকাতা থেকে দূরে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে সহ-শিক্ষা প্রবর্তিত হয় ১৯৩২ সালে। সেখানে একজন ছাত্রী অরুণবালা খাঁ ফাস্ট আর্টস ক্লাসে প্রথমবর্ষের ছাত্রী হিসাবে ভর্তি হয়। এই কলেজে সহ-শিক্ষা প্রবর্তনে তদানীন্তন অধ্যাক্ষ রাজেন্দ্রনাথ সেনের ভূমিকা ছাড়াও তৎকালীন বাংলা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী স্যার মুহম্মদ আজিজুল হক সাহেবের যথেষ্ট সহযোগিতা ছিল। ১৯৩৩ সালে ঐ কলেজে ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় চারজন।

স্কটিশ চার্চ কলেজে সহ-শিক্ষা চালু হলে ১৯২৫ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকসিকিউটিভ কাউনসিল এক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনুমতি ছাড়া ছাত্রীরা ছাত্রের সঙ্গে স্নাতক স্তরে ক্লাস করতে পারবে না। কলেজ মেগাজিন এ বিষয়ে মন্তব্য করে “The authorities of the Allahabad University would be shocked to hear that Scottish Churches College had five lady students. It looked as if the anti – evolution tendencies ‘way down in Tennessee’ had been affecting the nerves of the old man of Allahabad”. বেঙ্গল ওমেনস এডুকেশনাল লীগের ২য় সম্মেলনে লেডি মিটার সহশিক্ষাতে পর্দা তুলে দেওয়া এবং মেয়েদের মানসিক অনুভুতির উন্নতি, বৌদ্ধিক সমতা, আত্ম সম্মান ও আস্থাপূর্ণ নির্ভরতার পক্ষে সওয়াল করেন। ১৯২৭ সালে কয়েকজন ছাত্রী প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য দরখাস্ত করলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে দেয়। এই ঘটনায় লেডি মিত্তর দুঃখ প্রকাশ করেন। ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ এর প্রতিষ্ঠা দিবসে চেয়ারম্যান স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী কলেজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান সহ-শিক্ষা ব্যবস্থা সফল হওয়ার জন্য। সেই সাথে তিনি এবারডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষা চালু করার কথা উল্লেখ করেন। সব দিক দিয়ে বিচার করলে সহ-শিক্ষার প্রচলন ছিল শিক্ষার জগতে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ৷

সূত্র নির্দেশঃ
১] 175th Year Commemoration Volume 1830-2005, Scottish Church College, Kalkata .
২] সম্পাদনা – সুপর্ণা গুপ্ত – ইতিহাসে নারীঃ শিক্ষা, প্রঃ প্রঃ ২০০১।