শিক্ষক দিবস: ৫ সেপ্টেম্বর ও ৫ অক্টোবর

নিশীথ সিংহ রায়

বিশ্বের সেরা শিক্ষক কে? এ প্রশ্নটা আগে আমার খুব মনে আসতো। সত্যিই তো। এখন তো সবকিছুরই একটা মাপকাটি আছে। তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কে বা কারা তা মাপার কেন কোন মাপকাঠি থাকবে না? যাঁরা সমাজের মানুষ তৈরির কারিগর তাঁরা কেন কোনও পুরস্কারে পুরস্কৃত হবেন না? ইউএনও-র সহযোগি সংস্থা ইউনেস্কো অনেক বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করে। তারা তো অনেক দিবস পালন করে শিক্ষক দিবস এবং সেরা শিক্ষক কে সে ব্যাপারে তারা কেনো কোনো পদক্ষেপ নেয় না? অবশেষে তারা তা শুরু করলো। ১৯৯৪ সালে। মানে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ ইউনেস্কো চালু করে ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েন সম্মেলনে। আর তারপর ১৯৯৪ সালে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিলম্বে হলেও যে ঘুম ভেঙেছে তাও ভাল। শিক্ষা যে বিশ্বব্যাপী অবহেলিত তার প্রমাণ তার প্রমাণ কিন্ত এতেই। যাইহোক তখন থেকে প্রতি বৎসর ইউনেস্কো বিশ্বসেরা শিক্ষক নির্বাচিত করে থাকে। ইউনেস্কো শিক্ষক দিবস এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার প্রদান চালু করেছে শিক্ষকের সমাজের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। শিক্ষকেরা আজীবন আদর্শ, বিবেকবান, সমাজ সচেতন ছাত্র গড়ার জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেন তাঁদের অবদানকে স্মরণ ও সম্মান জানানোর জন্য প্রতিটি দেশের সাথে সাথে ইউনেস্কো এই দিবস পালন করে থাকে এবং প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে সম্মান জানানো হয়। গত বছর মানে ২০২৩ সালে এই বিশ্ব সেরা শিক্ষক বা গ্লোবাল টিচার প্রাইজের তকমা ছিনিয়ে নেয় পাকিস্তানের শিক্ষক সিস্টার জেফ। ফ্রান্সে ইউনেস্কোর প্রধান অফিসে এক সম্মেলনে জেফের নাম ঘোষিত হয়। যখন জেফের নিজের শিক্ষার দরকার তখন মাত্র তেরো বছর বয়সে জেফ নিজেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে লাগলেন। গড়ে তুললেন এদের জন্য পাঠশালা। তিনি এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশের এবং ভারতের দীপ নারায়ণ নায়েক বা হরি কৃষ্ণ পাতাচারুর মত নামজাদা পঞ্চাশ জন শিক্ষককে হারিয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের শিরোপা পেয়েছেন। পাকিস্তানের মতো গোঁড়া বা ধর্মীয় শিক্ষায় আচ্ছন্ন বিশেষত মেয়েদের অবস্থান বিবেচনা করলে সিস্টার জেফের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং কর্তব্যের প্রতি কতটা অবিচল থেকে বিশ্বব্যাপী এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছেন সেটা একবার কল্পনা করলেই তাঁর মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যাবে। ইউনেস্কোর ১৯৫টি সদস্য দেশ এবং ১২টি সহযোগি সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা যাঁকে নির্বাচিত করেছেন, আসুন শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে সেই মহিয়ষী নারীকে একবার কুর্নিশ জানাই। ২০২৪ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হতে এখনও দেরি আছে। আশা করব আবার তৃতীয় দুনিয়ার পশ্চাৎপট কোনো এক দেশের এক শিক্ষক জ্ঞান ও শিক্ষার আলোয় তাঁর সমাজকে আলোকিত করার জন্য ধরিত্রীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের শিরোপা ছিনিয়ে নেবেন।

ইউনেস্কোর সাথে অংশীদারিত্বে ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’ দিয়ে থাকে যুক্তরাজ্যের ভার্কি ফাউন্ডেশন। এই মহান দায়িত্ব পালন করার জন্য বিশ্বের শিক্ষাব্রতী মানুষ, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে ভার্কি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সানি ভার্কিকে কুর্নিশ জানাই। এর প্রধান অফিস লন্ডনে। ২০১৫ সাল থেকে এই পুরস্কার চালু হয়েছে। সানি ভার্কি ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্য এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ভারতীয় টাকায় দশ লক্ষ টাকা এবং তা বেশ ঈর্ষণীয়। যা পৃথিবীতে শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্ব্বোচ্চ পুরস্কার।


এই পুরস্কার প্রদান করা হয় তাঁদেরকেই যাঁরা শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে তাঁর সমাজ ও সম্প্রদায়ের ওপর একটা অনুপ্রেরণামূলক প্রভাব ফেলেছেন এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যাপারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকরা যদি এই মানদণ্ড অতিক্রম করেন তাঁরা নিজেরাই মনোনীত হবার সুযোগ পাবেন। এঁদের নির্বাচিত করার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, সরকারি কর্মকর্তা বা বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’ একাডেমি বিচার করে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় বার্ষিক গ্লোবাল এডুকেশন এন্ড স্কিল ফোরামে এই পুরস্কারটি চালু করা হয়েছিল। যেখানে ১২৭ টি দেশের পাঁচ হাজারের ওপর মনোনয়ন এসেছিল। প্রথম বছর মানে ২০১৫ সালে প্রথম এই পুরস্কার লাভ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যান্সি অ্যাটওয়েল। শিক্ষা জগতে অসামান্য কাজের জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী গড়ে বছরে চল্লিশটি বই পড়ে। এটি একটি অলাভজনক সেন্টার ফর টিচিং এন্ড লার্নিং স্কুল যা শিক্ষণ পদ্ধতির বিকাশ ও প্রচারের জন্য  প্রদর্শনী স্কুলও।

২০২০ সালে ভারতের রঞ্জিত সিং দিশালে এই পুরস্কার লাভ করেন। ভার্কি সংস্থার কর্ণধার বলেছেন, ‘শিক্ষকরাও যে তারকা সেটা আমরা সকলকে জানাতে চাই। চাই প্রচার করতে যে সমাজ ও আমাদের জীবন গঠনে তাঁদের যে বিশাল ভূমিকা ও প্রভাব রয়েছে তা তুলে ধরে শিক্ষকদের সমর্থন করে তাঁকে সমাজে আরও প্রতিষ্ঠিত করতে। শিক্ষা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার যথাযথ সম্মান থাকবে। শিক্ষার জগতে বিশ্বে ভার্কি সংস্থার গ্লোবাল টিচার প্রাইজকে নোবেল পুরস্কারের সাথে তুলনা করা হয়। এব্যাপারে বিশদে জানতে ভার্কি সংস্থার ওয়েবসাইট www.globalteacherprize.org দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর এখন অনেক দেশই ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ’ চালু করছে। যেমন পর্তুগাল ২০১৮ সাল থেকে ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজ পর্তুগাল’ পুরস্কার চালু করেছে। ভার্কি ফাউন্ডেশন ৩০০০০ হাজার ইউরো পুরস্কার প্রদান করে যা স্পনসর করে ‘ডেল্টা কাফে’।

ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মহান দার্শনিক, লেখক, শিক্ষক, ভারত রত্ন ও স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনকে স্মরণ করে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। এর এক মাস পরে বিশ্ব শিক্ষক দিবস অর্থাৎ ৫ অক্টোবর। বিশ্বে প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পীঠস্থান ভারতে শিক্ষক দিবস অনেক আগে থেকেই যেহেতু চালু আছে তাই আর নতুন করে ৫ অক্টোবরে অত আড়ম্বরে শিক্ষক দিবস পালিত হয় না।

ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মহান দার্শনিক, লেখক, শিক্ষক, ভারত রত্ন ও স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনকে স্মরণ করে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। এর এক মাস পরে বিশ্ব শিক্ষক দিবস অর্থাৎ ৫ অক্টোবর। বিশ্বে প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পীঠস্থান ভারতে শিক্ষক দিবস অনেক আগে থেকেই যেহেতু চালু আছে তাই আর নতুন করে ৫ অক্টোবরে অত আড়ম্বরে শিক্ষক দিবস পালিত হয় না।