মগজ মেরামতের গুরুদায়িত্বে ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরী

মানুষ বই পড়ছে না। লাইব্রেরি তার আকর্ষণ হারাচ্ছে, ইন্টারনেট ফেসবুক হয়ে উঠেছে বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। লাইব্রেরি সম্পর্কে এমন কথা এখন প্রায় সকলেরই মুখে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী থেকে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের কেউ কেউ আবার লাইব্রেরির এফিটাফও রচনা করে ফেলছেন কিন্তু সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষরা এ ব্যাপারে মৌন থাকলেও লাইব্রেরি সম্পর্কে বর্তমানের এই চালু ধারণাকে নস্যাৎ করে এগিয়ে চলেছে ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৪৪ সালে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক সমাজতাত্বিক বিনয় সরকার এই লাইব্রেরি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির যুবকবৃন্দ বাংলার মগজ মেরামতের কাজে অনেক সাহায্য করছেন’। যে কাজটি সেই সময়ের যুবকবৃন্দ গঙ্গাধর বন্দ্যোপাধ্যায়, নবকুমার দাস, বামাপদ শেঠ, বসন্ত কুমার দাস, বলাই চরণ চিনা, প্রণবকুমার সিংহ, ধীরেন্দ্রনাথ দাসের মত কিছু মানুষের হাতে বিকশিত হয়েছিল। তা এখন পরম্পরায় দেবব্রত কুণ্ডু রাজর্ষি শেঠএর মত কিছু গ্রন্থাগার প্রেমিকের হাতে চলমান। শিক্ষার অবনমন, সামাজিক অবক্ষয আর সর্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত একক জীবনের পাল্টা প্রতিস্পর্ধী হিসেবে এই লাইব্রেরি এখন একটা সামাজিক সংগঠন, ‘আলোর পথযাত্রী’ বলা যেতে পারে। এই বিশেষণে শিরোপা কেন? আলোচনায় আসা যাক সেই পরম্পরার ইতিহাস।

ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা ১৮৮৪ সালে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে ঘটে গেছে সিপাহী বিদ্রোহ। স্বাধীনতার স্পৃহা জনমানসে একটু একটু জেগে উঠছে। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আধুনিক চিন্তা সাড়া ফেলছে বাঙ্গালি মননে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে বাঙালির সাহিত্য ভাবনায় আনছেন নতুন চিন্তাভাবনা। কিছু জায়গায় শিক্ষাবিস্তার এবং সবাধীনতার মন্ত্র ভাবনার সুতিকাগার হিসেবে গড়ে উঠছে গ্রন্থাগার। এই প্রেক্ষাপটে এলাকার কিছু উদ্যোগী ছেলে গড়ে তুলল ব্যাঁটরাতেও লাইব্রেরি। সম্বল বলতে চারটি ছোট আলমারি আর কিছু বই। ডরেস রোডের লয়েডস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাড়িতে গড়ে উঠল সেই লাইব্রেরি। বারবার পরিবর্তন হয়েছে লাইব্রেরির স্থান কিন্তু নানান প্রতিকুলতার মধ্যেও স্মরণীয় কাজ করে গেছে এই লাইব্রেরি। যেমন ১৯৪১ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কিত পরিবেশ, সভা সমিতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক দমবন্ধ অবস্থা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছরের জন্মো্ৎসব পালনে ব্রতী হলেন তাঁরা। এলেন বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কবি যতীন্দ্রনাথ বাগচী, সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেব প্রমুখ। এই সভা শুধু সাহিত্যপ্রেমীদের ছিল না— জনপ্লাবনে মুখরিত হল ব্যাঁটরা। সেই সভার কথা দৈনিক বসুমতী লিখল- ‘যুদ্ধের ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করিয়া কবিগুরুর জন্মোৎসব পালনের জন্য যে রূপ বিশাল জনসমাগম হইয়াছিল এই পরিস্থিতিতে সেইরূপ জনসমাগম মফস্বল শহরের কোন অনুষ্ঠানে প্রত্যাশা করা যায় না’। পাবলিক লাইব্রেরির কাজকর্ম এলাকায় যে সামাজিক প্রভাব ফেলেছিল তার বড় প্রমাণ এই পাবলিক লাইব্রেরির নামে স্কুল।

শুধু পড়ালেখা নয় তার সাথে নানান সামাজিক কাজ ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির অন্যতম উদ্দেশ্য। মেয়েদের সূচি সেলাই, ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার শিক্ষা, এমনকি টেবল টেনিস খেলা। যে টেবল টেনিস থেকে উঠে এসেছে রাজ্যের পদকপ্রাপ্ত অনেক খেলোয়াড। কথা হচ্ছিল লাইব্রেরির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারির সাথে। শিক্ষার এই দুঃসময়ে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা শুনে চমকে যেতে হয়। মগজে ওঠে আনন্দের ঢেউ। শোনালেন বর্তমান লাইব্রেরির চালচিত্র। পুস্তক সংখ্যা ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ১৯০০ সাল থেকে রক্ষিত আছে অনেক অমু্ল্য নথি। বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকায় মিলিয়ে এখন রাখা হয় আট দশটি দৈনিক। এছাড়া আছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫০০ এর কাছাকাছি। সকাল এবং সন্ধে দুই সেশনে চলে লাইব্রেরির কাজকর্ম। শিশু বিভাগে এবং সাধারণ বিভাগে প্রত্যহ বইপত্র লেনাদেন প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি। রবিবার এবং ছুটির দিন পাঠক সংখ্যা ৬০-৭০ জন ছাড়িয়ে যায়, যা কলকাতার বড় বড় লাইব্রেরিগুলির কাছে ঈর্ষণীয় ব্যাপার।


মেয়েদের সূচী শিল্প ছেলেদের কম্পিউটার শিক্ষা টেবল টেনিস তো আছেই, বাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির আর এক অন্যতম কাজ হল প্রাচীন সাহিত্যিক বা মনীষীদের জন্মদিন পালন করা। প্রাচীন ব্যক্তিত্ব এবং ইতিহাস স্মরণও লাইব্রেরির অন্যতম অঙ্গ। ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন কাজকর্মের উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রতি বছর ১৫০টির মত প্রাইজের ব্যবস্থা। তবে সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার তা হলো সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে লাইব্রেরির মধ্যেই বইমেলা। এখানেও ব্যতিক্রমী এই লাইব্রেরি। প্রকাশকদের লাইব্রেরিই ঠিক করে দেন বইয়ের তালিকা। আর হয় পাঠকের মুখোমুখি অনুষ্ঠান। প্রতি বছর লাইব্রেরি নিয়ে আসে দু’জন সাহিত্যিককে। এই বই মেলাতে আসেনি এমন সাহিত্যিক খুজে পাওয়া মুস্কিল। আর এ ব্যাপারে তাদের একটি নীতি হলো নিজেরা গিয়ে নিয়ে আসেন এবং পোঁছে দেন কিন্তু তিনি যত বড়ই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হন না কেন তার জন্য তাঁকে কোন আলাদা সাম্মানিক দক্ষিণা দেন না। অবশ্য কেউ কেউ ইদানীং তা দাবি করেন। এতসব কর্মকাণ্ড কিন্তু চলছে সদস্য চাঁদা অনুদান এবং কিছু মানুষের এককালীন দানে। বিভিন্ন স্থান বদল হয়ে ১৯৫৩ সালে ৪২/৩ লক্ষ্মী নারায়ণ চক্রবর্তি লেনে নিজস্ব বাড়িতে লাইব্রেরির দ্বারোৎঘাঠন হয়। দ্বারোৎঘাঠন করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং জাতীয় গ্রন্থাগারিক বি এস কেশবন। ভাব নায় লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা সেই নির্দিষ্ট পথেই এখনো তার পরিক্রমন।

এই জন্য বাংলার প্রাচীন লাইব্রেরিগুলির মধ্যে এখনো বাঁটরার নাম সর্বাগ্রে। এর জন্য পরম্পরায় উঠে এসেছেন বেশ কিছু মানুষ যাদের কাছে রক্তের সাথে মিশে গেছে লাইব্রেরি। যেমন তণ্ময় ঘোষ, সঞ্চিতা মুখার্জী, অভিজিত সিনহা প্রমুখ। রাজশ্রী শেঠ জানালেন সরকারি পোষিত লাইব্রেরির থেকে অনেক বেশি ভালো চলছে আমাদের এই লাইব্রেরি। আর দেবব্রত বাবুর ভাষায়, ‘আসলে লাইব্রেরি যারা এখন চালান তাদের কাছে তো একটা চাকরি, এদের অধিকাংশেরই লাইব্রেরির সাথে আত্মার আত্মীয় যোগ নেই। এছাড়া আছে বর্তমানে পেশাগত সংকট যেখানে একজন লাইব্রেরিয়ানকেই ছোটাছুটি করতে হয় দু তিনটে লাইব্রেরিতে। সুতরাং সেখানে কি আর ভালো হবে! কিন্তু এই সামাজিক সংকটে কি একদিন আপনাদের মত স্বেচ্ছাসেবী মানুষরা কমে যাবে না? দুর্নীতি বিশ্বাসহীনতার এই স্বার্থসর্বস্ব জীবনের বাঁধা খবরে কিন্তু চমকে যেতে হয় উত্তরে, ‘এই লাইব্রেরীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের বি টিম তৈরি, তারা চাকরি করেও সময় দেন। নানান কাজে দায়িত্ব নিতে সর্বদাই উৎসাহী।’ দেবব্রতবাবুর স্পষ্ট বক্তব্য – ‘পড়ছে না পড়ছে না বলা নয়। আসলে লাইব্রেরি শুধু হাজার হাজার বছরের কালো অক্ষরে রাখা পুস্তক পুঁথি গবেষণা নয়। তার সাথে মানুষের হৃদয় বৃত্তির উৎসমুখ উন্মুক্ত করা হচ্ছে লাইব্রেরির অন্যতম কাজ।

আর এর জন্য দরকার সময়োপযোগী ভাবনা এবং মানুষের বৌদ্ধিক চর্চার অনুষ্ঠান’। এলাকার কিছু মানুষজন এই কাজটিই করে চলেছেন। আজ থেকে ৮০ বছর আগে লাইব্রেরির এই ক্রিয়া পদ্ধতি উল্লেখ করে বিনয়বাবু যা বলেছিলেন সেই মগজ মেরামতির কাজটি কিন্তু এখনো করে চলছে বাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি। পড়ছে না পড়ছে না বল্লে হবে, পাঠক তৈরি করাটাও অগ্রণী লেখককুলের কাজ, লাইব্রেরিয়ানের দায়দায়িত্ব।