অরুণাভ সেন
কন্যার যখন কলেজে পড়ার ইচ্ছা হয় ঘোর বিরক্ত হয়েছিলেন পিতৃদেব। মেয়ে কিনা চাকরি করবে শুধু লেখাপড়া শিখেছে বলে! চণ্ডীচরণের মন সংশয়াচ্ছন্ন, কামিনীকে চিঠিতে লিখলেন তুমি চাকরি করিয়া খাবে একথা ভাবতে তাঁর ক্লেশ হয়। দুবছর পরে অবশ্য চণ্ডীচরণের মনের পরিবর্তন হয়। বন্ধুরা বোঝালেন মেয়ে কাজ করলে কী ক্ষতি হবে, বরং অনেক মেয়ে তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। এই কন্যাটি বাংলার প্রথম মহিলা অনার্স গ্ৰ্যাজুয়েট। আর এক কন্যার গল্প একটু শুনবেন, বাল্যে বিবাহিতা, চিরদিনের ভীরূ মেয়েরা যেমন হয়। মেয়েদের তখন লেখাপড়া শেখা বারণ। ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে একদিন সব বাধা ভেঙে ফেললেন। ২৫ বছর বয়সে নিজের চেষ্টায় বাংলা অক্ষর চিনলেন, পুঁথি পড়তে,পড়ে শোনাতে লাগলেন। কিন্তু লেখা শেখা আর হয় না। লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলেন কারণ চৈতন্য ভাগবতের পুঁথিটি পড়বেন। একদিন তিনি লিখতেও শিখলেন। সপ্তম পুত্র ছুটির পরে শহরে ফিরে যাওয়ার সময়ে মাকে প্রশ্ন করে – মা তুমি কেন আমার চিঠির জবাব দাও না! মা জননী লজ্জা পেয়ে কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, শুধু বললেন খোকা আমি শুধু পড়তে পারি লিখতে পারি না। ছেলে সাথে সাথে মায়ের জন্য দোয়াত,কালি কলম কাগজ এনে মা জননী কে লেখা শেখাতে লাগল। ষাট বছর বয়সে রাসসুন্দরী তাঁর আত্মজীবনী প্রায় শেষ করে আনলেন। অষ্টাশি বছরে ভারতীয় ভাষায় লেখা প্রথম এক ভারতীয় নারীর আত্মকাহিনী ‘ আমার জীবন’। আমাদের কাহিনীর প্রথম কন্যাটির নাম কামিনী, বিয়ে করেছিলেন তিরিশ বছর বয়সে বিপত্নীক কেদারনাথ রায় কে। স্বামী ভদ্রলোকটি ছিলেন তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক। পূর্বরাগের স্পর্শ রাঙিয়ে ছিল তাদের হৃদয়। বিয়ের পরে আর চাকরি করলেন না কামিনী, কবিতাও লিখলেন না। কামিনী বেথুন কলেজ থেকে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেছিলেন। কবিতা লিখে প্রথম জীবনে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন। বেথুন কলেজে শিক্ষকতা করছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। একবছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। অদ্ভুত হলেও সত্য তাঁর পিতা চণ্ডীচরণ সেন নিজের স্ত্রী’র লেখাপড়া শেখায় আপত্তি না থাকলেও বড় মেয়ে কামিনী কে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছেন অনেক পরে। অথচ যদি সেইসময় কামিনী পিতার থেকে চাকরি করার অনুমতি পেতেন চন্দ্রমুখীর আগে তিনি হতেন বেথুনের অ্যাসিস্ট্যান্ট লেডি সুপারিনটেনডেন্ট।
বাঙালি মেয়েরা অমলার আগে চাইলেও অনেক কিছু করতে পারতেন না। গান শেখা হয়ত বা সেভাবে দোষের না হলেও সমাজের চোখে নিন্দনীয় ছিল। ব্যতিক্রম একেবারে ছিল না যেমন বলা যায় না। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের গান শেখা নিন্দনীয় ছিল। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা মাঘোৎসবে গান গাওয়া শুরু করলে ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মিকরাও ব্রাহ্মসংগীত শিখতে শুরু করেন। চৌধুরী বাড়ির বৌ হয়ে এসে প্রতিভা ও ইন্দিরা দুজনেই ‘সঙ্গীত সঙ্ঘ’ নামে একটি স্কুল খুললেন। কারণ মেয়েরা যদি গান না শেখে তারা কিভাবে গাইবেন। প্রায় একই সময়ে বনোয়ারীলাল চৌধুরীর সহধর্মিণী প্রমদাও সংগীত শিক্ষার জন্য ‘সঙ্গীত সম্মিলনী’ খুললেন। কিন্তু গ্রামোফোনের রেকর্ড করার সময় দেখা গেল সেই একই অসুবিধা। সাহানা লিখেছেন “তখনকার দিনে পেশাদার বাঈজী ছাড়া কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে গ্ৰামাফোনে গান দিত না”। চিরাচরিত সেই প্রথা ভেঙেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা। উল্লেখ্য, রেকর্ডে বা রেকর্ড কোম্পানির তালিকায় অমলা দাশের নাম ‘মিস দাস (অ্যামেচার)’ লেখা থাকত। কারণ তখনকার দিনে ভদ্রসমাজের কোনও মহিলার রেকর্ডে বা প্রকাশ্য কোনও অনুষ্ঠানে গান গাইবার কথা ভাবাই যেত না। মাসীমা অমলার কাছে গান শিখেছেন সাহানা ও মামাতো বোন অপর্ণা। সাহানার বড়মামা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। মাসি অমলা দাশ। পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদ সেন। পিসতুতো ভগ্নীপতি সুকুমার রায়। পরিবারের গণ্ডিতে এমন নক্ষত্রসারি শেষ হওয়ার নয়! প্রিয় ঝুনুকে রবীন্দ্রনাথ এক বার বলেছিলেন, “তোমাকেই দেখলুম সংসার থেকেও গান তোমার কাছে এত প্রিয়। মেয়েদের মধ্যে এটা কম দেখা যায়। তারা সংসার করতে বড্ড ভালবাসে”। ঝুনু হলেন সংগীত সাধিকা সাহানা দেবী। রবীন্দ্রসংগীতে যাঁর প্রধান পরিচিতি। মাঘোৎসব উপলক্ষে ১৫ বছর বয়সে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রথম গান করেন সাহানা। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর গানের অনুরাগী। অমলা যেমন প্রথম রেকর্ড গায়িকা তেমন অপর্ণা প্রথম কীর্তণ গায়িকা। তাঁকে এই কাজের পথপ্রদর্শক বলা যায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রয়াণের পরে অপর্ণা কীর্তণ গানে নিজেকে উৎসর্গ করে পালাকীর্তণে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সাহানা নিজে দেখেছেন অপর্ণা বড় বড় সভায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে পদাবলী কীর্তণ গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন।
বাঙালি কন্যাদের কথা শুনতে পেলাম, তারা প্রথা ভেঙেছেন, নিজেদের জীবন দিয়ে অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছেন। চলুন এক বিদেশি কন্যার জীবনের গল্প শুনি। রাসসুন্দরীর সমবয়সী ফরাসি কন্যা জর্জ সাঁদের জীবন একটু হলেও ভিন্ন। কিশোরী বয়স থেকে নিজের মত চলতে শিখেছেন। বিয়ে করেছেন,তিনটি সন্তানের জননী হলেন তারপর স্বামী কে ছেড়ে প্যারিসের শিল্পী মহলে চলে এলেন। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী সবার সাথে বন্ধুত্ব, কোথাও প্রেম। বদলে নিলেন নিজের নাম লুসিল অরোর দুপ্যাঁ নাম পাল্টে হলেন জর্জ সাঁদ। পুরুষের পোশাক পরেন, চুরুট, পাইপ, টুপি কিছু বাদ নেই। শুধু সেই পোশাক থাকত গায়ে সাঁটা যাতে কোমর দেখা যায়। নিয়মিত বদলে যেত পুরুষ সঙ্গী। কিছুদিন প্রবল প্রেম হয় প্যারিসের প্রধান নটী মারিয়া সার্ভারের সঙ্গে। তবে সাঁদের লেখায় দুজন প্রেমিক বেশি জায়গা জুড়ে আছেন। ফরাসি রোম্যান্টিক কবি আলফ্রেদ দ্য মুসে ও বিশ্ববিখ্যাত সুরকার পল শোপ্যাঁ। সাঁদ-শোপ্যাঁর মধুর প্রেমকাহিনী অমর হয়ে আছে ‘মাইয়রকা দ্বীপে একটি শীত’ স্মৃতিকথায়। তেমন দ্য মুসের সঙ্গে প্রেমের তিক্ত বিনষ্টিয দুঃখকথা পাওয়া যায় ‘ সেই নারী এবং সেই পুরুষ’ (Elle et Lui) বইয়ে। দীর্ঘ জীবনের শেষ প্রান্তেও জর্জ সাঁদ লিখেছেন। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস। শিল্পী, সাহিত্যিকদের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রশ্ন হল সমবয়সী দুজনেই,সাঁজ ও আমাদের রাসসুন্দরী দুজনের দুশোর বেশি বছর কী এক! দুজনে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন দেশে বড় হয়েছেন। সাঁজ ছোটবেলায় দিদিমার আদরে স্বেচ্ছাচারপ্রিয়া হয়ে উঠেছিলেন, রাসসুন্দরী বিপরীত।
চিরদিনের ভীরু মেয়ে রাসসুন্দরীর মত আরও এক বাঙালি কন্যা আত্মজীবনী লিখছেন। রাসসুন্দরী যদি হয় উত্তর মেরু এই কন্যা দক্ষিণ। একজন ঘরোয়া গৃহবধূর জীবন লিখেছেন অন্যজন লিখেছেন পতিতাপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক নক্ষত্রের উদয় ও নির্বাণের কাহিনী। পতিতাপল্লীর পঙ্কে জাত পদ্মফুল ফুটে উঠেছিলেন কলকাতার নাট্য সরোবর উজ্জ্বল করে। নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। পার্ট পড়তেন, মুখস্থ করতেন। লাহোরে রাজা অভিহিত এক গোপাল সিং, বিনোদিনীকে রক্ষিতা হিসেবে নয় অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু বিনোদিনীর মা ভয় পেলেন এত দূর দেশে মেয়েটিকে ফেলে রেখে যাবেন অচেনা শ্বশুর ঘরে! মত দিলেন না অর্ধেন্দু মুস্তাফি ও বিনোদিনীর মা। বিনোদিনীর নামে থিয়েটার হয়নি, তথাকথিত কিছু ভদ্রলোকের প্রবল আপত্তিতে। পতিতার নামে থিয়েটার। তারা শিহরিত হলেন ওখানে কি ভদ্রলোকেরা যাব! যে বিনোদিনীর আপ্রাণ প্রয়াস ছাড়া থিয়েটার গড়া সম্ভব ছিল না সেই বিনোদিনীকে পরে শেয়ার হোল্ডার করা হয় নি। গুর্মুখের পরে থিয়েটারের স্বত্ব একদল নাট্যোৎসাহী ভাগ করে নিলেন। সেও কি পতিতা বলে! নাকি নারী বলে! বিনোদিনী অভিমানে মঞ্চ ত্যাগ করলেন তখন খ্যাতির শিখরে বয়স মাত্র ২৪। বিনোদিনী যখন থেমেছেন তখন শুরু করেছেন রাসসুন্দরী, জর্জ সাঁদ। অবশ্যই তিনি বয়সে কনিষ্ঠ, অসমান্য রূপ গুণ সত্ত্বেও কেবল পতিতাজন্মের কলঙ্কে অতিপ্রিয় প্রণয়ী এবং একমাত্র কন্যাসন্তানের অকাল মৃত্যুর পরে শেষ জীবন কাটিয়েছেন দারিদ্রে,দুর্দশায়। মাত্র ১২ বছর অভিনয় জীবন কাটিয়ে চিরদিনের মত ঠাঁই করে নিয়েছেন বাংলা নাটকের জগতে। লিখেছেন আত্মজীবনী। তাই রাসসুন্দরী, জর্জ সাঁদের মত নটী বিনোদিনী ও অপরাজেয় এক নারী, একটি অবিস্মরণীয় প্রতিভা। শুধু তিন কন্যার জীবনের চলার পথ আলাদা হলেও তিন জন আমাদের সমাজের পথিকৃৎ, তিন জন স্বাধীন মুক্ত মনের মানুষ। রাসসুন্দরী বাইরের স্বাধীনতা চাননি, কাম্য ছিল অন্তরের স্বাধীনতা, জ্ঞান অর্জন। বিনোদিনী ও জর্জ সাঁদ চেয়েছিলেন ব্যক্তির মুক্তি। সাঁদ জোর করে আদায় করেছেন, বিনোদিনী শিল্পী হিসেবে চরম সম্মান পেলেও মানুষ হিসেবে পেয়েছেন চরম অবমাননা।
আরও একজনের কথা শুনতে শুধু নয় বলতে ইচ্ছা হয় তিনি অবশ্য নারী নন পুরুষ। গভীর রাতে বাড়ির আড্ডা যখন নিস্তব্ধ হত, মাঝরাতে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দিলে ভোর পর্যন্ত তেলের প্রদীপের আলোয় পড়তেন । হেয়ার সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁর স্কুল থেকে পাশ করলে হিন্দু কলেজে বিনা বেতনে পড়া যাবে, যদিও সাহেব তাঁর স্কুলে লালবিহারীকে ভর্তি নেননি। লালবিহারীর একটা ইংরেজি অভিধানের বড্ড দরকার কিন্তু কিনবেন কীভাবে! হাতে যে বই কেনার পয়সা নেই৷ অতি কষ্টে পয়সা জমিয়ে কিনলেন জনসন সাহেবের ছেঁড়া অভিধান৷ কিন্তু অভিধান পড়ে যে আর ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করা যায় না,সেইজন্য পড়তে হবে সাহিত্যের নামকরা লেখকদের বই কিন্তু কিভাবে সেসব সম্ভব হবে! তবে সত্যি উপায় একটা বের হল। বইয়ের এত দোকান তখন কোথায়। ফিরিওয়ালারা কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় বই ফিরি করতেন৷ পরিচয় হল একজনের সঙ্গে তিনি বই ফিরি করতেন, বোধহয় একটু স্নেহ করতেন লালবিহারীকে! এই বঙ্গসন্তানের ইংরেজি ভাষার উপর যে অসামান্য দখল ছিল অনেক ব্রিটিশের সেটা ছিল না। ‘রো’ নামের একজন সাহেব অধ্যাপক একবার নিজের বইয়ে বাঙালিদের লেখা ইংরেজিকে ‘বাবু ইংরেজি’ বলে উপহাস করলেন। গর্জে উঠলেন বঙ্গসন্তন লালবিহারী, লিখলেন এক প্রবন্ধ সেখানে তিনি রো সাহেবের নিজের লেখার ভুরিভুরি ভুল তুলে ধরে মুখের মত জবাব দিলেন৷ এই ঘটনায় লালবিহারীর নামে ধন্য ধন্য পড়ে যায়৷ নিজে ইংরেজি না জানলেও, ছেলেকে যেমন করেই হোক ইংরেজি শেখাতে হবে এই ছিল লালবিহারীর বাবার পণ৷ একেবারে খাঁটি মানুষ, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা এসব তাঁর অজানা ছিল। পরিশ্রমের সঙ্গে লক্ষে স্থির থাকলে চরম দারিদ্র্য যে বিদ্যার্জনের পথে বাধা হতে পারে না, আমাদের কাছে বড় দৃষ্টান্ত বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগর মহাশয়, আরও একজন নিশ্চিত ভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি বাংলার উজ্জ্বল রত্ন রেভারেন্ড লালবিহারী দে৷ বিদ্বজ্জনদের অনেকের মতে ‘নীলদর্পণ’ যদি হয় কৃষকের মহানাটক, তবে লালবিহারী দে রচিত ‘BENGAL PEASANT LIFE’ (বেঙ্গল পেজ়েন্ট লাইফ) অর্থাৎ গোবিন্দ সামন্ত কৃষকের জন্য মহাকাব্য বললে খুব ভুল হয় না৷ ১৮৭২সালের গোড়ায় বইটির রচনা সম্পূর্ণ হয়, শেষে আরও তিন অধ্যায় জুড়ে ১৮৭৪ সালের মাঝের দিকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়৷ এই বইয়ে লালবিহারী বাংলার কৃষকের দুরবস্থার উপরে গভীরভাবে আলোকপাত করেছেন, নিরপেক্ষতার ভান না করে ঘটনার সব দায় চাপিয়েছেন জমিদার ও বিদেশি কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও অকথ্য শোষণের দিকে৷ এই উপন্যাস লিখে লালবিহারী উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ঘোষিত
৫০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ ছোটলাট স্যার এসলি ইডেনের আদেশে ১৮৬৭ সালে বহরমপুরে সরকারি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের অধ্যাপক হলেন লালবিহারী দে৷ বহরমপুরের পর বদলি হলেন হুগলি কলেজে, ১৮৭৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হয়েছেন, ১৮৮৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করেন। শুধুমাত্র অধ্যাপনা নয়, লালবিহারী দে ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক৷ ‘কলকাতা রিভিউ’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ সহ সেই সময়ের প্রসিদ্ধ সাময়িকপত্রে তিনি সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন৷ নিজে চারখানি সাময়িকপত্র সম্পাদনা করতেন, প্রথমে বলতে হয় বাংলা ভাষায় তাঁর সম্পাদিত একমাত্র মাসিক ‘অরুণোদয়’৷ কলকাতা ও কালনা থেকে এই পত্রিকা প্রকাশিত হত৷ ‘ইন্ডিয়ান রিফরমার’ অল্প কিছুদিনের জন্য সম্পাদনা করেছেন৷ সাপ্তাহিক ‘ফ্রাইডে রিভিউ’ সম্পাদনা করেছেন তবে স্থায়ী হয়নি বেশিদিন৷ হুগলি থেকে মাসিক পত্রিকা ‘বেঙ্গল ম্যাগাজিন’ সম্পাদনা করতেন৷ বলা বাহুল্য এই পত্রিকা বহু বছর চলেছিল৷ ‘বেঙ্গল ম্যাগাজিনে’ লালবিহারী তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট রচনাগুলি লিখেছেন৷ ধর্ম থেকে শুরু করে বিনোদন— সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই তিনি লিখেছেন ‘বেঙ্গলি ফেস্টিভ্যাল অ্যান্ড হলিডে’, ‘স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস অব বেঙ্গল’, ‘চৈতন্য অ্যান্ড বৈষ্ণব অব বেঙ্গল’, ইত্যাদি৷ লালবিহারীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নিঃসন্দেহে ‘BENGAL PEASANT LIFE’ (বেঙ্গল পেজ়েন্ট লাইফ) অর্থাৎ গোবিন্দ সামন্ত, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমালোচকদের মতে, গরিব, বাঙালি কৃষকের জীবনের ইতিহাস এর চেয়ে চমৎকারভাবে অন্য কেউ বিবৃত করেননি। বিদ্বজ্জনদের অনেকের মতে নীলদর্পণ যদি হয় কৃষকের মহানাটক তবে ‘গোবিন্দ সামন্ত’ নিশ্চয়ই মহাকাব্য৷
লালবিহারী ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক, মনে-প্রাণে বাঙালি, বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও তিনি সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি, গ্রীক, ল্যাটিন হিব্রুভাষা জানতেন৷ বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অগাধ শ্রদ্ধা৷ তাঁর রচিত ১৩ খানি প্রবন্ধের নয়টি ও তিনটি গ্রন্থের দুটি বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে লেখা৷ তবু আমরা তাঁকে কতটা মনে রেখেছি!
সেই প্রশ্ন বোধহয় চাপা দেওয়া গেল না৷ একসময়ে বাংলার ঠাকুমা-দিদিমারা নাতি-নাতনিদের যেসব গল্প দিয়ে ভোলাতেন, সেই সব রূপকথা নিয়েই লালবিহারীর ‘ফোক টেলস অব বেঙ্গল’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে এবং সেই সংগ্রহের জন্য লালবিহারী রিচার্ড কারনাক টেম্পল-এর অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন।
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
অন্তঃপুরের আত্মকথা – চিত্রা দেব
নবনীতার নোটবই – নবনীতা দেবসেন
কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র