(পর্ব – ৫)
সংবিধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ
সংবিধানের প্রস্তাবনা কি শুধুই নিছক একটি ভূমিকা? না কি এর কোনও বিশেষ পরিচয় এবং আইনগত বৈশিষ্ট্য আছে? এবারের সংখ্যায় সংবিধানের প্রস্তাবনাকে নিয়েই বিস্তারিত জানানো হল।
যে কোনও বইয়ের যেমন একটা মুখবন্ধ বা ভূমিকা থাকে, ঠিক তেমনই ভারতীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে “প্রস্তাবনা” হল সেই মুখবন্ধ বা ভূমিকা।
ভারতীয় সংবিধানে প্রস্তাবনা রাখার বিষয়টি মার্কিন সংবিধান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সর্বপ্রথম আমেরিকান সংবিধানেই প্রস্তাবনার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ‘প্রস্তাবনা’ শব্দটি সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধকে বোঝায়। বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ এন এ পালখিওয়ালা প্রস্তাবনাকে ‘সংবিধানের পরিচয়পত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা “অবজেকটিভ রেজোলিউশনের” উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবটি গণপরিষদে পন্ডিত নেহেরু প্রথম উত্থাপিত করেছিলেন। প্রস্তাবনাটি ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইন (১৯৭৬) দ্বারা একবার মাত্র সংশোধিত হয়েছে। যেখানে তিনটি নতুন শব্দ যোগ করা হয় – সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ঐক্য।
প্রস্তাবনার আক্ষরিক বক্তব্য
আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে, সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
সার্বভৌম
ভারতীয় সংবিধানে “সার্বভৌম” শব্দটি নির্দেশ করে যে, ভারত একটি স্বাধীন এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্বসম্পন্ন দেশ এবং বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। এর অর্থ হল, অন্য কোনও দেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই, ভারত তার অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত বিষয়সমূহে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত। এই শব্দটি দেশের আইন প্রণয়ন ও শাসনের ক্ষমতা, এর আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তভাবে অংশগ্রহণের ক্ষমতাকে সুনিশ্চিত করে।
সমাজতান্ত্রিক
ভারতীয় সংবিধানে “সমাজতান্ত্রিক” শব্দটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বকে নির্দেশ করে যে, অর্থ এবং সম্পদ সুষমভাবে বিতরণ নিশ্চিত করা হবে এবং নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আবাসনে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। ব্যক্তিগত সম্পদের সমাহারের পরিবর্তে সামূহিক-কল্যাণকে গুরুত্ব দিয়ে একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনে উৎসাহ দেয়।
ধর্মনিরপেক্ষ
ভারতীয় সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি ধর্মীয় নিরপেক্ষতাকে বোঝায়। যা নিশ্চিত করে যে, রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেয় এবং কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত বা বৈষম্য করে না। এই কাঠামো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। নাগরিকদের যে কোনও ধর্ম স্বাধীনভাবে অনুসরণের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহাবস্থানের পরিবেশকে সুনিশ্চিত করে।
গণতান্ত্রিক
ভারতীয় সংবিধানে “গণতান্ত্রিক” শব্দটি নির্দেশ করে যে ভারতের শাসনব্যবস্থা, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। এটি নাগরিকদের সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকারকে গুরুত্ব দেয় এবং প্রশাসনে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই কাঠামো মৌলিক অধিকারগুলিকে রক্ষা করে এবং সমতার মাত্রা বাড়ায়।
প্রজাতান্ত্রিক
ভারতীয় সংবিধানে “প্রজাতান্ত্রিক” শব্দটি নির্দেশ করে যে ভারত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। যেখানে রাষ্ট্রপতি একজন নির্বাচিত প্রধান এবং শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী। যদিও ভারতের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সমস্ত বিষয়ে শেষ কথা ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বলেন। এটি নিশ্চিত করে যে, সকল ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পিত আছে।
সমতা
ভারতীয় সংবিধানে “সমতা” নিশ্চিত করে যে সকল ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমানভাবে দেখা হয়। এটি জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা বর্ণ নির্বিশেষে সুযোগ ও সম্পদে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। একটি অন্তর্ভুক্ত সমাজ গড়ে তোলে। যেখানে সকলের অংশগ্রহণ এবং সফলতার সমানাধিকার রয়েছে।
প্রস্তাবনা কি সংবিধানের মৌলিক অংশ?
প্রস্তাবনা সংবিধানের মৌলিক অংশ কি না, এই নিয়ে একাধিকবার বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। “বেরুবারি ইউনিয়ন” মামলায় ১৯৬০ সালে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল যে, প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানের অংশ নয়। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে আরেকটি বিখ্যাত মামলা যথা “কেশবানন্দ ভারতী” মামলায় ১৯৭৩ সালে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়, প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানেরই একটি অংশ। তবে এও জানায় যে,
১) প্রস্তাবনা কখনই আইনসভার বা পার্লামেন্টের ক্ষমতার উৎস বা ক্ষমতার অপসারণ হতে পারে না।
২) প্রস্তাবনা একটি বিচারাধীন ব্যবস্থার অংশ নয়। অর্থাৎ, প্রস্তাবনার বিষয়গুলি আদালত দ্বারা প্রয়োগ করা যাবে না।
প্রস্তাবনা কি সংশোধনযোগ্য?
প্রস্তাবনা সংশোধনযোগ্য কি না এই নিয়েও একাধিকবার বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। তবে ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিমকোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, প্রস্তাবনাকে সংশোধন করা যেতে পারে। কারণ হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, প্রস্তাবনা সংবিধানেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গ্রন্থ সহায়তা: ইন্ডিয়ান পলিটি; লেখক – নীরজ রাও এবং নীতিশ শঙ্কর, ওয়াইলি ইন্ডিয়া।
বহুমাত্রিক নির্বাচনী প্রশ্ন (MCQ)
১) ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা ভারতবর্ষকে কী ভাবে ঘোষণা করে?
ক) একটি রাজ্য
খ) একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতন্ত্রী
গ) একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র
ঘ) একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র
২) ৪২তম সংশোধনী আইন, ১৯৭৬ এর মাধ্যমে প্রস্তাবনায় কোন মূল শব্দগুলি যুক্ত হয়েছে?
ক) স্বাধীনতা, ন্যায় এবং ভ্রাতৃত্ব
খ) সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, এবং ঐক্য
গ) স্বাধীনতা, সমতা, এবং গণতন্ত্র
ঘ) একতা, ঐক্য, এবং ন্যায়
৩) প্রস্তাবনাটি সকল নাগরিকের মধ্যে কী ভাবনা বৃদ্ধি করার উপর জোর দেয়?
ক) সম্পদ
খ) শিক্ষা
গ) ন্যায়
ঘ) ক্ষমতা
উত্তর: গ) ন্যায়
৪) নীচের কোন আদর্শটি প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখিত নয়?
ক) স্বাধীনতা
খ) ভ্রাতৃত্ব
গ) সমতা
ঘ) নিরাপত্তা
৫) প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানে কোন ধরনের নথি হিসেবে কাজ করে?
ক) একটি ভূমিকা
খ) একটি সংক্ষিপ্তসার
গ) একটি নির্দেশিকা নীতি
ঘ) একটি আইনগত ধারা
(এম সি কিউ ধরনের নমুনা প্রশ্নপত্রের উত্তর থাকবে আগামী সংখ্যায়। গত সপ্তাহের উত্তর নীচে দেওয়া হল। এই প্রস্তুতিপর্ব তোমাদের কেমন লাগছে, আরও কী কী বিষয়ে জানতে চাও – আমাদের ইমেল করে জানাও। Email: dasakishor@gmail.com)
গত সপ্তাহের উত্তর
(১ উত্তর: খ) দ্বৈতশাসন; ২ গ) রাষ্ট্রপতি পরিষদ এবং আইনসভা; ৩ খ) শাসন-ব্যবস্থায় ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব; ৪ খ) পৃথক নির্বাচনী এলাকা; ৫ খ) মর্লে-মিন্টো সংস্কার; ৬ খ) আইনসভা; ৭ খ) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিলুপ্তি; ৮ খ) ভারতীয় রাজ্যের জন্য পৃথক সচিব; ৯ খ) ১৯২৮ সালে; ১০ খ) কমিশনে ভারতীয় সদস্যদের অনুপস্থিতি এবং ১১) গ) একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।