মানুষের জীবনে দুঃখ আসে নিজ নিয়মে

প্রতীকী চিত্র

নিশীথ সিংহ রায়

মানুষের সুখ-দুঃখ সর্বদা পাশাপাশি থাকে। আজ সুখ তো কাল দুঃখ। এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। মানুষ হয়ে জন্মালে সুখ যেমন থাকবে দুঃখও তেমন থাকবে। যদি কোনো মানুষ ভাবে জীবনে আমি শুধুমাত্র সুখ চাই কোনো দুঃখ চাই না তবে তা বাস্তবে অসম্ভব। সম্ভব হবে তখনই যখন সেই মানুষ আর সমাজবদ্ধ জীব থাকবে না। সমাজবদ্ধ জীব হলেই তার সুখ এবং দুঃখ দুটো পাশাপাশি চলবে। সমাজে থাকলেই তার চাহিদা আসবে আর তা পূরণ না হলেই দুঃখ আসবে। সমাজবদ্ধ প্রতিটি মানুষ মানবতার সম্পর্কে বা বন্ধনে আবদ্ধ। মানবতার সম্পর্ক যেখানে থাকবে সেখানেই সুখ ও দুঃখ আসবে। মানবতাবাদীরা অপরের সুখে যেমন সুখী হয় তেমনই অপরের দুঃখেও দুঃখী হয়। আবার অপরের দ্বারাও দুঃখ পায়। মানে সামাজিক পরিবেশের সাথে দুঃখ অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তাই সমাজবদ্ধ মানুষের দুঃখ আসবেই। সেকারণে গৃহত্যাগী বা সন্ন্যাসী মানুষেরা সাধারণত দুঃখী হয় না। যাক্, এ আলোচনা পরে হবে। তার মানে মানুষ দুঃখী হয় তার নিজের কারণেই। সমাজে থাকতে গেলে চাহিদা আসবেই। আর এই চাহিদাই দুঃখের মূল কারণ। চাহিদা মানসিক বা বস্তুগত দুটোই হতে পারে। যেমন আমরা হতাশা থেকে দুঃখ পাই। হতাশা কোত্থেকে আসে? না, চাহিদা পূরণ না হলেই হতাশা আসে। নিরাশার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

আবার আমরা আমাদের অনুকূল পরিবেশ না পেলেই দুঃখ পাই। অনুকূল পরিবেশ হওয়া চাই আমাদের চাহিদামত। এই চাহিদা না থাকলে আমাদের প্রতিকূল পরিবেশে পড়তে হত না। ক্ষতি বা লোকসান থেকেও আমাদের দুঃখ আসে। লাভের কথা মাথায় থাকে বলেই আমরা তা পূরণ করতে যাই আর তা না হলেই দুঃখ পাই। লাভ তো চাহিদা থেকেই আসে। শোক থেকেও আমরা দুঃখ পাই। শোক হচ্ছে সমাজবদ্ধ জীবের আদর্শ উদাহরণ। সমাজে না থাকলে শোক আসত না আর দুঃখও পেতে হত না। বস্তুগত চাহিদা বা লোভ সমাজবদ্ধ মানুষের দুঃখের একটা কারণ। সমাজে থাকলেই তার এসব চাহিদা আসবেই। তাই যেকোনো চাহিদা না মিটলেই দুঃখ আসবে। এই চাহিদা ভেদে মানুষ সুখ-দুঃখ লাভ করে। যখন আমরা না খাওয়ার অবস্থায় থাকি তখন আমরা ভাবি আমার প্রাথমিক চাহিদা মিটে গেলেই আমি খুব সুখী। আবার এই প্রাথমিক চাহিদা মিটে গেলেই আসে পরবর্তী চাহিদা। চাহিদার কোনো শেষ হতে পারে না। চাহিদার সূত্রপাত লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা ইত্যাদি সবকিছু থেকেই। এগুলিই আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। আমরা যখন এ চাহিদার কোনো একটা বা সবকটা পূরণ করব তখন আর আগের সেই চাহিদার কোনো মূল্য থাকে না। কারণ, সেটা তখন অতীত। এভাবে আমাদের নিত্যনতুন চাহিদা বাড়তে থাকে। আর এই চাহিদা একজন পুরুষ মানুষের যেমন থাকে একজন নারীরও তেমন থাকে। হয়ত চাহিদার রকমফের হতে পারে লিঙ্গ বা মানুষ ভেদে।


সেকারণে লোভ, লালসা, কামনা, বাসনারও হেরফের হতে পারে। এসব থেকে বেড়িয়ে আসার পথ? এসব ত্যাগ করতে হবে। এর থেকেই চাহিদার সৃষ্টি। সর্বপ্রথম আমাদের লোভ ত্যাগ করা উচিত। তারজন্য মন পবিত্র রাখতে হবে। মন পবিত্র থাকলে আমরা লোভ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি। এদিকে মন পবিত্র হয় সত্যের দ্বারা। সত্য যেখানে থাকে না সেখানে পবিত্রতা থাকতে পারে না। আর পবিত্রতা না থাকলে সেখানে দুঃখ আসা স্বাভাবিক। সামাজিক মানুষ প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনেও সত্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, সেকারণে মনে একটা পাপবোধ কাজ করে। তার জন্য আমরা মানসিক ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়। মানসিক বিক্ষিপ্ত মানুষ কি সুস্থ থাকতে পারে? বুদ্ধি অনুযায়ী মানুষ ফল লাভ করে। বুদ্ধি হচ্ছে সুবুদ্ধি ও কুবুদ্ধি। সুবুদ্ধিতে সুখ আসে। আর কুবুদ্ধিতে দুঃখ আসে। বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটায় জ্ঞান। কিন্ত যে জ্ঞান কুবুদ্ধি বা মিথ্যার মাধ্যমে দ্বারা অর্জন করি তা পবিত্রতা বা সত্য দ্বারা অর্জন নয়। সেকারণে অন্তিমে দুঃখ আসতে বাধ্য।

এক্ষেত্রে মহাভারতের কর্ণের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর জ্ঞান যেমন মিথ্যার দ্বারা অর্জন তেমন নিজে পাপের অংশ হওয়ার জন্য অতবড় দানবীর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পতন অনিবার্য হয়েছে। সেজন্য যখন জ্ঞানার্জন করব তখন তার পবিত্রতা মেনে করা উচিত বা মিথ্যার দ্বারা যেন না হয় সেটা দেখা উচিত। আবার মানুষ যখন বারবার ব্যর্থ হয় তখন সে দুঃখ পায়, কষ্ট পায়। ভাবে ব্যর্থতার নামই জীবন। তাতে আরও কষ্ট, দুঃখ পায়। কিন্ত ব্যর্থতার নামই তো সফলতা। সফলতা আসতে গেলে ব্যর্থতা তার আগে আসতে পারে। এটা আমরা ভুলে যাই। সফল মানুষেরা ব্যর্থতা থেকেও সাফল্যের পথ বের করে নেয়। সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ‘ধর্ম’, ‘ধৈর্য’ আর ‘সাহস’। এই তিনটি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। ধর্ম অর্থাৎ ন্যায় সমগ্র জীবনের হাতিয়ার। হাতিয়ার না থাকলে যেমন যুদ্ধ বা কর্ম জেতা যায় না। ধর্ম না থাকলেও তেমন যুদ্ধ বা কর্ম জেতা যায় না। যতই পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকুক ধর্মের পথে থাকলে অন্তীমে জয়ী আসবেই। এখানেও বলা যায় ধর্মের পথে থাকার জন্যই অন্তিমে পান্ডবরাই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল।

এরপর ধৈর্য বা একাগ্রতা। একাগ্রতা না থাকলেও জীবন যুদ্ধে জেতা যায় না। আমরা দেখেছি এই একাগ্রতাই অর্জুনের সাথে আর সব কুরু-পান্ডবের তফাৎ করে দিয়েছিল। শেষে হচ্ছে সাহস। যুদ্ধ জয়ের আর এক হাতিয়ার সাহস। সাহস থাকলে তবেই যুদ্ধ বা কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। কিন্ত শুধুমাত্র সাহস কোনো যুদ্ধ জয়ের একমাত্র হাতিয়ার নয়। এর সাথে ধর্ম এবং ধৈর্য থাকতেই হব। সাহস কুরু-পান্ডব দু’দলেরই ছিল কিন্ত যুদ্ধে জিতেছিল পান্ডবরা কারণ ‘ধৈর্য’ ও ‘ধর্ম’ তাঁদের সঙ্গে ছিল বিশেষত ধর্ম। এদিকে সুখ আর দুঃখও আসে সময় অনুযায়ী। জীবনে সময় হচ্ছে সবচেয়ে দামী জিনিস। সময়ের থেকে দামী আর কিছুই নেই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই পুরো সময়টা আমাদের হাতে। এই জন্ম-মৃত্যুর মধ্যের সময়টা সম্পূর্ণ আমাদের হাতে। তাই, এই পুরো সময়টা আমরা কিভাবে ব্যয় করব তার ওপর আমাদের সুসময় ও দুঃসময় আসবে। দুঃসময় জীবনের একটা অঙ্গ। আর দুঃসময় এলে তো আমরা দুঃখ পাবই। আর সুসময়ে সুখ আসা স্বাভাবিক। দুঃসময়ে যদি আমরা সত্যের থেকে সরে যাই তাহলে আমরা আরও দুঃসময়ে মধ্যে পড়ব। আর এই সময় যখন আমাদের সুসময় বা অনুকূলে থাকে তখন আমরা যদি তার সদ্ব্যবহার করি বা ধর্মের পথে থাকি তবে আমরা যেমন সুখ পাব তেমন নিজেকে সফল মানুষ হিসেবেও প্রতিপন্ন করতে পারব। তাই সফল মানুষেরা দুঃখ পেলেও হা-হুতাশ করে না।

কারণ তারা জানে সুখ ও দুঃখ একই মুদ্রার দু’পিট। আমার কর্ম, আমার চেষ্টাই আমাকে সুখের মুখ দেখাবে। আবার আমার অসৎ কর্মই আমাকে দুঃখ দেবে। তাই দুঃখ থেকে বাঁচতে গেলে সর্বদা সৎ পথে, লোভহীন হয়ে বাঁচতে হবে এবং কর্ম করতে হবে। লোভী মানুষেরা কোনোদিনই কোনোকিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। পাওয়ার লোভ তাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যে কোথায় থামতে হয় তা তারা জানে না। তাই তারা কোনোদিন সুখের মুখ দেখতে পায় না। তাই অনেক থাকতেও মানুষ অসুখী হয়। যেমন দুর্যোধন ছিলেন। কিন্ত সৎ নির্লোভ মানুষেরা জানে যে তার কর্ম অনুযায়ী সে তার ফল পেয়েছে এতে সে তাতেই বা অল্পতেই সন্তুষ্ট বা সুখী থাকে। কাজের ক্ষেত্রে আমরা সুসময় বা ভাল সময়ের জন্য অপেক্ষা করি। সময় তো তার নিজের গতি অনুযায়ী চলে।

সে কখনও ভাল বা খারাপ হতে পারে না। সময় ভাল বা খারাপ হয় আমাদের মানসিকতার ওপরে। সময় খারাপের দোয়াই দিয়ে আমরা আমাদের অমূল্য সময়কেই অপমান করি। সেকারণে সময় আমাদের জীবনে অনেক কিছু দিয়েও আবার কেড়ে নেয়। আমরা জানি জীবনে একটাই নিশ্চিত সেটা হল ‘মৃত্যু’। আর জীবনে সবচেয়ে অনিশ্চিত ‘বেঁচে’ থাকা। আর কি কৌতুক ব্যাপার যেটা আমরা নিশ্চিত জানি আমাদের অনিশ্চিত জীবনে আসবেই তাকে নিয়েই আমরা কত পরিকল্পনা, কত আশা, কত কি ভাবি তাই না! এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

যাই হোক, জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে আমাদের সর্বদা ন্যায় পথে থাকা উচিত। ন্যায় বা সৎ পথে থাকলে জীবনে সুখ-দুঃখ বলে আলাদা কোনো অনুভূতি থাকে না। সুখকে তারা যেমন হাসিমুখে মেনে নেয় দুঃখকেও তারা তেমনই হাসিমুখে মেনে নেয়। যেটা মহাভারতে পন্ডবদের ক্ষেত্রে হয়ে ছিল। তারা জীবনের অধিকাংশ সময় দুঃখ পেয়েও ‘ন্যায়’ থেকে সরে আসেনি। আর তাদের দুঃখের একটাই কারণ ধর্মের পথে থাকলেও যেখানে যেমন পথ অবলম্বন করা উচিত ছিল তা তারা করেনি। তারা ধর্মের পথে থাকলেও যেখানে ছল, চতুরতা প্রভৃতির আশ্রয় নেওয়া উচিত ছিল তা তারা নেয়নি। তারা শুধুমাত্র ধর্ম আর ক্ষমতার ওপর ভরসা করে জয়ী হতে গিয়েছিল তাই তারা কপটতার কাছে বারবার হেরে গেছে। সে কথা কৃষ্ণ বলেছেন। এই কারণেই কৃষ্ণ পান্ডব পক্ষ নেবার পরে তাদের জয় আরও ত্বরান্বিত হয়েছিল। তাই এটাও সত্যি ন্যায় পথের সাথে সাথে ‘যখন যেমন তখন তেমন’ বা ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী চলা উচিত’। তাতে দুঃখও যেমন হয় না তেমন জীবনযুদ্ধে জয়ীও হওয়ায় যায়।