স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে গ্রামেগঞ্জে বা শহরতলিতে গড়ে ওঠা লাইব্রেরীরগুলির ছিল বহুমুখী উদ্দেশ্য। শুধু পাঠ বা জ্ঞানার্জন নয় এই লাইব্রেরীগুলির মধ্যে চর্চা হত সবাধীনতার মন্ত্র। চর্চা এবং সাধনের মধ্য দিয়ে এইপাঠাগারগুলি হয়ে উঠে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যাবহিত পরে সেখানে জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে মুখ্য হয়ে ওঠে চরিত্র গঠন এবং যুব ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ ও সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া। মূলত এই ভাবনা থেকেই বালি পঞ্চানন তলা সংলগ্ন কিছু যুবকের সামাজিক সংগঠন “সপ্ত সাথী ফরওয়ার্ড ব্লকের’ উদ্যোগে গড়ে ওঠে বালী শ্রীকৃষ্ণ (বর্তমানে অবলুপ্ত) সিনেমার পার্শ্ববর্তী পঞ্চানন তলা রোডে এক লাইব্রেরী। উদোগীদের অন্যতম সদস্য “সমর মুখার্জীর” অকাল প্রয়াণে লাইব্রেরীর নাম হয় “সমর স্মৃতি পাঠাগার’।
ঘর ঘর অর্থ সংগ্রহ এবং শুভাকাঙ্কীদের অনুদানে তৈরী হয় এই লাইব্রেরী। পরবর্ত্তী ক্ষেত্রে সরকারি অর্থানুকুল্যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এই পাঠাগারের। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ দাদাদের আবেগ এবং নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা নির্মিত এই লাইব্রেরীতে একেবারে কিশোর অবস্থা থেকেই যাতায়াত দেবজিত ব্যানার্জির। এই লাইব্রেরীর সান্নিধ্যে উপকৃত হয়ে নিজের জীবন যেমন গড়েছেন অন্য দিকে মাধ্যমিক পাস করার পর থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন লাইব্রেরীর উপযোগিতা। চাকুরী অবস্থায় প্রতিদিনের উপস্থিতে ভাটা পড়লেও যোগাযোগ রাখতে ভোলেননি। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকেই ইন্টারনেটের বাড় বাড়ন্ত যখন এই ধরনের লাইব্রেরীগুলির মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করে সেদিন থেকেই তার উপলব্ধিতে আসে লাইব্রেরীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পাঠকরাই যে কোন গ্রন্থাগারের নিউ ক্লিয়াস। এই ভাবনা তার মনোজগতে বাসা বাঁধে।
ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এবং রিলের যুগে যেখানে পাঠক সংখ্যা অভাবনীয় হারে কমতির দিকে সেখানে সাধারন পাঠক থেকে শুরু করে শিক্ষিত পিতা-মাতারা যখন তাদের ছেলে-মেয়েদের লাইব্রেরী পাঠাতে উৎসাহ বোধ করেন না সেখানে ব্যতিক্রমী ভুমিকায় আজ “সমর স্মৃতি পাঠাগার”। অবশ্য এর সিংহভাগ কৃতিত্ব এই দেবজিত ব্যানার্জির।প্রায় একা কুম্ভের ভুমিকায় পাঠক তৈরীর কাজটি করে চলেছেন নীরবে। কলকাতার বড়বড় লাইব্রেরীগুলিতে যখন পাঠক সংখ্যার অভাবে করুন দশা সেখানে এই ছোট্ট লাইব্রেরীতে পাঠকের মেলা। বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ অফিসার দেবজিৎ ব্যানার্জি অবসর জীবনের এখন পুরোটাই এই লাইব্রেরীর জন্য নিবেদিত। মূলত তারই প্রচেষ্টায় এখন প্রতিনিয়ত বালীর “সমর স্মৃতি পাঠাগরে ৫০-৬০ জন পাঠকের উপস্থিতি, বই লেনাদেনার উজ্জ্বল ছবি। কাজটি কিন্তু সহজ নয় কেননা ঢিল ছোড়া দূরত্বে আছে এ বঙ্গের দুই নামী লাইব্রেরী ‘বালি পাবলিক লাইব্রেরী ’ও ‘উত্তর পাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী’।
অন্যদিকে মোবাইলের ক্ষনিক আনন্দের ফাঁদ পাতা ভুবনে ভয়াবহ পাঠবিমুখতা কিন্তু এই লাইব্রেরী সততই মুখর। বয়স্ক মহিলা পুরুষ থেকে কলেজ ছাত্র-ছাত্রী থেকে বহু গৃহবধু ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রাণের বাতায়ন এই পাঠাগার। কি করে সম্ভব করেছে এই দুরূহ কাজ? মিতভাষী দেবজিতবাবু যা জানালেন তা শিক্ষার এই টালমাটাল সময়ে যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। যে সদস্যরা অনিয়মিত হয়েছিলেন প্রথমেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা ফোনে যোগাযোগ করে সর্ম্পকের পুর্ননির্মানে ব্রতী হয়েছিলেন। প্রথম প্রথম শুরু করেছিলেন লাইব্রেরী কক্ষে শিক্ষামুলক সামাজিক অনুষ্ঠান, যে ধারা এখনো বহমান। একদা যে নিয়মিত পাঠক সংখ্যা ছিল ২০- ৩০ জন সেখানে এখন এই সংখ্যা প্রায় ২৫০। যে সমস্ত পাঠক লাইব্রেরী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাদের সাথে শুরু করেন ব্যক্তিগত যোগাযোগ। এই মুহূর্ত্তে প্রায় সক্রিয় ২৫০ জন সদস্যের নিয়ে তৈরী করেছেন এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ।
এই গ্রুপে শুধু অনুষ্ঠানের খবরাখবর নয় কোন সদস্য বেশ কিছুদিন অনুপস্থিতি হলেই তার খবরাখবর নেওয়া এই গ্রুপের বৈশিষ্ট্য। এই ভাবে এই পাঠাগার এখন এক সামাজিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্রভুমি হইয়ে উঠেছে। এই গ্রুপে অনেকেই পছন্দমত বই এবং তাঁদের মতামতকেও তুলে ধরেন। মতামতের গুরুতর অনুধাবন করে লাইব্রেরীয়ান ও অগ্রনী সদস্যদের সাথে আলোচনা করে সেই মতকে প্রাধান্য দেন। ফলেই পাঠকরাও এই পাঠাগারের মধ্যে খুঁজে পায় আত্মার আত্মীয়ের সম্বন্ধ। তাদের মতামত ভালোলাগা পছন্দ লাগার বই এবং নানান সামাজিক অনুষ্ঠানের মেলবন্ধনই এই পাঠাগারের ইউ এস পি। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কাজ তা হল বস্তি মহল্লায় বই পড়া এবং লাইব্রেরীতে আসার জন্য তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস। তিনি চলে যান নিকটবর্তী বস্তি অঞ্চলে সেখানে খুঁজে খুঁজে বার করেন পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের তারপর তাদের টেনে নিয়ে আসেন লাইব্রেরীতে। এদের অনেকেই আজ সবালম্বী কেউ বা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী। এই রকমই পরিবেশ থেকে উঠে আসা ইংলিশে এমএ-র ছাত্রী পূজা দাস।
যুব ছাত্র ছত্রীদের মধ্যে এই সাড়ায় উদ্দীপ্ত দেব জিত বাবু। সরকারি অনুদান এখন বিশেষ নেই, বিশেষত পত্র-পত্রিকা কেনার ব্যাপারে কিন্তু বাজারি পত্রিকা থেকে অনেক লিটল ম্যাগাজিনের এখাণে অফুরন্ত সম্ভার। আর এই পত্র পত্রিকার যোগানের ব্যাপারে তাঁর অভিনব পদ্ধতি। স্থানীয় হকারের কাছে ডাটা সংগ্রহ করে জেনে নেন কে কোন কোন পত্রিকা নেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করে দু’চারদিন পরে তাদের কাছ থেকে সেগুলো চেয়ে নেন কেননা এমন অনেক মানুষই আছেন যারা চান এভাবে সাহায্য করতে কিন্তু তাদের কাছে যাওয়ারই লোক নাই। এমনই অভিমত দেবজিতবাবুর। দেবজিত বাবু দেখানো পথ কষ্টসংকুল কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে যখন সব সার্ভিস ক্ষেত্রই টার্গেট নির্ভর সেখানে প্রত্যেক লাইব্রেরীয়ানের অন্তত মাসে পাঁচটি নতুন পাঠক সংগ্রক করার কথা উঠবে না কেন? মাসিক চাঁদা ছাড় দিয়ে লাইব্রেরী মুখী করা যাবে না নিতে হবে পাঠক সংগ্রহ করার উদ্যোগও। সংশ্লিষ্ট দপ্তর একবার ভেবে কি দেখবে এই প্রস্তাব!