• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

শিক্ষকের দায় ও দায়িত্ব

এই চারটি গুণ হল, বিদ্যা, বিনয়, বচন ও বপু! এর মধ্যে চতুর্থটি, অর্থাৎ বপু বা শিক্ষকের দৈহিক আয়তন বিষয়ে আমরা নীরব থাকব, কিন্তু অন্য তিনটি গুণ সহজেই বুঝতে পারি।

দেবনাথ পালিত

শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে শিক্ষা শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থের দিকে একবার ফিরে তাকাতে চাই। √ শিক্ষ্ + ণিচ্ + অক, এই হল শিক্ষক শব্দের বুৎপত্তিগত বিন্যাস। এখানে  শিক্ষ্ ধাতুর অর্থ হল শেখা বা জানা। এই ধাতুর সঙ্গে ণিচ্ প্রত্যয় যুক্ত হলে ধাতুটি একটি প্রযোজক ধাতুতে পরিণত হয়। তখন তার অর্থ হয়, অন্যকে শেখানো বা জানানো, যা আসলেই একজন শিক্ষকের কাজ। তাই শিক্ষককে বলা যায়, একজন প্রযোজক বা প্রবর্তক। শেখানো বা জানানো নামক ক্রিয়াটির ক্ষেত্রে শিক্ষকই হলেন প্রধান কর্তা। ফলে ব্যাকরণের নিয়মে কর্তৃবাচ্যের এই প্রাধান্যের ফলে এখানে অক(ণ্বুল) প্রত্যয়টিও যুক্ত হয়েছে। তাহলে, শিক্ষাজগৎ মূলত দুটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়, শেখা এবং শেখানো। একজন শিক্ষক প্রথমে ছাত্র, পরে শিক্ষক। প্রবর্তকের ভূমিকায় তখনই একজন শিক্ষক সাফল্য লাভ করেন, যখন শিক্ষক হয়েও তাঁর ছাত্রসত্তাকে তিনি বজায় রাখতে সক্ষম হন। এইভাবে দেখলে শেখা বা জানা হল এক নিরন্তর প্রক্রিয়া।

কোনো উৎসুক ছাত্র যদি অনুধাবন করে, যে তাঁর শিক্ষক সত্যই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তবেই একজন ছাত্র প্রকৃত বিদ্যার্থী হয়ে ওঠেন। নচেৎ, একজন বিদ্যাচর্চাকারীর ছাত্রকাল কেবলই প্রশ্নহীন মুখস্থবিদ্যার অনুশীলনে অতিবাহিত হয়। শিক্ষকের প্রধান কাজ তাই, ছাত্রকে সতর্ক করা। তর্ক শব্দের অর্থ চিন্তা। একজন ছাত্রকে চিন্তা করতে শেখানোই শিক্ষণের মুখ্য উদ্দেশ্য। শিক্ষণ বা শেখানোর ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ের উপস্থাপন তথা জ্ঞাপন-কৌশলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জানা এবং জানানো, একই প্রক্রিয়ার দুটি ভিন্ন দিক। কেবল জানলেই জানানো যায়না। শিক্ষককে জানতে হয় ও জানাতে শিখতে হয়। অনেকেই এই জানানোর কৌশল বিষয়ে সচেতন থাকেন না। যে কোনো জ্ঞানকে পরিস্থিতি সাপেক্ষে উপস্থাপন করতে না জানলে, বিদ্যার্থীর মনে বিষয়টি রেখাপাত করে না। কী বলব এবং কীভাবে বলব, উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেশাগত স্তরে এই জানা ও জানানোর চর্চা হল একজন শিক্ষকের জীবনব্যাপী সাধনা।

বঙ্গদেশের এক নমস্য শিক্ষক একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, শিক্ষকতায় সাফল্য অর্জনের জন্য চারটি গুণ থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। এই চারটি গুণ হল, বিদ্যা, বিনয়, বচন ও বপু! এর মধ্যে চতুর্থটি, অর্থাৎ বপু বা শিক্ষকের দৈহিক আয়তন বিষয়ে আমরা নীরব থাকব, কিন্তু অন্য তিনটি গুণ সহজেই বুঝতে পারি। শিক্ষা এবং বিদ্যা, যে দুটি ভিন্ন ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হচ্ছে, উভয়ের অর্থই হল শেখা বা জানা। কিন্তু এও আমরা মনে রাখি, যে বিদ্যা শব্দের √ বিদ্ ধাতুটি আসলে পরস্মৈপদী, অর্থাৎ পরের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।  অস্যার্থ, বিদ্যালাভের উদ্দেশ্য হল বিতরণ বা দান, আত্মপ্রয়োজন অপেক্ষা অন্যের প্রয়োজনটিই এখানেই প্রধান কথা।  বৃহদারণ্যক উপনিষদের পঞ্চম অধ্যায়ের দ্বিতীয় ব্রাহ্মণে “দম, দান, ও দয়া”প্রসঙ্গে একটি মনোজ্ঞ শ্লোক আছে। প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে দেব, মানুষ, ও অসুর হাজির হয়েছেন। তিনজনেই ব্রহ্মার উপদেশ প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা তিনজনকে বললেন, ‘দ’, তারপর জানতে চাইলেন কে, কী বুঝল? দেবতা বললে, দ অর্থে দাম্যত, অর্থাৎ দান্ত বা জিতেন্দ্রিয়, দমিত, সংযত হও। মানুষ বললে, দত্ত, অর্থাৎ দান করো। পরিশেষে অসুর বুঝল, দ অর্থে দয়ধ্বম, অর্থাৎ দয়া করো। তিন প্রবৃত্তির তিন কাজ। মানুষ তথা মনুষ্যরূপী শিক্ষকের পরম ধর্ম ও কর্ম হল দানশীলতা। তার মধ্যে বিদ্যাদান, মহত্তম দান। দানের দ্বারা আত্মস্বত্ব বিসর্জিত হয়, তা না-হলে দান হয়না।

এ প্রসঙ্গে একটি আপ্তবাক্য তো সকলেই জানেন, যে প্রকৃত বিদ্যা একজন বিদ্যার্থীকে বিনয়ী করে, অর্থাৎ নিরহংকারী করে কিন্তু এখানে বলার কথা হল, সকল বিদ্বানই কিন্তু বিনয়ী হয় না। বিদ্যা তাঁকেই বিনয়ী করে, যিনি পরোদ্দেশ্য মাথায় রেখে বিদ্যার্জন করেছেন। বিনয় একটি অনুশীলন-সাপেক্ষ বিষয়। বিদ্বান যদি আত্মরতি পরায়ণ হয়, তবে ছাত্র-সমীপে তিনি আর শিক্ষক থাকেন না, একজন বেহায়া কুস্তিবাজ রূপে প্রকাশিত হন। বাকি থাকল, বচন। বচন দুই প্রকার। মুখের বচন, আর মনের বচন। বিষয় যখন শিক্ষক, তখন যে শুদ্ধ বচনের কথাই আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের প্রাচীন মাস্টারমশাইরা বলতেন, বাকশুদ্ধির আগে চিত্তশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। অকুণ্ঠিত ও নির্ভীক অন্তঃকরণেই বিদ্যার অধিষ্ঠান, হৃদয়ের এই আসনটিকে নির্মল রাখলে বাকশুদ্ধি সহজ হয়।

শিক্ষক দিবসে শিক্ষকের এই দায়কে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। নিজকর্মে দায়বদ্ধ থাকাই দায়িত্বপালনের প্রথম ও প্রধান শর্ত। যে শিক্ষকের জন্মদিন স্মরণ করে আজ শিক্ষক দিবস পালিত হবে, সেই দার্শনিক অধ্যাপক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ একবার বলেছিলেন, “Education should be men making and society making”। কথাটি গুরুতর। সমাজ-রক্ষার এই গুরু দায়িত্বের কারণেই বিদ্যা, বিনয়, আর বচনের অনুশীলনে শিক্ষককে যত্নবান হতে হয়।

‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও’, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের এই হল মূল ভিত্তি। ছাত্র আছে বলেই তো শিক্ষক আছেন। শূন্য ক্লাসঘরে একজন শিক্ষক যে অসহায় ও অপূর্ণ কিন্তু এখানে শূন্য কেবলই সংখ্যাবাচক নয়, তা ভাববাচক। ভাব ও ভাবনার স্তরে শিক্ষক যদি নিঃশর্তে নিজেকে শূন্য করতে পারেন, তবেই তো তাঁর ছাত্র একদিন পূর্ণতা লাভ করে।

লেখক : অধ্যক্ষ,  দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়