• facebook
  • twitter
Tuesday, 14 January, 2025

শিক্ষার অগ্রগতি এবং গ্রন্থাগারের ভূমিকা

১৯৩১ সালে রাজ্য বিধান পরিষদে পেশ করা হয় নতুন একটি আবেদনও। তাতে দাবি করা হয় যে, দেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগারগুলির জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানের ভিতকে অতি অবশ্যই আরও মজবুত করার সুযোগও দিতে হবে।

ফাইল চিত্র

ডা. শামসুল হক

শিক্ষার অগ্রগতির জন্য গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা যে বিশাল সেকথা অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। তাই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ ছোট বড় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই থাকে নিজস্ব একটা গ্রন্থাগারও। সভ্যতার ক্রমবিকাশেও যে আছে গ্রন্থাগারের বিশাল ভূমিকা সেটাও নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষিত মানুষকে নতুনভাবে বোঝাবার প্রয়োজনও পড়ে না। অতএব মানুষেরই প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও সমাজের প্রতিটি স্তরেই যে আছে একটা করে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সেটাও আমরা অনুভব করতে পারি একেবারে মর্মেমর্মেই‌। আর সেটা কেবলমাত্র একজন মানুষের নতুন কিছু শিক্ষার কেন্দ্রস্থলই নয়, একজন মানুষের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে তথ্যাদি প্রেরণ করার‌ অন্যতম এক অবলম্বন হিসেবে বিবেচিতও হতে পারে বৈকি। যোগাতে পারে নতুন নতুন অনুপ্রেরণাও। মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উপযুক্ত এক বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে সেটা।

সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে তার যেমন আছে নির্দিষ্ট একটা ভূমিকা, ঠিক তেমনই নিরক্ষরতা দূরীকরণ সহ অন্যান্য আরও অনেক সমাজসেবামূলক কাজে গ্রন্থগারের প্রয়োজনীয়তা যে সত্যি সত্যিই আছে তা স্বীকার করতেই হবে। তাইতো বিশ্বের সর্বত্রই তার ভিতটাকে মজবুত করে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়েই নেওয়া হয়েছিল নানান পদক্ষেপও। আর তার শুভ সূচনা হয়েছিল বিলেতের মাটিতে। প্রায় শুরুর সময় থেকেই গ্রন্থাগার নিয়ে অজস্র চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল আমাদের দেশেও। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সূত্রপাত তার। ছোটখাটো আন্দোলনের মাধ্যমেই নেওয়া হয়েছিল প্রথম পদক্ষেপ। আর তারপর থেকেই একে একে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হতে থাকে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি, চেন্নাই তথা তৎকালীন মাদ্রাজের লিটারারি সোসাইটি এবং মুম্বই এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিও। আর তারপর‌ আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ, হিন্দু কলেজ তো বটেই, মফঃস্বলের শ্রীরামপুর কলেজের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত হয় নিজ নিজ গ্রন্থাগার। তারপর তা বিস্তার লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের মাঝখানেও। কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তা স্থাপিত হয় কেবলমাত্র সেখানকার পড়ুয়াদেরই পঠন পাঠনের সুবিধার্থেই।

১৯১০ সালে বরোদার মহারাজ সায়াজিরাও সাহেব এই বিষয়ে আরও বেশি বেশি মাথা ঘামাতে শুরু করেন এবং তাঁরই প্রচেষ্টায়‌ গ্রন্থাগার নিয়ে শুরু হয় নতুন আন্দোলনেরও। মুষ্টিমেয় কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়েই তিনি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং অবশেষে স্থাপিত হয়েছিল বরোদা পাবলিক লাইব্রেরীর। গ্রাহক চাঁদা ছাড়াই সেখানে পাঠক পাঠিকাদের বই দেওয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করাও সম্ভব হয়েছিল তাঁর‌ প্রচেষ্টাতেই। তারপরই জেগে উঠেছিল সমগ্র দেশ। গ্রন্থাগার নিয়েও ভীষণভাবে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত প্রান্তের মানুষজনও। হাতে গোনা যে কয়েকটা পাঠাগার স্থাপিত হয়েছিল সেখানেও যেন শুরু হয়েছিল উৎসবের মেজাজ।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারপরই শুরু হয় গ্রন্থাগার সন্মেলনের তোড়জোড়। ১৯৪০ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানীতে অতি ধুমধাম সহকারে তার শুভ সূচনাও হয়। তাতে বহু উৎসাহী মানুষেরও সমাগম ঘটে। তাতে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য আরও অনেক গ্রন্থগার কর্মীরাও। সেইসময় তাঁদের প্রচেষ্টাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় অন্ধ্রপ্রদেশ লাইব্রেরী অ্যাসোসিয়েশন। সেই সন্মেলনের পর পরই সারা দেশ জুড়েই গ্রন্থাগার কর্মীদের মনের মধ্যে বইতে শুরু করে খুশির জোয়ার এবং তার পরপরই তাঁরা নতুনভাবেই উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বলা যেতে পারে সেই মুহূর্তে তাঁদের মন এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে যে, দেশের নতুন নতুন আরও অনেক জায়গায় সেই ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করার জন্য প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেন।

১৯১৮ সালে তা ফলপ্রসূও হয়। লাহোরে আয়োজন করা হয় তেমনই এক সন্মেলনের। দেশের মধ্যে আয়োজিত দ্বিতীয় সেই সন্মেলনেও যোগ দেন গ্রন্থগার কর্মী সহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীরাও। যোগ দেন অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীও। আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া লাইব্রেরী অ্যাসোসিয়েশন নামক স্বাধীন একটা সংস্থাও। সেই সংস্থারই ডাকে ১৯১৯ সালে চেন্নাই শহরে আরও একটা সন্মেলনের আয়োজন করা হয়। ১৯২৪ সালে বেলগাঁও কংগ্রেসের তৎপরতায় আয়োজিত হয় আরও একটা সন্মেলনের। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আবার নেতৃত্ব দেন সেই অনুষ্ঠানের। ফলে নেওয়া হয় নতুন নতুন আরও অনেক পদক্ষেপই। আর তারপর‌ নতুনভাবেই সেজে উঠতে শুরু করে সমগ্র গ্রন্থাগার প্রাঙ্গনই।

১৯২৫ সালের ২০ ডিসেম্বরের দিনটি হল সমগ্র ভারতীয় গ্রন্থাগারেরই অতি গৌরবময় আরও একটি দিন। সেইদিন কলকাতার অ্যালবার্ট হলে আয়োজন করা হয়েছিল আরও বড় একটা অনুষ্ঠানের। সেইদিন স্থাপিত হয় নিখিলবঙ্গ গ্রন্থাগার পরিষদেরও। আর সেই কাজ সুসম্পন্ন হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ববধানেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিগুরু অবশ্য হাজির থাকতে পারেননি শারিরীক অসুস্থতার কারণেই। কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করে তিনি একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সংগঠকদের কাছে। চিঠিটা পাঠও করা হয়। সেইদিন কবিগুরুর অনুপস্থিতিতে অ্যালবার্ট হলের সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিক জে. এ. চ্যাপম্যান সাহেব।

বিভিন্ন গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে তারপরই শুরু হয়ে যায় নব জোয়ার। আরও নতুন নতুন অনেক কিছুর সংযোজন ঘটিয়ে সেখানে আনার চেষ্টা করা হয় আধুনিকতার ছোঁয়াও। ১৯৩১ সালে রাজ্য বিধান পরিষদে পেশ করা হয় নতুন একটি আবেদনও। তাতে দাবি করা হয় যে, দেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগারগুলির জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানের ভিতকে অতি অবশ্যই আরও মজবুত করার সুযোগও দিতে হবে। চেষ্টা অনেক চলেছিল। কিন্তু নিয়মেরই নানান ফাঁকফোকর এড়িয়ে সেটা আর আইনে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগই পায়নি। বস্তুত ইংরেজ আমলে বারবার ব্যর্থ হয়েছে সেই প্রচেষ্টা। অবশেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে তা ফলপ্রসূ হয়। চালু হয় নতুন লাইব্রেরি অ্যাক্ট। তৎকালীন মাদ্রাজের পাবলিক লাইব্রেরিতেই হয় তার শুভ সূচনা আর সেটাই হল আমাদের স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম প্রদেশ ভিত্তিক গ্রন্থাগার আইন। আর তারও অনেক পরে আমাদের এই বঙ্গভূমিতে প্রচলিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সাধারণ গ্রন্থাগার আইন ১৯৭১ সালে।

তারপর কেটে গেছে আরও অনেকগুলো‌ বছর। উন্নতির অনেক জোয়ারও বয়ে গেছে গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে। বেড়েছিল পাঠকের সংখ্যাও। জ্ঞানের আলোয় ভরপুর হয়ে উঠেছিল মানুষের মনপ্রাণও। কিন্তু তারপর কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেল। এসে গেল কম্পিউটারের যুগ। ছেলে বুড়ো সকলেরই হাতে হাতেও ঘুরতে লাগল মুঠোফোন। বলাই বাহুল্য, সেইগুলোই তখন হয়ে উঠল বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন। আর ঠিক তখনই আস্তে আস্তে পাঠাগারের মধ্যে কমতে শুরু করেছিল পাঠকের সংখ্যাও। একটা সময় যে সমস্ত মানুষ ছিলেন একেবারেই লাইব্রেরী পাগল, তাঁরাও বদলাতে শুরু করলেন। ভুলে যেতে শুরু করলেন সেই পথটাও। ফলে ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। একটা সময় তো লাইব্রেরি কক্ষ হয়ে উঠল একেবারে পাঠক শূণ্যই।

সেইসব দেখেশুনে রাজ্য সরকারকেও নড়ে চড়ে বসতে হল। শহর এবং গ্রাম, সব স্থানেরই মানুষজনকে আবারও পাঠাগারমুখী করার জন্য নতুনভাবে ভাবতে শুরু করলেন মন্ত্রী মহোদয়রাও। নিলেন নিত্য নতুন পরিকল্পনাও। ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন জনশিক্ষা প্রসার গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব সিদ্ধিকুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে আয়োজন করা হয়েছিল বর্ষব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও। সরকার পক্ষের নেওয়া সেই আয়োজনের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই ছিল না কোন আন্দোলনেরই ছোঁয়া। কিন্তু সমগ্র বিষয়টাকে জনমুখী করে তোলার জন্য তার মধ্যেই যে ছিল একটা নির্মল প্রয়াস এবং অতি অবশ্যই বৃহৎ এক চিন্তাভাবনাও সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।

মোট বাহান্নটা দিবস পালনের আয়োজন করা হয়েছিল। সুষ্টভাবে তা সম্পাদিতও হয়েছিল। ফলাফলও মিলতে শুরু করেছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই মানুষের সামনে হাজির হয়েছিল অন্য আর এক বিপত্তি। লকডাউনের আবির্ভাবই তখন উল্টে দিয়েছিল সব হিসেব। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পাঠাগারের দরজা জানালা। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পঠন পাঠনের সব রাস্তাও। অতএব এখন নতুন কিছু একটা পথের সন্ধান করতেই হবে। সকলকেই আবার নড়েচড়ে বসতে হবে এবং সমস্ত জায়গার পাঠক পাঠিকাদের আবারও লাইব্রেরী মুখী করতেই হবে।