তোতা কাহিনী ও বর্তমান শিক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতি

প্রচলিত তোতা কাহিনীর একটি কাল্পনিক চিত্র।

তন্ময় সিংহ

“এক-যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।’ মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’

১৯২২ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্প যেন আজকের দিনের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বাস্তবতা। সকলকে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে, সকলকেই স্বাক্ষর করতে হবে, দুটি মহৎ উদ্যোগ কিন্তু তার প্রয়োগ অনেকাংশে উল্লিখিত “তোতাকাহিনী” গল্পের মতোই। তারই ফলস্বরূপ আজকে এক অন্তঃসারশূন্য শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এখান থেকে উৎপাদিত ফসল অর্থাৎ ছাত্রসমাজ সার্টিফিকেটের বহর থাকলেও ভিতরে শুধুই খসখস। পশ্চিমবাংলার যে ছাত্র সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে তার সামগ্রিক জ্ঞানের জন্য এবং মূল্যায়নের জন্য বিখ্যাত ছিল বর্তমান দিনে এই শিক্ষানীতির প্রয়োগে আমরা দেখতে পাচ্ছি খাতায় কলমে স্বাক্ষর সমাজ তৈরি হলেও আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।


শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ করার সাথে সাথে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে সবাইয়ের জন্য সর্বাঙ্গীন করা হয়েছে এবং তার সাথে তুলে দেওয়া হয়েছে পাশ ফেল প্রথা। প্রথম উদ্দেশ্যটি মহৎ হলেও দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি খাতায়-কলমে সাক্ষরতা বাড়িয়েছে এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থার চূড়ান্ত অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। একটি বিদ্যালয়ে বছরে তিনবার পরীক্ষা হলেও কখনও দশ নম্বরের মূল্যায়ন কখনো কুড়ি ও কখনো ৫০ নম্বরের মূল্যায়ন ছাত্র-ছাত্রীদের মন থেকে পরীক্ষা ভীতি দূর করতে সক্ষম হলেও, বিষয় সম্পর্কে এবং পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদের অন্ধকারে পাঠিয়েছে। সহজেই মূল্যায়নে সফল হয়ে তারা আইন প্রণেতাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আসলে আইন প্রণেতারা হয়তো সারাদেশ জুড়েই সমাজের প্রান্তিক মানুষ গুলোকে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু বাস্তব সমাজে একজন নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীর সাধারণ গণিত ও ইংরেজি উপরে দখল অনেক সময় নগণ্য বা শূন্য। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছাত্র-ছাত্রীরাও, ইংরেজিতে ছেড়ে দিন সাধারণ বাংলাতেও অনেক সময় দরখাস্ত লিখতে অক্ষম। আমরা সকলেই আলোচনা করি প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দিয়ে বিগত বাম সরকার ঐতিহাসিক ভুল করেছে,এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।‌ অন্যদিকে শিক্ষা শুধুমাত্র রাজ্যের না জাতীয় বিষয় হওয়ার জন্যই, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও জাতীয় শিক্ষাক্রম মেনে চলতে বাধ্য হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বর্তমানে চালু হওয়ার পথে সেই সময় দাঁড়িয়েও দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা ঠান্ডা করে বসে শিক্ষার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি এক কথায় নিশ্চিত করলেন।

“পণ্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী। সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য খড়কুটা দিয়া পাখি যে বাসা বাঁধে সে বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া খাঁচা বানাইয়া দেওয়া। স্যাকরা বসিল সোনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশবিদেশের লোক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, ‘শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ।’ কেহ বলে, ‘শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তো হইল। পাখির কী কপাল।'” আমাদেরও বর্তমান শিক্ষার হাল অনেকটাই পাখিটার মত। ব্যবস্থা করা হয়েছে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকের, ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রায় বিনামূল্যে পড়াশোনা করার, ব্যবস্থা করা হয়েছে দুপুরের খাবারের, ব্যবস্থা করা হয়েছে পাশ ফেল বিহীন এক মূল্যায়ন ব্যবস্থার। সব মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কিছু জানুক আর নাই জানুক গড় গড়িয়ে উঠে চলেছে নতুন নতুন শ্রেণীতে। এরই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শাসন বিলুপ্ত করা হয়েছে, সমাজ মোবাইল নামক এক দৈত্যের আবির্ভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কোমল মন কলুষিত হচ্ছে। রীল, ভ্লগ আর সফট পর্নের মাঝে আটকে যাওয়া শৈশব ও কৈশোর আমাদের সামনে এক ভয়ঙ্কর দুর্দিন নিয়ে আসছে। সহজে রোজগার করার এই ব্লগার দুনিয়ার কর্মপদ্ধতিতে আটকে যাচ্ছে যুব সমাজ, কর্ম বিমুখ হচ্ছে প্রচলিত শারীরিক পরিশ্রমসাধ্য কর্ম থেকে। ছাত্র-ছাত্রীদের উপরে প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি যখন বিদ্যালয়ে যখন প্রথম ছাত্রছাত্রীদের আটকে রাখা হচ্ছে, মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে দেওয়া টেস্ট পরীক্ষাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর ছাত্র-ছাত্রীদের অনৈতিক দাবি, পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ দেখে দেখে পরীক্ষায় লিখতে দেয়ার জন্য বিক্ষোভ ইত্যাদি ইত্যাদিতে।

বিভিন্ন সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতির ও রাজ্যের শিক্ষা নীতির সমস্ত প্রকল্পগুলির মধ্যে যদি কোন প্রকল্প সর্বস্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য লাভদায়ক এবং বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে, তাহলো মিড ডে মিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং উচ্চ বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিল নিশ্চিত হওয়ায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি সত্যিকারের বেড়েছে। শহরাঞ্চলে সামান্য কিছু শতাংশ বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল সেইভাবে কার্যকরী নয়, কিন্তু দেশের বাকি অংশে এই প্রকল্পটি ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় মুখী করতে প্রচন্ড সহায়তা করেছে। ‌ প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে ৮ টাকা ১৭ পয়সা প্রতি ছাত্র পিছু বরাদ্দে, শুধুমাত্র চাল সরবরাহ করে কিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পুষ্টিকর দুপুরের খাদ্য সরবরাহ করা যায়, এই প্রকল্পটি সেই আশ্চর্য বিস্ময় এবং ভবিষ্যৎ কালে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির এবং আমাদেরও সমাজের মাধ্যমে গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে বর্তমান সময়ে যদি তামিলনাড়ুর মতন কোন জায়গা থেকে মিড ডে মিল সরবরাহ করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত বিদ্যালয়ে তাহলে বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা আরো ভালোভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। “সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, ‘খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না।’ বিভিন্ন সময় সমাজের সর্বস্তর থেকে পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার জন্য বিরুদ্ধে স্বর উঠে আসায় ও এর প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার তুলে ধরায় কেন্দ্রীয়ভাবে তৃতীয় পঞ্চম ইত্যাদি ক্লাসগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান ও একবার অধিকার করে ফেলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আদতে এই ধরনের মূল্যায়ন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কতোটা সহায়ক। ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পূর্ণ বই না পড়ে বা বইয়ের রচনাধর্মী প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ বাইরে রেখেই পরীক্ষার প্রশ্ন করতে হয় ১০ নাম্বার ও ২০ নাম্বারের শুধুমাত্র বাৎসরিক পরীক্ষা ৫০ নাম্বারে হয়। সারা বছর পড়ার পর বা তিন মাস বা ছয় মাস পড়ার পর এই পরীক্ষাতে কতটা যাচাই হয় সে প্রশ্নটা অবশ্যই থাকলো কর্তৃপক্ষের কাছে। খাতায় কলমে পাশ ফেল বিহীন মূল্যায়ন ব্যবহারিক শিক্ষায় কতটা উপযোগী সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।

“নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল, ‘পাখি মরিয়াছে।’
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, ‘ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।’
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।” এইভাবে আমাদেরও একজন ছাত্র-ছাত্রী তার ছাত্র জীবনে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গুলি করার পরেও শিক্ষিত বেকারের তকমা নিয়ে বসে থাকে। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাশ ফেল প্রথা থাকতো এবং অনুত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিকল্প পাঠ্যক্রম যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা সেই বিষয়ে পারঙ্গম হয়ে তাদের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। আমরা যদি অন্তত চতুর্থ শ্রেণিতে একবার পাশ ফেল প্রথা করতে পারি তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের দরকার হলে এক বছর বা দু’বছর রেখে তালিম দিয়ে তাদের পরবর্তী ক্লাসে পাড়তে পারবো। আবার যদি আমরা ষষ্ঠ শ্রেণি এবং অষ্টম শ্রেণীতে পাশ ফেল প্রথা রাখতে পারি তাহলে আমরা এই সময়ের অনুত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে হয় ওই ক্লাসেই আরেকবার পড়ার সুযোগের ব্যবস্থা অথবা বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা যা পরবর্তীকালে পরিষেবা দেওয়ার কাজ গুলিতে জীবিকা নির্ধারণের সুযোগ করে দেবে সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের আমরা পাঠদান করতে পারি। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে এই পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা ক্লাসরুম এবং আলাদা শিক্ষক-শিক্ষিকার ব্যবস্থা অবশ্যই করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা এই পাশ ফেল ব্যবস্থা পরিমার্জন করলে তার‌‌ সহায়ক হিসেবে অবিলম্বে সংযোগ করা দরকার না হলে আগামী দিনে সারা বিশ্বে তরুণ প্রজন্মের জন্য ভারতের বেকারত্বের পরিমাণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
“রাজা বলিলেন, ‘একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।’ পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্‌খস্‌ গজ্‌গজ্‌ করিতে লাগিল।”

চিত্রঋন- সমাজমাধ্যম