শিক্ষক নিয়োগের অচলাবস্থায় এবারে বিহারেই বাংলার পরিযায়ী শিক্ষক

স্বপনকুমার মণ্ডল

বছর চারেক আগে করোনাকালে সারা দেশজুড়ে লকডাউনের দুর্দশায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ অস্তিত্ব-সংকট নিবিড় হয়ে ওঠে। তাঁদের পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার দুর্বিষহ দৃশ্য দেখে দেশবাসী শিউরে উঠেছিল। তখন বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল মনে। যেন করোনার করুণায় দেশের মানুষ দুর্দশার বাস্তব চিত্র আবিষ্কার করার অবকাশ পেল। সেখানে বিশেষ করে এই রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা যে বিপুল পরিমাণে বিদ্যমান এবং তাঁদের অধিকাংশই পরিযায়ী হয়ে রাজ্যের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন শহর-নগর-বন্দরের কাজে সামিল হয়ে থাকে। করোনার ভয়াবহ পরিণতিতে তা বেরিয়ে পড়ে। করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে গিয়ে রাজ্যের মানুষের অস্তিত্ব-সঙ্কটও আমাদের তখন ভাবিয়ে তোলে। সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বা আশঙ্কা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। রাজ্যেও ভিনদেশি পরিযায়ী শ্রমিকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রতিযুক্তি সাজানো যেতেই পারে। তাতে রাজ্যের করুণ চিত্র কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কাজের অভাব থেকেই যে রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ওঠার মূলাধার, তার পরিচয় এখনও অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের রাজ্যের বাইরে কাজে যাওয়ার অব্যাহত গতিতে প্রতীয়মান। সেখানে তীব্র বেকারত্বে দিশাহীন যুবসমাজের মধ্যেও পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কাজের খোঁজে রাজ্যের বাইরের যাওয়ার প্রবণতা অপ্রত্যাশিত নয়। সেই প্রত্যাশায় পরিযায়ী শ্রমিক থেকে পরিযায়ী শিক্ষকের আবির্ভাবে রাজ্যের করুণ চিত্রকে আরও বেলাগাম করে তুলেছে।

পার্শ্ববর্তী যে রাজ্যটি সম্পর্কে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ বলে সভ্যতাগর্বীদের মুখে খই ফুটতো, সেই বিহারই সারা রাজ্যে এখন মদ্যপান নিষিদ্ধ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও স্বচ্ছ নিয়োগের আয়োজন করে নতুন পথের দিশারি হয়ে উঠেছে। সেই স্বচ্ছতার আলো এই রাজ্যের সুশিক্ষিত বেকারদের মনেও আশার আলো সঞ্চার করেছে। ইতিপূর্বের স্বচ্ছ নিয়োগের অভিজ্ঞতাই তাঁদের মনে নতুন করে বাঁচার সদিচ্ছা জেগে উঠেছে। গত ২৮ মে, ২০২৪ শুধুমাত্র বাংলা বিষয়ের শিক্ষকের টেট পরীক্ষার (১৮-২৯ মে ‘বিহার সেকেন্ডারি টিচার এবিলিটি টেস্ট’ চলে) জন্য হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার বাংলা থেকে পাটনার উদ্দেশে রওনা হয়। এভাবে তাদের পরিযায়ী শিক্ষক হয়ে ওঠাটা যে তাঁরা কখনও ভাবতেই পারেনি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তা নিয়ে অনেকের পোস্টেই তা প্রতীয়মান। একদিকে যখন রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফার আয়োজন চলছে, অন্যদিকে তখন বাংলার বেকার যুবক-যুবতীদের মনে পরিযায়ী শিক্ষকের দুঃস্বপ্ন নিবিড় হয়ে উঠছে, ভাবা যায়!


আসলে বাঙালির আর কিছু থাক বা না-থাক, পাণ্ডিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক। তর্কযুদ্ধে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি সদা সচল। শুধু তাই নয়, ভাবুক প্রকৃতির মধ্যেও তাঁর পণ্ডিতম্মন্যতা বর্তমান। পেশাদারিত্বেও বাঙালির পণ্ডিত হওয়ার বাতিক। ‘যার নেই গতি, সে করে পণ্ডিতি’র মধ্যে পণ্ডিতের দারিদ্রপীড়িত জীবন বেরিয়ে এলেও তার মধ্যেই বাঙালির হাতের পাঁচে পাণ্ডিত্যের আভিজাত্য বেরিয়ে পড়ে। নেপালি বেকাররা কিছু না পেলে যেমন গাড়ির চালক হয়, বাঙালি বেকার তেমনই টিউশন করে। এই পড়ানোর মধ্যে শুধুমাত্র দারিদ্র্যমোচনের উপায়ই জারি না, পাণ্ডিত্যের ক্ষুধাও সক্রিয় থাকে। সেখানে অধিকাংশ বাঙালির কাছেই শিক্ষকতার পেশা শুধু চাকরির সাধই বয়ে আনে না, স্বপ্নপূরণের হাতছানি দিয়ে চলে। এজন্য অধিকাংশের মনেই শিক্ষক-শিক্ষিকার সাধ-স্বপ্নের মধ্যেই নতুন জীবনের প্রতীক্ষা জেগে থাকে। সেখানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার আয়োজনের মধ্যেই হবু শিক্ষকের স্বপ্ন নিবিড় হতে থাকে। শিক্ষার সৌরভ ও গৌরবের মধ্যেই শিক্ষকতার লক্ষ্য সীমাবদ্ধ থাকে না, পবিত্র পেশা হিসেবেও তার বনেদি আভিজাত্য বাঙালির চোখে মুখে অজান্তেই বেরিয়ে পড়ে। এখনও নেই রাজ্যের মধ্যেও শিক্ষকের শ্রদ্ধার আসনে নিজেকে দেখার স্বপ্ন অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যেই চোখের কাজল হয়ে জেগে থাকে।

সেখানে দীর্ঘকাল ধরে (২০১৬-র পরে এস এস সি পরীক্ষা আর হয়নি) রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে রয়েছে, যাও হয়েছে, তাও দুর্নীতির শিকারে পর্যুদস্ত। শিক্ষাক্ষেত্রেও বেহাল দশা। আগে শিক্ষার উৎকর্ষকেন্দ্র ছিল এই রাজ্য। সেই রাজ্যেই আজ যোগ্য শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে অবিরত। নিয়োগে দুর্নীতির পাহাড় ডিঙিয়ে নতুন সূর্যের আলোর সম্ভাবনাও আর দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সেই দুর্নীতির ফাঁসে বেকার যুবক-যুবতীদের স্বপ্নই আজ মৃত্যুশয্যায় পাঞ্জা লড়ছে। সেখানে বেঁচে থাকার বিশল্যকরণী জোগানোর সদিচ্ছা নিয়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে পররাজ্যে পাড়ি দেওয়ার মধ্যে কোনও গৌরব নেই। আছে শুধু আত্মধিক্কার আর স্বদেশে বঞ্চিত হওয়ার তীব্র হাহাকার। আমরা অনেক সময় মেধার দেশান্তর নিয়ে সখেদে দুঃখ প্রকাশ করি। অথচ তার জন্য আমরাই দায়ী, সেকথা আমরা ভুলে যাই। শিক্ষা শেষে নিজেকে যথাযোগ্যভাবে গড়ে তুলেও আজ রাজ্যের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের পরিযায়ী শিক্ষকে পরিণত হতে হচ্ছে, এ তো শিক্ষাব্যবস্থার দেউলিয়াপনা। রাজ্যের সুশাসনের অভাবের অনন্য নিদর্শন।

বঞ্চিত ও যোগ্যদের দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে রাস্তার আন্দোলন এখনও জারি। তার মধ্যে পরিযায়ী শিক্ষকদের অবিরাম পথচলায় রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা আরও নগ্ন হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসের অভাবে সন্দেহ নিবিড় হয়ে ওঠে। যে শিক্ষা মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে, সেই শিক্ষাই আজ জীবনের বাতিঘর নেভানোর আয়োজনে সামিল হয়েছে। অবিশ্বাসী মনে কেউ স্বপ্ন দেখতে পারে না, দেখে শুধু দুঃস্বপ্ন। যে শিক্ষা মানুষকে সম্পদে পরিণত করে, সেই শিক্ষাই আজ মানুষকে দেউলিয়া করে তুলেছে। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা রাজ্যটি যখন শিক্ষা বিস্তারে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তোলায় মরিয়া, তখন এই রাজ্যের করুণ পরিণতিতে শিক্ষাক্ষেত্রেই মানবসম্পদের অপব্যবহারে চরম দুরবস্থার বিস্ময় সৃষ্টি করে। একে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে, অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগের আয়োজনে অচলাবস্থা জারি। এই শাঁখের করাতে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও হবু শিক্ষকদের ত্রিবেণী সংকটে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার অচলাবস্থা যে ক্রমশ কত ভয়ঙ্কর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, পরিযায়ী শিক্ষকের পথচলাতেই তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে !