আলোর মেয়ে মেরি কুরি

পর্ব-৪

দু’বার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরি। মাদাম কুরি নামেও তিনি পরিচিত। তাঁর ডাকনাম ছিল মানিয়া। শৈশব থেকে মানিয়ার বড় হয়ে ওঠার গল্প ধারাবাহিকভাবে লিখছেন
সিদ্ধার্থ মজুমদার।

মেরির গবেষণা জীবনের স্বপ্নবোনা
আগের পর্বে আমরা পড়েছি, ১৮৯৩ সালে প্যারিসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে ‘মাস্টার অফ সায়েন্স’ পরীক্ষায় প্রথম স্থান এবং পরের বছর অঙ্ক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন মেরি।


কিন্তু এখানেই থামতে চান না মেরি। এরপর পিএইচডি-র জন্যে গবেষণা করতে চান মেরি। তবে চাইলেই তো গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া যায় না। গবেষণাগার, নির্দেশক এবং প্রয়োজনীয় অর্থ দরকার। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়, সরবোনে মেরির শিক্ষক ছিলেন গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান। ছাত্রীর দরকারে এবার তিনি একটি গবেষণাগারে কাজ ও ছ’শো ফ্রাঁ বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। কাজটি ছিল, স্টিলের চৌম্বকত্ব পরীক্ষা করার। মেরি দেখলেন, এই কাজের উপযুক্ত সেরকম যন্ত্রপাতি না থাকায়, নিখুঁত ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা খুব কঠিল হচ্ছিল।

এই সময়, একদিন মেরির স্বদেশবাসী এক অধ্যাপক তাঁর বাড়িতে মেরিকে নিমন্ত্রণ করেন। সেখানেই সেই অধ্যাপক পরিচয় করিয়ে দেন, পদার্থবিজ্ঞানের একজন তরুণ অধ্যাপকের সঙ্গে— নাম পিয়ের কুরি। মেরি দেখল, সোনালি রঙের চুল, বড়ো বড়ো চোখ আর লম্বা-চেহারার একজন তরুণ দাঁড়িয়ে আছেন জানালার বাইরে তাকিয়ে। তাঁর স্বচ্ছ ও উদাস দু-চোখে স্বপ্ন জড়ানো! পদার্থবিদ পিয়ের কুরি (Pierre Curie) সেসময় প্যারিসের স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রি প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক। বিজ্ঞান ভাবনা ও সামাজিক নানান প্রসঙ্গ নিয়ে মেরি ও পিয়ের কুরির আলোচনা হল সেদিন। সেই সন্ধের আলোচনা থেকে তাঁদের মতামত যে অভিন্ন তা বুঝতে পারলেন দু’জনেই। পিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন পরবর্তী সময়ে আবার মেরির সঙ্গে যাতে দেখা হয় এবং আলোচনা করা যায়। মেরিকে তাঁর গবেষণা বিষয়ে বলার সময় পিয়ের যেন ভাবনার গভীরে ডুবে যাচ্ছিলেন। মেরি বুঝতে পারেন, পিয়েরের ধ্যান-জ্ঞান বলতে শুধুই বিজ্ঞান।

মেরি ঠিক করলেন, একবার নিজের দেশের বাড়ি যাওয়ার। বাড়ি যাওয়ার সময় মেরি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না আবার প্যারিস ফিরবেন কি না! ফিরে আসার একটা সুযোগ এসে যাওয়ায় আবার ফিরে এলেন মেরি। যাই হোক, চুম্বকত্ব বিষয়ে পারদর্শী অধ্যাপক পিয়ের কুরি। তৈরি করেছেন, গবেষণা উপযোগী অনেক যন্ত্রপাতি। ইচ্ছুক হলে পিয়েরের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে মেরি কাজ করতে পারেন, মেরিকে প্রস্তাব দিলেন পিয়ের। মেরি সেখানে কিছুদিন স্টিলের চৌম্বকত্ত্ব পরীক্ষা করার কাজ শুরু করলেন, পিয়েরের তৈরি সূক্ষ্ম ও সংবেদী যন্ত্রপাতি দিয়ে। কিছু সময় পরে সরবোন-এ একটি ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে ডক্টর‍্যাল থিসিসের প্রস্তুতির গবেষণামূলক কাজের সুযোগ পেলেন। সরবোনে গিয়ে, সেখানেও আবার পিয়েরের সঙ্গে দেখা হয় মেরির। তাঁদের দুজনের গবেষণার কাজের সুবাদে দেখা- সাক্ষাৎ বারতে থাকে। মেরি এবং পিয়েরের কথায় আবার আসব, তার আগে মেরি তখন তাঁর ডক্টর‍্যাল গবেষণার বিষয় কী হবে, তা নিয়ে ভাবছেন ও পড়াশোনা করছেন।

সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানে কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কার
মেরি জানতেন, কয়েক বছর আগে জার্মানির পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম রয়েন্টগেন (Wilhelm Rontgen) ‘X-Ray’ আবিষ্কার করেছেন। যা অদ্ভুত একধরনের রশ্মি। যা ‘আলো’ নয়। এরকমই অদ্ভুত রশ্মি যখন কোনও মানুষের শরীরের ওপর দিয়ে পাঠানো হয়, উলটো দিকে শরীর ফুঁড়ে তা বেরিয়ে যায়। উলটো দিকে ‘ফোটোগ্রাফিক ফিল্ম’ রাখলে তখন সেই ফিল্মে মানুষটির হাড়ের ছবি ওঠে। কী ধরনের ‘রশ্মি’ সেসময়য় বিজ্ঞানীরা তা বুঝতে পারেননি। তবে, বিচিত্র ওই রশ্মি, বিজ্ঞান জগতে হইচই ফেলে দিয়েছিল। অজানা কোনও কিছুকে ইংরেজি আলফাবেট ‘X’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। তাই ওই রশ্মির নাম হয় ‘এক্স-রে’।

এর কয়েকমাস পরেই ফরাসি দেশের হেনরি বেকরেল (Henri Becqerel) নামের একজন পদার্থবিদও এক ধরনের রশ্মির খোঁজ পেলেন। চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, এই ‘আভা’ বা রশ্মি, নির্গত হয় ‘ইউরেনিয়াম’ যৌগ থেকে। চোখে দেখা যায় না, তাহলে এমন রশ্মি বের হচ্ছে, তা বুঝেছিলেন কী করে বেকরেল? কী করে জানা গেল সেই গল্পটা বলি। হয়েছিল কী, টেবিলের ড্রয়ারে কাগজে মুড়ে রাখা ছিল ইউরেনিয়াম যৌগ। আর ওই একই জায়গায় আগের থেকেই অন্য কোনও কাজের জন্যে একটি ফোটোগ্রাফিক ফিল্মও রাখা ছিল। পরের দিন সকালে ড্রয়ার খুলে দেখতে পান, ইউরেনিয়ামের সঙ্গে থাকা ফোটগ্রাফিক প্লেটটি কালো হয়ে গেছে! বেকরেল আশ্চর্য হয়ে গেলেন, কেন এমন হল? কেন হল, সেই কারণ বুঝতে বেশি সময় লাগল না বেকেরেলে। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম থেকেই যে অবিরাম এক ধরনের রশ্মি বেরিয়ে আসে, আর সেটিই ফোটোগ্রাফিক ফিল্ম কালো করে দিয়েছে। আরও পরীক্ষা চালিয়ে বেকরেল নিশ্চিত হয়েছিলেন, ‘ইউরেনিয়াম যৌগ’ থেকে বেরোনো যে রশ্মি, তা রয়েন্টগেনের ‘এক্স-রে’-র থেকে আলাদা। কিন্তু এই ‘রশ্মি’ ঠিক কী, তা নিশ্চিত হতে পারলেন না। এই রশ্মির নাম দেওয়া হল ‘বেকরেল রশ্মি’।
আরও একটি নতুন বিষয় ওই একই সময়ে জানা গেল। ব্রিটেনের বিজ্ঞানী জে জে টমসন খুঁজে পেলেন একধরনের কণিকা। যার নাম ‘ইলেকট্রন’। এই ইলেকট্রন কণা প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যেই থাকে। ইলেকট্রন কণার খোঁজ পাওয়ার পরেই মৌলের পরমাণুর ভেতরের চেহারা কেমন হতে পারে তার খানিক ধারণা পাওয়া গেল।
ইউরেনিয়াম থেকে বেরোনো যে রশ্মি, তা যে পদার্থের পরমাণুর মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসছে, এই বিষয়টিও অনেকখানি নিশ্চিত হওয়া গেল এরপর।

পিয়ের কুরি ও মেরি
আবার মেরির কথায় ফিরে আসি। আগেই পড়েছি ফরাসি দেশের তরুণ পদার্থবিদ পিয়ের কুরির সঙ্গে মেরির পরিচয় হওয়ার কথা। মাঝে মাঝে দু’জনের দেখা হয়েছে। বিজ্ঞান সহ নানান বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয় তাঁদের। মেরির থেকে বয়সে আট ন বছরের বড়ো পিয়ের। ফরাসি দেশে বিজ্ঞান মহলে তখন পদার্থবিদ পিয়ের কুরির খুব নামডাক। নিজের গবেষণার বিষয় নিয়ে পিয়েরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন মেরি। মেরির মতোই পিয়েরও দিনরাত বিজ্ঞানের ভাবনা আর কাজ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন।

মেরিকে বিয়ে করে একসঙ্গে দু’জনে বিজ্ঞান গবেষণা করতে চান, এ কথা মেরিকে একদিন বললেন পিয়ের কুরি। কথা শুনে মেরি চমকে উঠলেন। মেরির ভাবনায় সেরকম কিছু ছিল না। মেরি পিয়েরকে উত্তরে বললেন, ‘না ,আমি বিয়ে করতে পারব না। তোমাকে বিয়ে করা মানে তো সারা জীবন ফ্রান্সেই থেকে যেতে হবে আমাকে। তা কখনোই সম্ভব নয়। গবেষণা শেষ করেই আমি নিজের দেশে ফিরে যাব’। মেরির সব কথা শুনে পিয়ের বললেন— ‘বেশ তাহলে না হয়, আমিই ফ্রান্স ছেড়ে পোল্যান্ডে চলে যাব তোমার সঙ্গে। সেখানেই একসঙ্গে বিজ্ঞান গবেষণা করব। তাতে আমার কোনও অসুবিধা নেই’।

মেরি এবার পড়লেন মহা- ফাঁপরে। পিয়েরের কাছ থেকে যে এরকম উত্তর পাবেন, তা ভাবতেই পারেননি মেরি। মেরি ভালো করেই জানেন, পোল্যান্ডে গেলে বিজ্ঞান গবেষণার কোনোরকম সুযোগই পাবেন না পিয়ের। কী করা যায় ভেবে তখন বাড়িতে সবার মতামত চাইলেন মেরি। বাড়ির সবাই বলল, ‘পিয়েরকে বিয়ে করে ফ্রান্সেই থাকাটাই ভালো হবে’। যাই হোক মেরি নিজের মত বদলালেন এবার। একবছর আগে যে বিয়েতে ‘না’ বলেছিলেন, এবার তাতে ‘হ্যাঁ’ বললেন মেরি।

পিয়ের আর মেরি-র বিয়ে
পিয়ের কুরির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মেরির (১৮৯৫)। বিয়ে মানে ভাবছো তো— দারুণ ধুমধাম, সাজগোজ, প্রচুর খাওয়া দাওয়া। না, ওদের বিয়েতে সে সব কোনও কিছুই হল না। আসলে, মেরি আর পিয়ের দু’জনের কেউই চাননি বিয়েতে কোনও ধুমধাম হোক। খুব সাধারণ ভাবে বিয়ে হোক, এটাই চেয়েছিলেন তাঁরা। বিয়ে হওয়া নতুন বর আর বউ দু-জনে দু’জনকে কী উপহার দিয়েছিলেন? ধার করা টাকায় দু-টি সাইকেল কিনে, একজন আর একজনকে উপহার দেন। হঠাৎ সাইকেল কেন? আগের থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল, সাইকেলে চেপে দু’জনে মধুচন্দ্রিমায় ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যাবেন বলে। বিয়েতে নতুন ড্রেস লাগবে, যা পরে মেরির বিয়ে হবে। মেরি বললেন পিয়ের-কে, ‘আমার জন্যে যদি কোনও ড্রেস যদি কিনতেই হয়, তা হলে তা যেন বিয়েতে পরার গাউন না হয়। সেই পোশাকটি যেন ‘নেভি-ব্লু’ রঙের হয়, যেটা পরে আমি রোজ ল্যাবরেটরিতে যেতে পারব। কারণ, মাত্র একটাই ল্যাবরেটরিতে পরে যাওয়ার জামা আছে আমার। তাই আর একটা হলে সুবিধাই হবে।’
এরকম ভাবেই নিজেদের মতন করে বিয়ে করলেন মেরি আর পিয়ের।

শুরু হল নতুন জীবন—
মেরি এখন মেরি কুরি
একদিকে গবেষণা, অন্যদিকে ঘর সংসার। বাজারহাট, রান্নাবান্না, কাপড় জামা কাচা— মেরিকে সবই করতে হয়, অন্য আর পাঁচটা পরিবারে যেমন হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় পিয়েরের সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতেন মেরি। কাজের চাপে সেভাবে কোথাও আর বেরোনো হয়ে ওঠে না। বিয়ের পরেও সেই যা মধুচন্দ্রিমায় গ্রামাঞ্চলে যাওয়া হয়েছিল। তাঁরা ঠিক করলেন এবার দু’জনে বেড়াতে যাবেন। ঝোলাব্যাগ ভর্তি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর নিয়ে মেরি আর পিয়ের দু’টি সাইকেল নিয়ে দু’জনে পাহাড়ের দিকে চলে গেলেন ছুটি কাটাতে।

বিয়ের দু-বছর পর মেয়ে আইরিনের জন্ম হল। মেরির তখন প্রচুর কাজ। আইরিনকে চান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো। এছাড়াও আছে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা আর পড়ানো। এতদিকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে মাঝে মাঝেই। আইরিনকে দেখাশোনা করার জন্যে একজন আয়া ঠিক করা হল। বাড়ি থেকে পিয়েরের বাবা এলেন ছেলে-বৌমা আর নাতনির সঙ্গে থাকার জন্যে। তিনি ডাক্তার। শ্বশুরমশাই আসাতে, মেরি খুব নিশ্চিন্ত হলেন। দাদুর কাছে নাতনিকে রেখে আবার মন দিয়ে গবেষণার কাজ করতে পারবে মেরি।
(ক্রমশ)