নিশীথ সিংহ রায়
আরজি করের তরুণী চিকিৎসক ‘অভয়া’র মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা দেখেছি সামাজ কিভাবে ধিক্কার জানিয়েছে এবং আন্দোলন করেছে দোষীদের শাস্তির জন্য। কিন্ত গত সপ্তাহে বাংলা তথা ভারতের চিকিৎসা জগতের এক মহারথীর মৃত্যু দিন ছিল সেটা শুধু সাধারণ জনসাধারণই নয় এমনকি যে মিডিয়া তিলকে তাল করতে ছাড়ে না তারাও কোনো খবর করেনি। গত ১৫ নভেম্বর চিকিৎসা জগতের এক যুগান্তকারী শল্য চিকিৎসকের মৃত্যু দিন ছিল তা হয়তো আমরা ভুলেই গেছি। এশিয়া প্রথম ভারতীয় হিসেবে যিনি শব-ব্যবচ্ছেদ করেছিল আধুনিক শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ সেই পন্ডিত মধুসূদন গুপ্তের কথা বলছি। যাঁর মৃত্যু হয় ১৮৫৬ সালে ১৫ নভেম্বর। নিঃশব্দেই কেটে গেল সমস্ত দিনটা। ১৮৩৬ সালে ১০ জানুয়ারি কলকাতা মেডিকেল কলেজে তাঁরই হাত দিয়ে সূত্রপাত হয়েছিল আধুনিক শল্য-চিকিৎসার। তিনি ছিলেন হুগলির বৈদ্যবাটির বাসিন্দা। হুগলির সদর চুঁচুড়া কিংবা পড়শি মহকুমা চন্দননগর শহর তো দূরে থাক, তাঁর নিজের জন্মস্থান বৈদ্যবাটিতেও কোনো অনুষ্ঠান হয়েছে বলে জানি না। এই মুহূর্তে ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতে খুবই সক্রিয় কিন্ত কোথাও দেখলাম না ডাক্তার পন্ডিত মধুসূদন গুপ্তকে নিয়ে কোনও মিটিং, মিছিল বা নিদেনপক্ষে একটা স্মৃতি চারণা। যে সময়ে মরদেহ বা শব ছোঁওয়া ছিল অপরাধ সেসময়ে ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার ইতিহাসে প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ করে পন্ডিত মধুসূদন বাঙালিকে তাদের কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন। আবার এই ভারতবর্ষেই পৃথিবীর মধ্যে প্রথম শল্যচিকিৎসা শুরু হয়েছিল। খৃষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে সুশ্রুত রচিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’ থেকে আমরা জানতে পারি সুশ্রুতই প্রথম ডাক্তারী বিদ্যায় অস্ত্রোপচার, প্লাস্টিক সার্জারি, দন্তবিদ্যা, ধাত্রীবিদ্যা বা স্ত্রীরোগবিদ্যা চালু করেন। কথিত তিনি ঋষি বিশ্বমিতের পুত্র ছিলেন। তাঁকেই আধুনিক শল্যচিকিৎসা বা প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয়। সুশ্রুতের পর মধুসূদন গুপ্তই প্রথম ভারতীয় যিনি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে শব-ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন।
মধুসূদন গুপ্তের জন্ম হুগলির বৈদ্যবাটিতে। সঠিক তারিখ না জানা গেলেও তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮০০ খৃষ্টাব্দে। ঘটনাক্রমে ওই বছরই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁরা জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ এবং পেশায় ছিলেন বৈদ্য। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে সে সময় তাঁদের পরিবারের একটা সুনাম ছিল। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন নামকরা বৈদ্য। তাঁকে ‘বক্সী’ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর পিতামহ ছিলেন হুগলির নবাবের গৃহ চিকিৎসক। মধুসূদনের কোনোদিনই প্রথাগত শিক্ষার প্রতি কোনোরূপ আগ্রহ না থাকায় কিশোর বয়সেই তাঁকে তাঁর বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন। কিন্ত রক্তে যাঁর চিকিৎসা বিদ্যার বীজ তিনি কি পারেন চিকিৎসা বিদ্যা থেকে সরে থাকতে? তাই প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি বিভিন্ন কবিরাজের কাছে রোগ নির্ণয় ও তার সঠিক ওষুধ দেওয়ার পদ্ধতি শিখতে লাগেন। শোনা যায় তিনি তখনকার বিখ্যাত রাম কবিরাজের কাছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ দেওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা নেন এছাড়াও তিনি বিভিন্ন কবিরাজের সঙ্গে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখতে থাকেন ও এব্যাপারে আরও পারদর্শী হন। বাড়ি থেকে চলে গেলেও ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের বৈদিক বিভাগে ভর্তি হন। সেসময় সংস্কৃত কলেজে ভারতীয়দের জন্য আয়ুর্বেদ ও ইউনানি পড়ানো হতো। এখানেই তিনি আয়ুর্বেদে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহ বা শব-ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। যা তাঁকে ভবিষ্যতে ভারতের প্রাশ্চাত্য বিদ্যার প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদকারী এবং শল্যচিকিৎসক হিসেবে পরিগণিত করতে সাহায্য করে। তিনি শুধু ডাক্তারি বিদ্যাতেই পারদর্শী হয়ে উঠলেন না তিনি ভারতীয় দর্শন, ন্যায় বা সংস্কৃততেও ব্যুৎপত্তির পরিচয় দেন।
এরপরই তাঁর জীবনে আসে এক আমূল পরিবর্তন। ১৮৩৫ সালে ভারত তথা এশিয়ায় প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সংস্কৃত কলেজ থেকে বৈদিক বিভাগ তুলে দেয়। সবার মতন মধুসূদনকেও মেডিক্যাল কলেজে যেতে হলো। ১৮৩৫ সালের ১৫ মার্চ প্রথমে তিনি ডিমনস্ট্রেটর ও পরে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। কিন্ত তিনি যেহেতু সংস্কৃত কলেজে ছাত্র ছিলেন তাই তাঁর কাছে তাঁর সহপাঠীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে আপত্তি জানান। সেকারণে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি ডাক্তারী পরীক্ষায় বসে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। কবিরাজী ছাত্র থেকে তিনি একেবারে প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ডাক্তার হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের জন্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় আরও পারদর্শী হতে সাহায্য করে একারণে তিনি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রও যেমন ছিলেন তেমন একজন শিক্ষকও ছিলেন। শব-ব্যবচ্ছেদ হিন্দু রীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ থাকলেও পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত ডাঃ হেনরি গুডইভের নির্দেশে ১৮৩৬ সালে এশিয়ায় প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে এক ইতিহাস রচনা করেন। মধুসূদনের সঙ্গে প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদে তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলেন আরও চার বাঙালি ডাক্তারী ছাত্র উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, রাজকৃষ্ণ দে এবং নবীনচন্দ্র মিত্র। ইংরেজ চিকিৎসকদের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে ডাক্তারী প্র্যাকটিস করা ছিল মধুসূদনের কাছে একধরনের চ্যালেঞ্জ। তিনি ছিলেন দেশের মানুষের কাছে ধন্বন্তরী, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের কাছে আদর্শ-পরিশ্রমী-জ্ঞানী জনপ্রিয় শিক্ষক। তাঁর যুগান্তকারী শব-ব্যবচ্ছেদের ১৮৮ বছর অতিক্রান্ত কিন্ত এখনও পর্যন্ত তাঁর স্মরণে না মেডিক্যাল কাউন্সিল না কোনো সরকার কোনোরূপ কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেননি।
তবে তাঁর জন্মস্থান হুগলিরই এক পড়ুয়া মেধা সম্পদে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বর্তমানে হুগলি কলেজিয়েটের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র কিশোর অভিজ্ঞান কিশোর ২০২১ সালে করোনার আবহে মধুসূদন গুপ্তের জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। তার এই তথ্যচিত্রটি ইতিমধ্যে ১৮টির বেশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও সমাদৃত হয়েছে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া যুব ফিল্ম উৎসবে প্রথম পুরস্কার পায় এই তথ্যচিত্রটি। তথ্যচিত্রটিকে সেরা ঘোষণা করার সময় হলিউড়ের দুই পরিচিত চিত্রসমালোচক ও পরিচালক সারা জর্ডান ও গেজে জনস্টোন জানান — “এই গল্পটি বিষণ্ণতা এবং আশা উভয়ের সঙ্গে উদ্ভাসিত। ভারতের ঐতিহাসিক স্মৃতির অভাবকে চিত্রিত করার কারণে ছবিটির আবহ ব্যথিত করে তোলে। যাইহোক, গুপ্তের অবদানের ইতিবাচক প্রভাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যা দর্শকরা বুঝতে পারে। এই মানুষটিকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রাস্তার সাক্ষাৎকার এবং চতুর ক্যামেরা কৌশল ব্যবহার করে, কিশোর পরিচালক বিমূর্ত ভাবনাকে সফলভাবে বাস্তবমুখী করতে পেরেছেন। ফলে, দর্শকরা ধীরে ধীরে বিষয়গত দিকে আরও জড়িয়ে পরে”। ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও জাতীয় বিজ্ঞান চলচ্চিত্র উৎসবেও সমাদৃত হয় এই তথ্যচিত্রটি। সমাজ যখন মধুসূদনের মতো মানুষকে ভুলে গেছে সেসময় অভিজ্ঞানের মতো এক কিশোর প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ নীতি আয়োগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাতে তাঁর স্মৃতিতে আমাদের জেলায় কিংবা রাজ্যে একটা বড় হাসপাতালের নামকরণ বা নতুন হাসপাতাল তৈরি করা হোক। এব্যাপারে গত ১৫ নভেম্বর অভিজ্ঞান তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে একটি আবেদনও জানিয়েছে। এখন দেখার অভিজ্ঞানের এই আবেদনে কেউ সাড়া দেয় কিনা।