নিশীথ সিংহ রায়
শীতকালে বাঙালি মাত্রই দুটো জিনিসে বিভোর থাকে। এক পিকনিক, ভ্রমণ এসবে আর দ্বিতীয় বইমেলা। পশ্চিমবঙ্গের এমন কোন শহর নেই যেখানে বই মেলা হয় না। এরওপর আছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা যা কড়া নাড়ছে দরজায়। এই কলকাতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে চুঁচুড়া শহরে ষোড়শ হুগলি-চুঁচুড়া বইমেলার উদ্বোধন হয়ে গেল শনিবার চুঁচুড়া ময়দানে। উদ্বোধন করলেন প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক উল্লাস মল্লিক। মেলা চলবে আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুরুর দিনেই ভিড় উপচে পড়ল এই বইমেলাতে। লেখক-পাঠকের যুগলবন্দী ভিড় দেখে যেমন খুশি পুস্তক-বিক্রেতারা। ঠিক তেমনই হাসি ফুটেছে উদ্যোক্তাদের মুখেও।
একদা ওলন্দাজ অধ্যুষিত, হুগলি জেলার সদর শহর চুঁচুড়া বরাবরই সংস্কৃতিমনস্ক। চুঁচুড়ার মাঠগুলিতে প্রায় সারা বছরই চর্চা হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির। হুগলি-চুঁচুড়ার বইমেলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে। প্রথমবারের স্টল সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০টি। এবারের সেই স্টল সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০২টি। যার মধ্যে রয়েছে ৭৪টি বইয়ের স্টল এবং কুড়িটি লিটল ম্যাগাজিনের স্টল। উদ্যোক্তাদের দাবি, গত বছর প্রায় ৪৪ লক্ষ টাকারও বেশি বই বিক্রি হয়েছিল। এবার তাঁরা আশা করছেন, বই বিক্রির অঙ্ক ৫০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এবারের বইমেলায় যেমন বিখ্যাত কিছু প্রকাশনী, তাদের নিজস্ব স্টল নিয়ে হাজির। তার পাশাপাশি স্থানীয় এবং ছোট মানের প্রকাশনীরাও রয়েছে। যেমন রয়েছে অক্সফোর্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ প্রকাশনী, পত্রভারতী, দেব সাহিত্য কুঠিরের মতন নামকরা জাতীয় মানের প্রকাশনী। তার পাশাপাশিও রয়েছে কলকাতার ‘এবং অধ্যায়’-এর মতো উঠতি প্রকাশনী সংস্থাও। এই বইমেলা উপলক্ষে তারা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ‘ষোলো কলাম’। জানালেন ‘এবং অধ্যায়’-এর যুব-প্রকাশক ধীমান ব্রহ্মচারী। তাঁরা সামাজিক মাধ্যমেও আবেদন রেখেছেন, “বেশি করে বই কেনার, বই পড়ার”। সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতারাও। যেমন হাজির ‘চিনসুরা চিপ বুকস্টোর’। তাদের সম্ভারে যেমন রয়েছে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের অজস্র সংকলন। ঠিক তেমনই বিভিন্ন পরীক্ষামূলক প্রস্তুতির এবং সরকারি চাকরির প্রস্তুতির প্রচুর বই। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার প্রদীপ দাস জানালেন, এবারে বইমেলায় তাঁদের রয়েছে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা পড়ুয়া এবং চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য। সেই কারণে প্রথম দিন থেকেই ভিড় উপড়ে পড়েছে এই স্টলে।
চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের পক্ষ থেকেও একটি বিশেষ কেন্দ্র খোলা হয়েছে এই বইমেলাতে। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে সতর্ক ও সচেতন করার উদ্দেশ্যে। স্থানীয় চিত্রকরদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘মৌ রায়চৌধুরি স্মরণ আর্ট গ্যালারি’। সেখানে পঞ্চাশের অধিক চিত্রকরের সৃষ্টি শিল্পকর্ম দেখতে প্রথম দিনেই ভিড় জমান বেশ কিছু বইপ্রেমী। সুদূর বীরভূম থেকে কল্যাণব্রত সিংহ রায় হাজির হয়েছেন তাদের প্রসিদ্ধ আচার ও মোরব্বার এক বিশাল সম্ভার নিয়ে। একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য চা-কফির সঙ্গে রয়েছে একাধিক খাবারের দোকানও। শুধু বইয়ের স্টলই নয়, রয়েছে ব্যান্ডেলের ‘অন্বেষা কুইজ’ ক্লাবও। সেখানেও প্রথমদিনেই ভিড় পড়েছে উপচে। ‘পথের পাঁচালী’ বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের কুইজে অংশগ্রহণ করেছে অসংখ্য বইপ্রেমী। বইমেলা কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি প্রয়াত কবি অরুণ চক্রবর্তীর স্মরণে লিটিল ম্যাগাজিনের এক সুবিশাল প্যাভিলিয়ন নামাঙ্কিত করেছেন। সেখানে রয়েছে কুড়িটির মতন লিটিল ম্যাগাজিনের স্টল। চুঁচুড়ার সবচেয়ে পরিচিত লিটিল ম্যাগাজিন ‘যাচ্ছেতাই’-এর সম্পাদক শুভদীপ দে’র কথায়, “গত ১৪ বছর ধরে আমরা পরিশ্রম করে আসছি লিটিল ম্যাগাজিনকে জনপ্রিয় করার। প্রতিবছরই চেষ্টা করি সাহিত্য জগতে নতুন-নতুন মুখ খুঁজে, তাঁদেরকে প্রচারের আলোকে আনার”।
আরনেস্ট হেমিংওয়ে একদা বলেছিলেন, “বইয়ের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই”। তাই বইকে বন্ধু করতে প্রথম দিনই মেলাতে হাজির সব বয়সের হুগলি-চুঁচুড়ার পাঠকেরা। স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়া অষ্টম শ্রেণির অস্মিতা মন্ডল তার বাবাকে দিয়ে প্রথম দিনই চলে এসেছে মেলাতে। কথাপ্রসঙ্গে সে জানাল, প্রতিবারই একাধিকবার এই বইমেলাতে আসে। গত শনিবার সে সংগ্রহ করল আরনেস্ট হেমিংওয়ের “দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি”। তার বাবা, পেশায় শিক্ষক অরবিন্দ মণ্ডলকে ইতিমধ্যেই বলে রেখেছে আগামীদিনে আর কী কী বই সংগ্রহ করবে। ভিড়ের মধ্যে সাহিত্য-জগতে পরিচিত-মুখ স্থানীয় কবি ও ছোটগল্পকার মানস মজুমদারকেও ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল পরিচিত পাঠকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়। এই বইমেলাকে জনপ্রিয় করতে সংগঠকেরা গত ৮ ডিসেম্বর আয়োজন করেছিলেন এক পদযাত্রার। পিপুলপাতির ডিআই অফিসের ময়দান থেকে চুঁচুড়ার ময়দান। তাতে প্রায় তিনশতাধিক বইপ্রেমী চুঁচুড়াবাসী অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বইমেলাতে শুধুমাত্র যে বইপ্রেমীদেরই খিদে মিটবে তা নয়। সংগঠকরা ব্যবস্থা করেছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও। ন’দিন চলা এই বইমেলাতে প্রতিদিনই থাকবে বিভিন্ন মানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অংশগ্রহণ করবেন এই অঞ্চলের এবং রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত এবং বিখ্যাত সাংস্কৃতিক শিল্পীবৃন্দ। উদ্বোধনী দিনে ‘কলামিক্রম’ প্রযোজিত সমবেত-নৃত্য দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আশা করা যাচ্ছে, সংস্কৃতিমনস্ক এবং বইপ্রেমী চুঁচুড়াবাসী আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেতে উঠবে এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে।