আমাদের কি আদৌ কোনও নৈতিক শিক্ষা আছে?

গত সংখ্যার পর

এতদিন ধরে জেনে এসেছি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড যেমন অক্ষীয় কঙ্কালের মূল অংশ যা মাথা থেকে পুরো শরীরকে এক সূত্রে ধরে রাখে শিক্ষাও তেমন জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাই জাতিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখায়। মেরুদণ্ড কোনো কারণে অক্ষম হয়ে গেলে আমরাও যেমন অক্ষম হয়ে যাই তেমনই শিক্ষায় ঘুণ ধরলেও জাতিরও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষাই আনে চেতনা। যার চেতনা নেই তাকে ধরা হয় মৃত। আজ আমরা চেতনাহীন বা শূণ্য। আমরা যখন চেতনাহীন তখন তো আমরাও মৃত। চেতনাহীন মানুষকে কি আমরা বলতে পারি সুস্থ মানুষ? আর আমাদের চৈতন্য আসবে কোত্থেকে? আজকে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক মূল্যায়নের কোন ব্যবস্থা আছে কি? এখন তো মনে হয় সরকারি বিভিন্ন অনুদান নেবার জন্যই স্কুলে ভীড়। সত্যি বলছি আমি অত বুঝি না কিন্তু বাস্তব দেখে এটা মনে হয়েছে বিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা। সেখানে ভাত, খিঁচুড়ী খাওয়ানোর জায়গা নয়। এমনিতে বাংলাতেই সবথেকে কম দিন স্কুল, কলেজ খোলা থাকে। সরকারি ছুটি, স্থানীয় অনুষ্ঠান, বাস, ট্রেনের ধর্মঘট তার ওপরে রাজনৈতিক কর্মসূচি। শিক্ষা জগতের ওপর শেষেরটিই এখন সবথেকে মারাত্মক প্রভাব।

প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও এখন রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে দেখা যায়। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, স্কুলে মিড ডে মিলের প্রথা তুলে দেওয়াই উচিত। একটু ভাবুন এ নিয়ে। সেই টাকা কি আমরা সমাজের একেবারে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের উন্নতির জন্য খরচ করতে পারি না? ঠিক যেভাবে আজ কোটা সিস্টেম সমাজের বুকে বিশেষত শিক্ষা বা চাকুরীতে চেপে বসেছে, সব জেনেও তার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। স্কুলের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে, এখানেও রাজনৈতিক বাধা জগদ্বলের মতো একেবারে চেপে বসে আছে। আর যদি মিড ডে মিল চালুও থাকে তাহলে তা কেন্দ্রীয় ভাবে হওয়া উচিত। যেমন শহরাঞ্চলে কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে করা যায় আর গ্রামাঞ্চলে গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক বা জেলা পরিষদের মাধ্যমে করা যায়। আর এটা খুবই হাইজিনিক ভাবে অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে হওয়া উচিত। স্কুলের অবস্থা এখন শরৎচন্দ্রের গল্পের মেজদার চরিত্রের মতন। যেখানে পড়ার থেকে আয়োজন বেশি। লক্ষ্য থেকে উপলক্ষ্য বেশি, উপকরণ বেশি। শিক্ষককুল খাবারের গুণগত মান বজায় রাখবে না শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে জাতির মেরুদণ্ড তৈরি করবে? কি দোনাটোনা? শেষে চলতি স্রোতে গা এলিয়ে দিয়েছে। তাইতো এখন কান পাতলে শোনা যায় ‘শিক্ষার এ কি হাল’! বর্তমান সমাজের বিবেকহীন, নীতিহীন বা সুবিধাভোগী জনসাধারণও এখন তা বলতে বাধ্য হচ্ছে।


জীবনে একটা অনুশাসন দরকার। জীবন থাকবে সত্যর জন্য উৎসর্গীকৃত। আজ অনুশাসন আর সত্য এই দুটোর জন্য সবাই গাল ভরা কথা বলে কিন্ত মানে কি? এখন তো সবকিছুর মানদণ্ড বিচার হয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর বিচার-বিবেচনা করে। সেখানে সত্যের স্থান কোথায়? এখন সত্য মানে নিজের আখের গোছানো। একারণেই আমাদের আর কোনো নীতিবোধ নেই। সেকারণে আমরা নিজেদেরই সম্যক চিনি না। নিজেকে না চেনা না জানার জন্য আমরা আমাদের দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতিও জানি না। রবীন্দ্রনাথ এব্যাপারে বলেছেন, ভারতকে জানো। জানো তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি। হও সৎ, হও বিবেকবান। তবেই নিজেকে চিনবে, জানবে। আর এসব বোঝা, জানার জন্য সবথেকে ভালো উপায় বিবেকানন্দকে বোঝা, জানা। কিন্তু দেশের, জাতির এমন হাল স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরে বা বিবেকানন্দের মৃত্যুর একশো বছর পরও তাঁর সঠিক মূল্যায়নই আমরা করতে পারিনি। দেশ, জাতিকে যাঁরা সঠিক পথ, দিশা দেখাতে পারতেন সেই রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ ঘোষ, বিবেকানন্দ বা নেতাজীকে পশ্চিম বাংলার কোন শাসক দলই কোনদিন আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাঁদের জীবনাদর্শ কোনদিনই ঠিক মতন মেলে ধরার কথা ভাবেইনি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই করে গেছেন। বিশেষত নেতাজীর কথা এখানে না বললেই নয় কারণ তিনি তথাকথিত একটি বামদলের স্রষ্টা। যে দল পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছর বামফ্রন্টের অংশ হিসেবে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে। তাতেও তারা নেতাজীর আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরতে অক্ষম হয়েছে। আর নেতাজীর উত্তরসূরীরা তাঁর নাম ভাঙিয়ে সমাজের উচ্চ স্থানে বিরাজ করছেন।

এখন আমরা কাজ করি সম্পূর্ণ স্বার্থের প্রয়োজনে। তাতে যদি অপরের কোন উপকার হলে হবে কিন্তু নিঃশব্দে বা নিস্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়বো না দেশ বা দশের উপকারার্থে। তাই এ সমস্ত মনিষীর ভাষাতেই বলি, এখন আমরা বৃষ্টির মতো নিজের প্রয়োজনে ঝরি কিন্তু হাওয়ার মত নই। যে হাওয়া সর্বদা তোমার পাশে থাকবে আবার কখনো কখনো নিঃশব্দেও। আবার স্বামীজীর কথায় আসছি। তিনি বলেছেন, ‘ত্যাগে বেহিসেবি হও আর সারল্যে শিশু,’। এখন কোনো কিছু ‘ত্যাগ’ করা বা ‘উপকার’ করা মানে নিজের প্রচার করা। যা জীবন গড়তে সাহায্য করবে। আর সারল্য মানে ‘ভন্ডামি’। ‘মুখোশ’। যা প্রতিমুহুর্তে রং পাল্টায়। আয় করার জন্য আমাদের অতি উৎসাহ আছে কিন্তু তাতে কোন বিবেক নেই। এ আয় শুধুমাত্র সুখের জন্য। আর কি রকম আয়, তা সৎপথে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নয়। কত কম সময়ে কত বেশি আয় করা যায় এটাই ভাবনা। তা সে অসৎ পথে হলেও ঠিক আছে। এখন তো আমাদের দেশে সবথেকে বেশি মানুষ আয়ের সহজতম পথ হিসেবে যে কয়টি পথ বেছে নেয় তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘রাজনীতি’। একবার কোন একটা দলে নাম লেখালেই হলো। একটু এলেম থাকলেই নেতা বা তস্য ছোট নেতা হলেও তার ঈর্ষণীয় উন্নতি (ভোগের) তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোনো নীতি, বিবেক বলে কিছুই নেই।

বাঙালির এই নৈতিক অধঃপতনে রাজনীতি যেমন দায়ী পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলিও দারুণ ভাবে দায়ী। যে খবর বাজার খাবে সেটাই সর্বদা হাইলাইট করে। খবর পরিবেশনের মারপ্যাঁচে ধরতেই পারব না কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। ওই যে প্রথমেই যেটা বলেছি, আমরা সবাই অসৎ, অবিবেচক। জাতির প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। জাতির অধঃপতনে কিছু যায় আসে না। এরা যে গাছের ডালে বসে আছে তার গোড়াতেই যে কুড়ুল মারছে সেটা বোঝে না। অনৈতিক ভাবে মুনাফাটাই এদের শেষ কথা। এদিকে আবার আমরা হেরে যেতে খুব লজ্জাবোধ করি। যদিও এটা সব অক্ষম ও বিবেকহীন মানুষেরই হয়। হারার ভয়ে আমরা এমন পেশায় নিযুক্ত হতে চাই যেখানে হার-জিতের কোন মাপকাঠি নেই। এক্ষেত্রে আমাদের কাছে যে যে পন্থাগুলো আছে আমরা প্রথমেই সেগুলোর মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করার কথা ভাবি। কিন্তু ‘ব্যর্থতা’ বা ‘পরাজয়’ যে আমাদের শিক্ষার একটা অঙ্গ, উন্নতির একটা ধাপ এটা আমরা ভাবতেও লজ্জাবোধ করি। আর এটা কি সর্বদা সম্ভব যে বিনা পরিশ্রমে ফল লাভ হবেই। লটারি মনস্ক মানুষজনদের কাছে সে সম্ভবনা কিছুটা আছে বটে। তাই তো মননে-চিন্তায়, কৃষ্টি-শিক্ষায় বা সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের অন্য রাজ্য বা জনপদের থেকে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। বিবেকহীন, মিথ্যাচারে আমরা এখন নিমজ্জিত।

তাৎক্ষণিক লাভ বা সাময়িক কিছু পাওয়ার লোভে আমরা এখন সব করতে পারি। পাওয়াটাকেই আমরা এখন ধ্যান জ্ঞান করে নিয়েছি। দেওয়াটাকে আমরা ভুলে গেছি। এটাই এখন সামাজিক রীতিনীতি। ‘দেয়া’ ও নেয়া’ আর সামাজিক রীতিনীতি নই। আবার বলি বিবেকানন্দ সম্পর্কে নেতাজী যা যা বলেছেন অর্থাৎ ত্যাগে বেহিসেবি, কর্মে বিরামহীন, প্রেমে সীমাহীন, সমালোচনায় অগ্নিবর্ষী, জ্ঞানে সমুদ্র গভীর, সারল্যে শিশু তা হয়তো আমরা হতে পারবো না কিন্তু বিবেক বা নীতি সর্বস্ব মানুষ তো হতে পারি? এদিকে নির্বুদ্ধি বলা যাবে না বাঙালিকে। হ্যাঁ, যেটা আছে সেটা হয়তো সুবুদ্ধি নয় এটা বলতে পারি। সুবুদ্ধি ছাড়া ‘সুকাজ’ কখনও হয় না। তাই আবার বলছি, আমরা সুবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিবান বা বিবেকবান মানুষ হই। নীতি না থাকলে তাকে কি ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ বলা যায়? বর্তমান বাংলায় এটারই খুব অভাব। ‘বিবেক’ বা ‘নীতি’ সম্পূর্ণ মানুষ।

আসুন, আমরা বাড়ি থেকেই শুরু করি আমাদের এই নৈতিক শিক্ষা। পরনিন্দা, লোভ, হিংসা ভুলে যাই। সততাই হবে জীবনাদর্শ। অন্যায়ের সঙ্গে যেন কখনও আপোষ না করি। অন্যের সফলতায় ঈর্ষান্বীত না হই বা অন্যের সমালোচনা থেকে বিরত থেকে এক আদর্শ সমাজ গঠনে ব্রতী হই। আর আমাদের সন্তানদের কাছে এক আদর্শ সমাজের চিত্র তুলে ধরি সাথে সাথে মনিষীদের জীবনাদর্শ সম্বন্ধে তাদের ওয়াকিবহাল করি।