শিশুরা কি স্কুলে শুধু পড়াশুনাই করবে?

স্কুলে শিশুরা। প্রতীকী চিত্র

সুবীর চৌধুরী

শিশুদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘প্রত্যেক শিশু এই বার্তা নিয়ে আসে যে ঈশ্বর এখনও মানুষের প্রতি নিরুৎসাহ হননি।’

আজকের লেখা শুরু করার আগে আমার মতো সত্তর বছর পার হওয়া বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনদের নাতি নাতনিদের কথা ভাবছিলাম যারা সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে বা যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এখনকার শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে বইপত্রের ভারে, তারা পার্কে গিয়ে দোলনা চড়তে পায় না, নিজেদের মতো করে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করে খেলতে পারে না, হাতেপায়ে ধুলোবালি মাখতে পারে না, তাদের বেশিরভাগ এখন একাএকা বন্দি মা বাবার ফ্ল্যাটবাড়ির কোন ঘরে বা বাড়িতে, হাতে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ নিয়ে। তারা তাদের দাদুদিদার কাছে ঠাকুমার ঝুলির গল্পও আজকাল শুনতে পায় না।


অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে এসে খবরের কাগজের সঙ্গে দেওয়া ম্যাগাজিনে এক মহিলার লেখা পড়ছিলাম, ওনার তিন মেয়েদের (তাদের বয়স পাঁচ, সাত আর দশ বছর) কথা তিনি লিখেছেন। তিন মেয়েই স্কুলে পড়াশুনার শেষে নানান ধরণের after school activities আর খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে, তারা সাঁতার কাটে আবার নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতেও শেখে। বিদেশে বাচ্ছারা চার বছর (কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক বছর) বয়স থেকেই সাঁতার কাটা শেখার স্কুলে ভর্তি হয়, সুন্দর সুইমিং পুল ঝকঝকে কাঁচের মত এমন জল যে পুলের নিচে মেঝেটা অবধি দেখা যায়, শীতকালে গরমজল আর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাঁতারুরা বাচ্চাদের নিয়মিত নিয়মমাফিক সাঁতার কাটতে শেখান। সাঁতার কাটা এমন একটা এক্সারসাইজ যেখানে শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল করে আর প্রায় দেহের সব মাংসপেশীর বিকাশ ঘটায়। অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই ভাল সাঁতারের স্কুলে ভর্তি করালে বাচ্ছারা সাঁতার কাটা শিখবে আর শরীরের খুব ভালো এক্সারসাইজও হোয়ে যাবে, আলাদা করে তাদের আর জিমে যাবার দরকার হবে না।

উপরে যে মহিলার কথা লিখেছি উনি আরও জানিয়েছেন যে তাঁর বড় ও মেজো মেয়ে নাটকের স্কুলেও যায় আর তিন মেয়েই স্কুলে Saturday Sports এ অংশগ্রহণ করে। এই মহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে আর কতটা করা হলে তাকে খুব বেশি করা বলা হবে, তিনি বলছেন মেয়েদের সারাদিনের স্কুল আর অন্যান্য activity সামলাতে সামলাতে স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের জন্য সময় কমে যাচ্ছে তাছাড়া পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে কোন কিছু করাও যাচ্ছে না, নিজেদের বাজেটকেও অনেক সময় ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী মনে করছেন মেয়েরা খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে আর সব বিষয়গুলো ভালবেসে ঠিকমত করছে না যদিও তাঁদের মেয়েরা নিজেরাই তাদের বিষয়গুলো পছন্দমতো ঠিক করেছে। এর উপর ওনার স্বামী বলছেন যেমন চলছে চলুক আর এর সঙ্গে সব মেয়েদের অঙ্কের টিউশনটাও নেওয়া দরকার। মহিলা আরও লিখেছেন যে ছোটবেলায় তিনি নিজে স্কুলে পড়াশুনা করতেন আর শুধু বাস্কেটবল খেলতেন।

গানবাজনা, নাচ, নাটক বা এই ধরণের শিল্পকলা করার ফলে ছেলেমেয়েদের স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটে আর তাদের মন কিছুটা সময় অন্য দিকে থাকার ফলে পড়াশুনায়ও মনোযোগ বাড়ে, এই সমস্ত শিল্পকলায় সমাজের বিভিন্ন লোকজনদের যোগদানের ফলে তাদের সাথে যোগাযোগও বাড়তে থাকে। শিশুদের মধ্যে দলগত চেষ্টা, শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি গুণেরও উন্নতি হতে থাকে যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে বিশেষভাবে কাজে লাগে। গান, নাচ বা আবৃত্তি ভালোভাবে জানা থাকলে ভবিষ্যতে তারা অন্যান্য বাচ্চাদেরও এই সব শিল্পকলা শেখাতেও পারে। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রত্যেক শিশুকে দিনের কিছুটা সময় একাএকা থাকতে দেওয়া উচিৎ, যখন তারা তাদের নিজেদের খুশি মতো খেলতে, চলাফেরা করতে পারে বা নিজেদের নিয়ে ভাবতে পারবে, এটা শিশুমনের বিকাশের জন্য বিশেষভাবে জরুরি। স্কুলে এই ধরণের শিল্পকলার ব্যবস্থা থাকলে শিশুরা পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে এই সব বিষয়েও শিক্ষা লাভ করতে পারে।

আমার এক বাল্যবন্ধুর ছেলে তার বান্ধবীকে বিয়ে করার আগে জিজ্ঞাসা করেছিল তুমি রান্না জানো না রান্না করতে জানো কারণ এই দুটো কথার মধ্যে অনেক পার্থক্য, আজকাল নিজের রান্না নিজে করা বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে। আজকের শিশুদের অনেকেই বড় হয়ে স্কুল কলেজে শিক্ষালাভ করে বিদেশে পাড়ি দেবে যেখানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে সেইসব দেশেই চাকরি করতে করতে বিদেশেই স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে, বড় হয়ে অনেক ছেলেমেয়েই আবার তাদের বাবা ও মাকে পাকাপাকিভাবে সেই সব দেশে নিজেদের কাছে থাকবার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে পড়া বা চাকরি করার সময় কিছুকিছু ছেলেমেয়েরা একা থাকার সময় নিজেদের খাবার নিজেই তৈরি করে নেয়। এর জন্য সারাদিনে এক দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই রান্না করা শিখে নেওয়ার জন্য মায়েদের উৎসাহ দেওয়া দরকার, আজকাল দেখা যায় অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলছাড়ার আগেই রান্না করতে শিখে গিয়েছে, তাই মায়েরা রান্না করার সময় তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের রান্নাঘরে ডেকে নিলে তারা রান্না করায় উৎসাহ পাবে।

মায়েদের রান্না করার সময় বাচ্চারা অনেক কিছু শেখার সুযোগ পায় তাই প্রথম প্রথম বাচ্চাদের কাঁচা শাকসবজি দেখে কোনটা কোন সবজি তা চিনতে শেখানো উচিৎ, টেবিলে শাকসবজিগুলো রেখে সেগুলো বাচ্চাদের মার কাছে আনতে শেখানো দরকার। ধীরেধীরে রান্নায় ব্যবহার হয় এমন মশলাগুলোর সঙ্গেও পরিচয় করানো দরকার, বাচ্চারা একটু বড় হলে তাদের রান্না করতে শেখার সময় প্রথমে জলখাবার তৈরি করাতে শেখালে ছুটির দিনে তারা নিজেদের টিফিন নিজেরাই তৈরি করতে পারবে। যেমন ডিম বা আলু সিদ্ধ করা, টোস্টারে পাউরুটি সেঁকা, তাতে মাখন লাগানো, কলার খোসা ছাড়ানো আর খাবার টেবিলে প্লেটে জলখাবার সাজিয়ে রাখতে শেখানো, ওভেন বা ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার সময় অবশ্যই তাদের মা ও বাবা বাচ্চাদের সঙ্গে থাকবেন বিশেষ সাবধানতা নেওয়ার জন্য।

নিজেদের জলখাবার নিজেরা বানিয়ে নিয়ে খাওয়ার আনন্দটাই আলাদা, এইভাবে বাচ্চাদের রান্না করায় উৎসাহ বাড়বে। বয়স বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে ধীরেধীরে তারা ভাত, ডাল, তরকারি আর অন্যান্য খাবার রান্না করাও শিখে যাবে। ছেলেমেয়েরা যতদিন বাড়িতে মা বাবার কাছে থাকে তারা যত্নে থাকে, সময়মত পুষ্টিকর খাবার খেতে পায়। সমস্যা শুরু হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য রাজ্যে বা বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করা বা চাকরি করার সময়, থাকার জন্য ভালো হস্টেল পাওয়া গেলে ঠিক আছে, অনেক সময় দেখা যায় ৩-৪ জন বন্ধুবান্ধব মিলে কলেজের হস্টেল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকে আর হোটেল বা হোম ডেলিভারি করা খাবার খাওয়া শুরু করে, বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় এই সব খাবারের গুণগত মান খুবই খারাপ। এই সমস্ত খাবার খেয়ে শরীর খারাপ হতে শুরু করে, বন্ধুবান্ধবদের কয়েকজন ছেলেমেয়েদের দেখেছি অসুস্থ হয়ে তাদের কেউকেউ কলেজ ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছে। ছেলেমেয়েদের রান্না করা জানা থাকলে এই ধরণের সমস্যায় পড়তে হয় না, নিজের খাবার নিজে তৈরি করার শিক্ষাটা ছোটবেলাতেই শিশুদের মনে ধরিয়ে দিতে হবে। আমার মনে হয় ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার এটাই অন্যতম আর জরুরি পদক্ষেপ, এব্যাপারে মায়েরা সচেষ্ট হলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারণ এতে ভবিষ্যতে তাঁদের ছেলেমেয়েদের সুস্থ আর সবল থাকবে।

আমাদের দেশে বা বিদেশে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দুজনাই চাকরি করলে তাদের প্রতিদিনের কাজ ভাগ করে নেওয়া উচিৎ, আমি দুটি ছেলেমেয়েকে জানি যারা বিয়ের কয়েকদিন পর সকালবেলায় গরম চায়ের কাপটা কে কার হাতে তুলে দেবে তাই নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা কানে আসার পর ফোনে আমি ছেলেটিকে বলেছিলাম প্রথম সপ্তাহে তুমি চা বানাও আর পরের সপ্তাহে তোমার স্ত্রী বানাক। বিদেশে কোন কাজের লোক পাওয়া যায় না সব কাজ নিজদের করতে হয়, অবশ্য জামাকাপড় কাচার জন্য ওয়াশিং মেশিন, বাসনপত্র ধোয়ার জন্য ডিশওয়াশার, ঘরদোর পরিষ্কার করার জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার সবরকম যন্ত্রই পাওয়া যায় শুধু নিয়ম করে সময় মতো চালানো শিখতে হবে। বিদেশে এসে আর একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যে ছেলে বা মেয়ে সকলকেই গাড়ি চালানো শেখাটা বিশেষ দরকার তাই দেশে থাকার সময় ছেলেমেয়েদের গাড়িচালানো শিখে নিজেদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেওয়া দরকার যাতে বিদেশে এসে গাড়িচালাতে আর বিদেশের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে কোন অসুবিধা নাহয়।

আর একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, আমাদের দেশে আর বিদেশে প্রায় সব শহরেই দেখা যাচ্ছে খুব ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা অত্যধিক মোটা হয়ে যাচ্ছে এটা শিশুদের এক ধরণের রোগ, ডাক্তারবাবুরা বলছেন মা বাবারা একটু সতর্ক হলেই তাঁদের বাচ্চাদের এই রোগ থেকে বাঁচাতে পারেন। দেখতে রোগা কিছু ছোট ছেলে বা মেয়েদের মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের দরকারের অতিরিক্ত খাবার খাওয়ান, তাঁরা ভাবেন বেশি খাওয়ালেই তাঁদের রোগাবাচ্চারা মোটা হয়ে যাবে এটা খুবই ভুল ধারণা। বাচ্চাদের সুস্থ রাখাটাই সব থেকে আগে দরকার রোজ সময়মত সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালেই বাচ্চারা ঠিক মতো বেড়ে উঠবে, প্রয়োজনের বেশি যে কোন খাবার শিশুদের স্বাস্থের ক্ষতি করে। এই ব্যাপারে আমার কলেজ জীবনের এক ঘটনা মনে পড়ে গেলো, আমার এক সহপাঠীর বোন তার বছর তিনেকের মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তিত, রোগাটে শিশুটি বেশ চনমনে কিন্তু খাবার খেতে চায় না, তার মা সকাল থেকে রাত অবধি মেয়ের পিছন পিছন খাবারের বাটি আর চামচ নিয়ে দৌড়ে বেড়ান। আমার সহপাঠীর বাবা কোলকাতার নাম করা শিশু বিশেষজ্ঞ ছিলেন, বন্ধুটির বোন তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তার কথাটা তার ডাক্তার বাবাকে জানিয়েছিল। ডাক্তার বাবা তাঁর মেয়েকে বলেছিলেন বাচ্চারা যখন খেতে চাইবে না তখন জোর করে খাওয়ানোর দরকার নেই আর একদিন না খেলে তাদের কোন ক্ষতি হয় না, শিশু আর বৃদ্ধ লোকেরা খিদে পেলে তারা বসে থাকবে না, চেয়ে খাবে তাই তিনি তাঁর মেয়েকে খাবার হাতে নাতনির পিছন পিছন দৌড়াতে বারণ করে দিয়েছিলেন।

আজকাল শিশুদের জন্য আর এক ক্ষতিকারক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের নাম মোবাইল বা স্মর্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ আর ভিডিওগেম। আমি কোনোমতেই বুঝতে পারি না দু’তিন বছরের বাচ্ছাদের হাতে তাদের মা বাবারা কিভাবে এই সব ক্ষতিকারক যন্ত্রগুলো তুলে দেন? কাল টিভিতে দেখছিলাম স্কুলে পড়া দশ বছরের একটি ছেলে দিনে প্রায় বার থেকে চোদ্দ ঘণ্টা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে গেম খেলে, সারাদিনে কোনরকমে কিছু খায় আর কিছু দিন হোল সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ কোরে দিয়েছে। বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন, তাঁদের একমাত্র ছেলের শরীর ভাঙতে বসেছে আর সে এখন পুরোপুরি মানসিক রোগের শিকার। বছর খানেক হোল ছেলেটির নিয়মিত চিকিৎসা চলছে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন আরও প্রায় দুইতিন বছর চিকিৎসা করাতে হবে সুস্থ হওয়ার জন্য, ছেলেটি তার স্কুলের পড়া থেকে তিনচার বছর পিছিয়ে পড়েছে। গবেষকেরা বলছেন এখন শিশুরা প্রযুক্তিপণ্যে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে তাদের হাত থেকে মোবাইল ফোন বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যায় বা নেতিবাচক আচরণ শুরু করে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা অন্য কোন দিকে খেয়াল করে না, কারো সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখি তারা মোবাইল গেম খেলতে খেলতে বা টিভিতে কার্টুন ছবি না দেখলে খাবার মুখে তোলে না।