• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

নির্বাচিত স্কুল কলেজের ইতিহাসের আলোকে শিক্ষার অভিমুখ নির্ণয়

১৯৩৮ সালে রায়বাহাদুর পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর মন্তব্যে জানান কুচিয়াকোল ছাত্রাবাস বর্ধমান বিভাগের মধ্যে অনুপম ও অদ্বিতীয়। এই বিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ঊনবিংশ সংখ্যক প্রধান শিক্ষক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সকলেই অতিশয় উচ্চ স্তরের ব্যক্তিত্ব।

বেথুন স্কুল একঝাঁক মহীয়সী নারী-প্রতিভা সৃষ্টি করেছে, যা চরম বিস্ময় ও সম্ভ্রমের বিষয়। ভারতের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী, ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিনী লেডি অবলা বসু বেথুনের প্রাক্তনী। এ স্কুল বীণা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তের মতো বীরাঙ্গনাদের জন্ম দিয়েছে। কামিনী রায়, সুখলতা রাওয়ের মতো শক্তিশালী মহিলা কবি এখানে পড়াশুনা করেছিলেন। নাট্যব্যক্তিত্ব শোভা সেনও বেথুনের প্রাক্তন ছাত্রী। বাঁকুড়া ফ্রি স্কুল শুরু হয় ১৮৪০ সালে। স্থান সিপাহীদের জন্য বরাদ্দ হাসপাতাল ভবন। প্রতিষ্ঠাতা জেলা জজ ফ্রান্সিস গোল্ড সবেরি। তাঁর সহযোগী ছিলেন ধর্মযাজক ডব্লিউ জে ওয়েইট ব্রেক, সিভিল সার্জেন ও নীলকর জি এন সি। সম্পূর্ণ বিনাবেতনে পড়ানো হতো। বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করা হতো। অৰ্থ যোগাতেন বাঁকুড়ার ধনী, চাকুরিজীবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। জেলাশাসক জর্জ লচ প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে পড়াতেন। ১৮৪৫-এ ছাত্রসংখ্যা ছিল ৮৪ জন। এই স্কুল পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল ‘দি লোকাল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন’। এই ফ্রি স্কুল কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। এই অবৈতনিক স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন যাদবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর পূর্বোক্ত ঘোষণায় সারা দেশে যে চাঞ্চল্য ও ইংরেজি-আগ্রহ দেখা দেয় তার ফল-পরিণাম বাঁকুড়া জিলা স্কুল। প্রতিষ্ঠা বর্ষ ১৮৪৬। এটি সূচনা থেকেই হাই ইংলিশ স্কুলের তালিকা ভুক্ত। সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে মঞ্জুরিকৃত বাঁকুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকগণ খুবই যোগ্য, মেধাসম্পন্ন ও ছাত্র দরদী ছিলেন। বিটসন, ক্যাপ্টেন স্পিয়ার-এর মত সাহেবদের তুলনায় বাঙালি স্কুল প্রধানগণ কোনো অংশেই ন্যূন ছিলেন না। নবীনকৃষ্ণ সরকার, বিশ্বনাথ সিংহ, কুঞ্জবিহারী চক্রবর্তী, চন্দ্রনাথ মৈত্র, কুঞ্জবিহারী পাল, শশধর রায়, কেদারনাথ ঘোষ, হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভোলানাথ সরকার ও অন্যান্যরা ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্কুল-প্রধান। বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন হরিচরণ দাস নামজাদা শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিশিষ্ট ছাত্র কুলদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিখ্যাত আইনজীবি বসন্তকুমার নিয়োগী, সাব জজ হরগোবিন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রবাদ প্রতিম আইনজীবি রাসবিহারী ঘোষ। কেদারনাথ কুলভী ছিলেন ব্রাহ্মনেতা। তাঁর দেশখ্যাত ছাত্রের নাম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এই স্কুলের প্রাক্তনী নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। রবীন্দ্র গবেষক ক্ষুদিরাম দাস সেই স্কুল থেকে (১৯৩৩) বৃত্তি পেয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক মল্লরাজধানী থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একেবারে একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছিলেন কোনো সাহেবসুবো নন। একজন দেশীয় রাজা। মা সারদার জন্মধন্য ছোট্ট নদী দামোদরের দক্ষিণতীরবর্তী দিগপার গ্রামে গড়ে তোলা এই শিক্ষালয়ের নাম কুচিয়াকোল রাধাবল্লভ ইনস্টিটিউশন। ১৮৬২ সালে ৯ জুলাই এটি প্রতিষ্ঠা করেন বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের বংশধর কুচিয়াকোল – রাজা রাধাবল্লভ সিংহঠাকুর। তাঁকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বাঁকুড়া জেলার ভূমিপুত্র ময়নাপুরবাসী উচ্চপদস্থ বিদ্যালয় পরিদর্শক পরমানন্দ মুখোপাধ্যায়। মল্লরাজাদের মন্দির নির্মাণে অধিক আগ্রহ ছিল।

কিন্তু রাজা রাধাবল্লভ দেবমন্দির নয়, বিদ্যামন্দির নির্মাণ করে পরিবারের ট্র্যাডিশন ভাঙেন ও প্রথম অভিনব পথে পদচারণা করেন। এ দিক দিয়ে তিনিই প্রথম এই রাজপরিবারে বিপ্লব সাধন করেন। ইংরাজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা থেকেই উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এ বিদ্যালয়ের প্রথম সম্পাদক। ১৮৭৪ সালে হান্টার সাহেব জানিয়েছিলেন জেলাশাসক ও বিদ্যালয়সমূহের উপপরিদর্শক ভূয়সী প্রশংসা করলেও ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিলি। ১৮৭২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসা ১১ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন কৃতকার্য হয়। এক জন প্রথম বিভাগে, দু’জন দ্বিতীয় বিভাগে, আর তিনজন তৃতীয় বিভাগে পাশ করে। একটি শিক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ১৮৭৭ সালে ২ জুলাই ছাত্র উপস্থিত ছিল ১২২জন। সে বছর মোট ছাত্রসংখ্যা ছিল ১৫০ জন। ১৮৯৩ সালের একটি রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে বিদ্যালয় সরকার থেকে ৭০ টাকা বৃত্তি পেতো।

প্রথমে নাম ছিল কুচিয়াকোল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রাধাবল্লভ সিংহ ঠাকুরের মৃত্যু হয়।১৮৯১ সালে তাঁর স্মৃতি ও সম্মানে বিদ্যালয়টির নাম লেখা হয় কুচিয়াকোল রাধাবল্লভ ইনস্টিটিশন। ১৮২৯ সালে তাঁর যোগ্য পুত্র সম্পাদক ক্ষেত্রনাথ সিংহঠাকুর তাঁর উইলে বিদ্যালয়কে মাসে পঞ্চাশ টাকা দেবার সংস্থান রেখেছিলেন।

১৯৩৮ সালে রায়বাহাদুর পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর মন্তব্যে জানান কুচিয়াকোল ছাত্রাবাস বর্ধমান বিভাগের মধ্যে অনুপম ও অদ্বিতীয়। এই বিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ঊনবিংশ সংখ্যক প্রধান শিক্ষক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সকলেই অতিশয় উচ্চ স্তরের ব্যক্তিত্ব। প্রথম বিদ্যালয়-প্রধানের নাম ব্রজবল্লভ মিত্র। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যেমন হরিশংকর দত্ত, কুঞ্জবিহারী পাল, কেশব চন্দ্র মিত্র, ইউ সি গুপ্ত তেমনই বন মালী গুপ্ত। সকলেই তুল্যমূল্য।