সংস্কৃতি চর্চা ও ছাত্র গবেষকদের দিশারী ‘পশ্চিম রাঢ় ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’

১৯৯৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাঁকুড়া জেলা গ্রন্থাগারে কিছু সাহিত্য কর্মী অধ্যাপক এবং সাহিত্যমনস্ক মানুষ এলাকার বস্তুনিষ্ঠ অতীত অনুসন্ধান এবং আকর অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একটি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ভাবলেন। তাঁদের এই ভাবনা সাকার হয়ে উঠল ২০০০ সালের ১৭ মার্চ। ঐদিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পথ চলা শুরু হল এক সাহিত্য সংগঠন এবং গবেষণা চর্চা কেন্দ্রের। গড়ে উঠল ‘পশ্চিম রাঢ ইতিহাস ও সংস্কৃত চর্চা কেন্দ্র’। ঐদিন উপস্থিতি ছিলেন এলাকার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত, অধ্যাপক মিহির চন্দ্র কামিল্যা, লীলাময় মুখোপাধ্যায়, রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী, উৎপল চক্রবর্তী, রাজ্য পুরাতত্ব আধিকারিক ডক্টর গৌতম সেনগুপ্তসহ তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক পার্থ দে, অনগ্রসর সম্প্রদায় কল্যাণ মন্ত্রী ওপেন কিসকু সহ এক ঝাঁক পন্ডিত ও ঝাঁক বিদগ্ধ মানুষ। ওই দিনেই সভায় আর একবার সংগঠনের উদেশ্য ও রূপরেখা অনুযায়ী উচ্চারিত হল সংগঠনের পুর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্যে- ‘সংগঠন চায় বস্তুনিষ্ঠ অতীত অনুসন্ধানের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং আকর অনুসন্ধান এবং এলাকায় সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অনুশীলন’। ২০০৫ সালে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে গৃহ নির্মাণের জন্য দু লাখ টাকা অনুদানও পেল এই সংগঠন। তৈরী হল বাঁকুড়ার কেন্দুয়াডিহির শ্রীনগর পল্লীতে স্থায়ী গৃহ। রাজ্য সরকারের কাছ থেকেও মিলল কিছু অনুদান। কিন্তু এই ধরনের সংগঠনে বাইরের অনুদান বন্ধ হলেই গতি রুদ্ধ হয়, কাজকর্মে আসে অনীহা আলস্যের ভাব। এখানেও তাই প্রথম কয়েক বছরের পরই থেমে গেছে সরকারি অনুদান কিন্তু থেমে নেই এই সংগঠনটির পথচলা। সে দিনের সেই সব বিদগ্ধজনের অনেকেই আজ এই পৃথিবীতে নেই কিন্তু বন্ধ হয়নি সেই স্বপ্নের উড়ান। সেদিনের বাকি যুব সাংস্কৃতিক কর্মীদের লেগে থাকা প্রচেষ্ঠায় কয়েক বছরের মধ্যেই শৈশব অবস্থা কাটিয়ে ওঠে নির্দিষ্ট লক্ষে এগিয়ে চলেছে এই গবেষণা ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। সেদিনের তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীরাই আজ এই সংগঠনটির অন্যতম চালিকা শক্তি।

যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে উঠে আসে গৌতম দে, পার্থ গোস্বামী, সুশান্ত গাঙ্গুলী, অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। ইন্টারনেটের যুগে যেখানে ক্রমশই লাইব্রেরীগুলি মুখ থুপড়ে পড়ছে কিংবা উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে উঠে যাবার মুখে। সরকারি গ্রন্থাগারে কর্মী সংখ্যার অভাবে যেখানে পাঠক উপযুক্ত পরিষেবা না পাওয়ায় ক্রমশই মুখ ফেরাচ্ছে লাইব্রেরী থেকে। সেখানে সরকারি সাহায্য ব্যতীত কিছু মানুষের শুভ প্রচেষ্টায় এই সংস্থাটি পথচলা আজ এক বিরল দৃষ্টান্ত। প্রতিদিন বিকাল ৪টে থেকে এখানে সারস্বত চর্চার মিলন মেলা। রাঢ ইতিহাস বলতে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ভাগীরথীর পশ্চিম তির থেকে ছোটনাগপুর অরণ্য মালভূমির বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড। আবার এই রাঢ পশ্চিমাঞ্চল বলতে সাঁওতাল পরগনা, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকেই বোঝায় যার প্রধান কেন্দ্র বাঁকুড়া। আর এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস লোক জীবনের আদিম জীবানাচর্য। তাদের সমাজ জীবন, ধর্ম জীবন এবং লোকায়ত জীবনচর্চার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে সংস্থাটির গুরুত্ব অসীম। এলাকার প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ইতিহাস ও সাহিত্যকে তুলে ধরার কাজটি আজ শুধু বহমান নয় বেগবান। কিন্তু শুধু রাঢের ইতিহাস নিয়ে থেমে নেই সোসাইটি। তার মূল ভাবনাকে অটুট রেখে আজ একটি সর্বজনীনরূপ লাভ করেছে এই সংস্থাটি। তাই আজ এখানে শুধু এই অঞ্চলের পুরাতথ্য ইতিহাস, নৃতত্ব, ভাষা সাহিত্য, লিপি ও ভাষা চর্চার কেন্দ্র হিসেবেই নয় এটি আজ সাহিত্য ও ইতিহাস প্রেমী রাজ্যবাসীর কাছে সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থানের রূপ নিয়েছে (প্রয়োজনে যোগাযোগ ৯৫৩১৬৪৮৮৪৬ ও ৯৪৭৫৩৭১২৭৭)।

দু’দশকের ও বেশি সময় ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে এই চর্চা কেন্দ্র। গবেষক এবং সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, হাজার হাজার ছাত্রদের কাছে অন্যতম ভরসার স্থল। এখানে যেমন স্থান পেয়েছে চিরায়ত সাহিত্য, প্রাচীন প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ বই তেমনি লুপ্তপ্রায় নামিদামি পুরনো পত্রিকার সম্ভার। আছে বিগত পঞ্চাশ বছর বা ১০০ বছর আগেকার উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংবাদপত্র।


স্থানীয় বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পার্শবর্ত্তী বিশ্বভারতী, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা আসে গবেষণার কাজে। এখানে ভিড় জমায় কলকাতা, হাওড়া থেকে আসা গবেষক ও সাহিত্যপ্রেমী বহু মানুষও। সাহিত্যের এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন পুঁথিসহ নানান শিলালিপি, প্রস্তর খণ্ড ও প্রাচীন হস্তশিল্পের সৃষ্টিশীল দুর্লভ কিছু কাজ। এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাপেক্ষা যাঁর কৃতিত্ব তিনি হলেন গৌতম দে। ২০০০ সালের এই কেন্দ্রের অন্যতম সাহিত্যকর্মী সেদিনের সেই যুবক আজকের প্রৌঢ গৌতম দের উৎসাহের এখনও খামতি নেই। তিনি নিজেও একজন প্রাবন্ধিক। বিভিন্ন গবেষকদের সম্মান জ্ঞাপন বা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সাহিত্য আলোচনা এই সংগঠনের অন্যতম কাজ। পাশাপাশি চলছে প্রকাশনা। নিয়মিত প্রকাশিত হয় সংগঠনের মুখপাত্র “পশ্চিম রাঢ় গবেষণা ষাণ্মাষিক’। এ পত্রিকা ছাড়াও তাঁদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই। জানালেন বর্তমান সেক্রেটারি গৌতম দে। তার মধ্যে আছে রথীন্দ্রমোহন চৌধুরীর ‘বাঁকুড়া জনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’, ‘বাঁকুড়ার গোড়াপত্তন এর ইতিহাস ও বিকাশ’। অনিল কুমার চৌধুরীর গ্রন্থ ‘সাবেক মালভূমি ও আধুনিক পুরুলিয়া’ প্রভৃতি।

সম্প্রতি মহাকবি শেক্সপীয়ারের চতুর্থ জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রচিত আজ থেকে ৫০ বছর আগের বাংলার সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিকদের লেখা মহামুল্যবান সংকলনটির পুনরুদ্ধার করে প্রকাশিত করেছেন তাঁরা। সাহিত্য প্রেমীদের জন্য অবারিত দ্বার এই সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রটির।