শান্তিনিকেতনে খ্রিস্টোৎসব

ফাইল চিত্র

অপূর্বকুমার চট্টোপাধ্যায়

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের একুশে ডিসেম্বর (৭ই পৌষ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ) শান্তিনিকেতনে উপাসনা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দিরটি ‘কাচঘর’ নামেও প্রসিদ্ধ। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার সূত্রপাত। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স প্রায় ৩৪ বছরের কাছাকাছি। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বোলপুর তথা শান্তিনিকেতনে আসেননি। কাজেই শান্তিনিকেতনে উপাসনা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বা শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার শুভারম্ভ, কোনটির ক্ষেত্রেই দেবেন্দ্রনাথের উপস্থিতি নেই। তবে সকল অনুষ্ঠানের সকল কিছুই তাঁর জ্ঞাতসারে হয়েছে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি দুপুর একটা পঞ্চান্ন মিনিটে ৮৮ বছর ৮ মাস বয়সে দেবেন্দ্রনাথ দেহত্যাগ করেন। দেবেন্দ্রনাথের পর পরই পৌষমেলার দায়-দয়িত্ব বর্তায় কবি রবীন্দ্রনাথের ওপর অর্থাৎ রবীন্দ্রযুগের সূত্রপাত ঘটে তখন থেকে।

শান্তিনিকেতনে খ্রিস্টোৎসবের সূচনাকাল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পঁচিশে ডিসেম্বর। তবে এর জন্য সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল এর আগের বছর থেকে অর্থাৎ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে। ঐ বছর সন্ধ্যাকালীন উপাসনার ভাষণে ( ‘ভক্ত’ শীর্ষক ) কবি বলেছিলেন, ‘ মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহন করছেন যিশু তাঁদের অন্যতম। ‘ তবে পূর্ব ইতিহাস সন্ধান করলে এখানে ‘ খ্রিস্টোৎসব ‘ যে একটি ‘প্রথাভাঙা’ তথা ‘প্রথা- সংযোজন’ -এর ঘটনা, সেটি অনুধাবন করা যায়। এটি সম্ভব করে তুলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।


ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমাজ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে এই ‘সম্ভব- অসম্ভব’ কথাটির সত্যতা নজরে পড়ে। ইংরেজ রাজত্বে তখন দেশে গির্জার বাড়- বাড়ন্ত; সবার নজর কেড়েছিল। সেখান থেকে ধর্মযাজকদের উপস্থিতির জানান পাওয়া যেত সদা সর্বদা। তাঁরা এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করার কাজে কায়মনোবাক্যে নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন। তাদের কাছে ধর্মকথা মানেই যিশু সম্পর্কিত গল্প- গাথা। ভারতের মানুষদের সকল কর্মই তখন অন্ধ কুসংস্কারের আচ্ছাদনে আবৃত বলে তাঁদের মনে হতো ও উপহাসের বিষয়বস্তু বলে বিবেচিত ছিল। তেল মেখে প্রত্যহ গঙ্গা স্নান করা, ধর্মীয় রীতিনীতি মান্য তথা পালন করা, খাওয়া-দাওয়ার বিষয় প্রভৃতি ছিল কুসংস্কার। আমাদের কিছু কিছু কৃষ্টি, যেমন— যাত্রাপালা, পাঁচালীগান, কবিগান, ঝুমুরগান এগুলিতে নেমে এসেছিল আইনের বাধা। কৃষক-শ্রমিক-মজুর তাদের কাজকর্ম বা জাত ব্যবসা খুইয়ে, ক্ষুধার জ্বালায় ভবঘুরে হ’তে বাধ্য হয়েছিল এবং অপরাধপ্রবণ শ্রেণি বলে খ্যাত হয়েছিল। মেরুদন্ডী মানুষেরা হয় অপমান সয়ে চাকরি করতে বা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আর যাঁরা ইংরেজ প্রিয় হতে চেয়ে বাঙ্গালি সাহেব বনেছিলেন. যেমন প্রসন্ন কুমার, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি মানুষজন, তাঁরাও কিন্তু অভিজাত বংশীয়দের জন্য নির্দিষ্ট ‘বেঙ্গল ক্লাব’-এ প্রবেশের অধিকার পাননি।বঙ্কিমচন্দ্র চাকরি বাঁচাতে লিখিত উপন্যাসের অংশবিশেষে পরিবর্তণ এনেছিলেন। ধর্মান্তরিত বাঙালি যাজকেরা খ্রিস্টান যাজকদের মনের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। ব্রাহ্মসমাজের আবির্ভাব হলেও তা তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।

দ্বারকানাথের পর এলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মনে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে যে বিরূপতা ছিল, তা আমরা জানি। এর কারণও সেই তৎকালীন সমাজে ‘খ্রিস্টান’ ভাবধারা ও কাজকর্ম অর্থাৎ ধর্মান্তরকরণ। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং রেবা চাঁদ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং সাথে সাথে তাঁদেরকে এই অপরাধের জন্য ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়েছিল। পিতার এই মনোভাবকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দোষ দিতে পারেননি। বরং তাঁর মনে হয়েছিল এটাই স্বাভাবিক। তিনি লিখেছেন যে, খ্রিস্টের পরিচয় আমরা পেয়েছি খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকেই। ‘খ্রিস্টকে তাঁহারা খৃস্টানি দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তাঁহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্ম সংস্কারকে তাঁহারা পরাভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। সুতরাং আত্মরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া থাকি।’

(যীশুচরিত/ রবীন্দ্র রচনাবলী -একাদশ খন্ড/পৃ-২৫৯/প. ব. সরকার।) রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে বাইবেল পড়েছিলেন। তবে বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ এর অংশটি তিনি পছন্দ করতেন না। অলৌকিকতার আবরণে উদ্ভাসিত ঘটনা তাঁর পছন্দের বাইরে ছিল সদা সর্বদা। কিন্তু বাইবেল এরই ‘নিউ টেস্টামেন্ট ‘ এর অংশটি তাঁর খুবই পছন্দের ছিল। বিশেষত এই অংশে যিশু চরিত্রের অলৌকিকতার ঘটনা নেই, তাঁর মানবপ্রেমিক রূপটি কবিকে টানত। তাঁর ‘চারিত্র পূজা’ গ্রন্থে যিশু বিষয়ে পাঁচটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে । সেগুলি হল, ১) যীশু চরিত (২৫শে ডিসেম্বর ১৯১০)। শান্তিনিকেতনে প্রথম খ্রিস্টোৎসব পালনের দিন রবীন্দ্রনাথ এটি পাঠ করেছিলেন। পরবর্তী প্রবন্ধগুলি হ’ল ২) খ্রিস্টোৎসব (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ), ৩) মানব সম্বন্ধের দেবতা( ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ), ৪) বড়দিন (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ)। প্রসঙ্গত বড়দিন শব্দটি ২৫শে ডিসেম্বর সম্পর্কে প্রথম ব্যবহার করেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার একটি লেখায়। “খৃস্টের জন্মদিন বড়দিন নাম/ বহু সুখে পরিপূর্ণ কলিকাতা ধাম।” এবং ৫) খ্রিস্ট (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। সবকটি প্রবন্ধই শান্তিনিকেতনে লেখা। এগুলি পড়লে খ্রিস্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণার একটি উজ্জ্বল চিত্র পাওয়া যায়। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা চলাকালীনই খ্রিস্টোৎসব পালনের দিনটি অর্থাৎ ২৫শে ডিসেম্বর এসে যায়। পৌষ মেলার অনুষ্ঠান সূচিতে ২৫ শে ডিসেম্বর খ্রিস্ট উৎসব পালনের নির্ঘণ্ট উল্লিখিত থাকে। প্রসঙ্গত কয়েক বছর থেকে পৌষ মেলা বন্ধ থাকলেও এই অনুষ্ঠানটি পালিত হয়ে আসছে।

যাইহোক, ঠাকুরবাড়িতে খ্রিস্ট সম্পর্কে ব্যতিক্রমী ধারণা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই ১৬-১৭ বছর ধরে চলে আসা কার্যক্রমে দায়িত্ব পাবার পাঁচ বছরের মধ্যেই বাধার প্রাচীর তিনি ভেঙে ফেললেন। মেলার অনুষ্ঠান সূচিতে সংযোজন করেছিলেন ‘খ্রিস্টোৎসব’। লেখার প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে পৌষ উৎসবের সন্ধ্যাকালীন উপাসনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্মরাজ্যে তিনজন মহাপুরুষের কথা স্মরণ করেছিলেন। তাঁরা হলেন গৌতমবুদ্ধ, যীশু এবং চৈতন্যদেব। তিনজনই ছিলেন সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষের কথা বলেছিলেন; তাঁদের জাতপাত বা ধর্ম- সংস্কারের কথা বলেননি। সময়টা লক্ষ্য করুন, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ। সমাজে তখন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাব বহমান তথা বেগবান ধারায় প্রবাহিত। যদিও দু’জনেই তখন অনুপস্থিত। এই ধারার এক প্রত্যক্ষ অংশ হয়ে বেঁচে রয়েছেন এবং নিজেদেরকে নিবেদিত করে রেখেছেন ‘মা সারদা’ আর ‘নিবেদিতা’। তাঁরা জাজ্জ্বল্যমান দীপশিখা হয়ে প্রতিষ্ঠিত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সাথে নিবেদিতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তাঁকে তিনি ‘লোকমাতা’ উপাধি দিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর পরিকরদের চিন্তাভাবনার প্রভাব তাঁকে প্রেরিত করেনি তো, এইরকম একটি অনুষ্ঠান ‘মেলার’ কার্যসূচিতে সংযোজন করতে? ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কবির ‘গোরা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের ‘আনন্দময়ী’-র চরিত্রে অনেকে লক্ষ্য করেছেন, হঠাৎ আসা ‘মা সারদা’-র অন্তর্লোকের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়তে; বিচ্ছুরিত হ’তে।