• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

বিকল্প বাছার বিকল্প দরকার

এই কি খাতা দেখার সময় কমের নমুনা? আজকে হয়তো অনেকেই এর বিপদ আঁচ করতে পারছেন না, কিন্তু, অদূর ভবিষ্যতে এই ভয়ংকর পদ্ধতির পরিণাম থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানো সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরী হবে।

মেধা যাচাইয়ের সঙ্গে MCQ পরীক্ষার সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক জায়গায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এসময়ে আমাদের দেশে বহু বড়ো বড়ো পরীক্ষায় এই MCQ বা বহু বিকল্প ভিত্তিক প্রশ্নকে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসাবে ধরা করা হয়। অনেকে মনে করেন পরীক্ষা ব্যবস্থা সহজ আর খাতা দেখার সময় বাঁচে বলে এই পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হচ্ছে কিন্তু, এই সময় চতুর্দিকে MCQ প্যাটার্নের বিরুদ্ধে ছাত্র ছাত্রী এবং শিক্ষার্থীদের একাংশ সোচ্চার হচ্ছেন। সম্প্রতি নিট পরীক্ষাকে ঘিরে যে কান্ড ঘটলো বা NTA আয়োজিত UGC NET পরীক্ষাও যেভাবে বাতিলের দিকে চলে গেলো এই সব ঘটনা আবার MCQ প্যাটার্নকে নুতুন করে বিবেচনা করার ইঙ্গিত দিলো। খাতা দেখার সময় বাঁচাবে বলে আমরা যেভাবে পরীক্ষার পড়াশুনোকে অন্য দিকে পরিচালিত করে দিয়েছি, তাতে আমাদের সমাজের খুব একটা হিত সাধিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

বিশেষ করে এই প্যাটার্নের পরীক্ষায় একটি প্রশ্নের উত্তর হিসেবে চারটি কিংবা পাঁচটি বিকল্প থাকে, পরীক্ষার্থীকে তার মধ্যে থেকে ১ টি সঠিক উত্তরকে বেছে নিতে হয়। এই পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর কোনো বিশ্লেষণী ক্ষমতা, জ্ঞানবুদ্ধির পরিচয় — কিছুই জানা যায় না। এমন কি এই পরীক্ষায় প্রার্থীর হাতের লেখা পর্যন্ত যাচাই করা হয় না। তাতেই পরীক্ষার্থী উত্তীর্ন হয়ে যায়, ভালো নম্বর পায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ভাগ্য। যারা ভাগ্য মানেন না তারাও এক বাক্যে স্বীকার করে নেন। যেমন কেউ সঠিক উত্তর জেনে যেমন অপশনে দাগ দেয়. তেমনি অনেক লোকজন না জেনেও আন্দাজে দাগ দিয়ে দেয় এবং অনেক সময় উত্তর সঠিক হয়েও যায়। অতএব এই MCQ প্যটার্ন নিখুঁত ভাবে কোনো প্রার্থীকে নির্বাচন করতে পারে না।

অনেকে বলেন, এই সমস্যা সাহিত্য বা ভাষার পেপার গুলিতেই বেশি হয়ে থাকে কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই সঠিক উত্তরে দাগ দেওয়া পদ্ধতি কোনো ভাবেই আদর্শ হতে পারে না। বাংলা সাহিত্যের এক জন এই MCQ পদ্ধতির NET পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলো, এই পরীক্ষায় শুধু মুখস্ত বিদ্যা বিচার করা হয়, আর কিছু নয়। যেমন, যদি ধারা যায়, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ছোট গল্প মহেশ থেকে কোনো MCQ পেটার্নে প্রশ্ন আসবে তাহলে প্রশ্ন করা হচ্ছে, গফুর মিয়া মহেশকে যে গাছে বেঁধে রাখতেন — বলে চারটি অপসন। অথবা, বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দফতর থেকে প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছে — চারটি লাইন তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে কোনটি কোন পরিচ্ছেদে আছে সাজাও। এবারে ভেবে দেখতে হবে একজন সাহিত্যের শিক্ষার্থীর কাছে কি এই ধরনের তথ্যমূলক প্রশ্ন আমরা আশা করবো নাকি কোনো লেখার সমাজ বাস্তবতা, বিষয়ের গভীরতা বিশ্লেষণ বা তাতে সময়ের ছাপ — এসব জানতে চাইবো? প্রকৃত সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া বেশ অস্বস্তিকর ব্যাপার।

আজকের যারা বাংলা সাহিত্যের তাবড় তাবড় অধ্যাপক আছেন তারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তাদের সময়ে এই ধরনের পরীক্ষা হলে কত জন পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারতেন! অথচ দেখুন আজ এই MCQ প্যাটার্নের দৌরাত্ম সব জায়গায়। যখন এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছিল তখন শুধু কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় এর সীমাবদ্ধতা ছিল। ধীরে ধীরে সব জায়গায় এই পদ্ধতি চলে এসেছে। এমন কি এই বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবর্তিত পাঠ্যক্রমে একাদশ শ্রেণীর প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষাতেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছিল, এই পদ্ধতিতে খাতা দেখার সময় অনেক কমে যাবে কিন্তু আমরা দেখলাম, WBCS পরীক্ষা ২০২২ এর প্রিলিমিস এর রেজাল্ট বেরোলো ১ বছরের পর। এই কি খাতা দেখার সময় কমের নমুনা? আজকে হয়তো অনেকেই এর বিপদ আঁচ করতে পারছেন না, কিন্তু, অদূর ভবিষ্যতে এই ভয়ংকর পদ্ধতির পরিণাম থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানো সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরী হবে।