দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জীবনে কলকাতা ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি, তারপর রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেন। কিন্তু তাঁর সমধিক পরিচয় একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তাঁকে একজন উচ্চমানের শিক্ষাবিদ হিসাবে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রায় সারাটা জীবন তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। জীবনে তিনি দুটি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন, তাহল শিক্ষকতা এবং ভারতের হিন্দু দর্শনকে দেশে বিদেশে আরও বেশি করে আলোকিত করা। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের কলকাতার সঙ্গে যোগ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

রাধাকৃষ্ণানের এম এ পরীক্ষার ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অধ্যাপক হগ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই রাধাকৃষ্ণানের অধ্যাপনার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি দুরুহ দার্শনিক তত্ত্বের সরল এবং হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যাতা হিসাবে পণ্ডিত সমাজের অভিনন্দন লাভ করেন। ১৯১৬-১৭ সালে তিনি পূর্ণ মর্যদায় অধ্যাপক পদে প্রতিষ্ঠিত হলেন। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনায় রত ছিলেন। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বড়ো ভাই সতীশচন্দ্র মজুমদার সর্বভারতীয় সেচ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সেই সময় মহীশূরে কার্যোপলক্ষে বাস করছিলেন। তখন রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে সতীশচন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। রাধাকৃষ্ণানের মণীষা এবং বিচারবুদ্ধি সতীশচন্দ্রকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে এবং তিনি তাঁর ভাই রমেশচন্দ্রকে একটি চিঠিতে জানান যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল শীঘ্রই অবসর নেবেন, সেই শূন্যপদে যদি রাধাকৃষ্ণানকে নিয়োগ করা হয়, তাহলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সব দিক দিয়ে লাভবান হবেন। এই প্রস্তাব যদি তদানীন্তন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে পেশ করা যায় তাহলে তিনি বিবেচনা করবেন। এ ব্যাপারে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে তৎপর হতে বলে চিঠি লেখেন। স্যাডলার কমিশনের কাজ উপলক্ষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে সেই সময় মহীশূরে যেতে হয়। তিনি রাধাকৃষ্ণানকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেন। রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় স্যার আশুতোষ মুগ্ধ হন এবং তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করেন। সেই সময় এই পদের নামটি ছিল “কিং জর্জ দি ফিফথ প্রফেসর অব মেন্টাল অ্যান্ড মরাল সায়েন্স”।

রাধাকৃষ্ণান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম প্রফেসর পদে ১৯২১ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তাঁর আগে ১৯১২ সালে তাঁর রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ইংরেজী অনুবাদের মাধ্যমে। ‘গীতাঞ্জলী’ এবং ‘সাধনা’ নামক পুস্তক দুখানি রাধাকৃষ্ণানের মনে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। ১৯১৭ সালে ‘The Ouest’ পত্রিকার এপ্রিল ও জুলাই সংখ্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সম্পর্কে দুটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ঐ প্রবন্ধ দুটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে রাধাকৃষ্ণানকে চিঠি দিয়েছিলেন। পরে প্রবন্ধগুলি সংকলন করে ‘Philosophy of Rabindranath Tagore’ নামে একখানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি প্রকাশের আগে এর একটি ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিখানি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথ এর প্রত্যুত্তরে একটি চিঠি রাধাকৃষ্ণনকে পাঠিয়ে দেন। পরে লন্ডনের এক বিখ্যাত প্রকাশক সংস্থার সম্পাদক অধ্যাপক J. H. Murihead ভারতীয় দর্শনের একখানি সুসংবদ্ধ ইতিহাস রচনার জন্যে তিনি রাধাকৃষ্ণানকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের ফল স্বরূপ রাধাকৃষ্ণানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Indian Philosophy র’ প্রথম খন্ড ১৯২৩ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে রাধাকৃষ্ণানের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে রাধাকৃষ্ণান ভারতে দর্শনের ছাত্র ও অধ্যাপক মণ্ডলীর পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের সুবিধার্থে বৎসরে অন্তত একবার মিলিত হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ১৯২৫ সালে “ভারতীয় দর্শন কংগ্রেস” (Indian Philosophical Congress) নামে বিখ্যাত সংস্থাটি গঠন করেন এবং ঐ সংস্থার কার্যকরী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। আর ঐ বছরেই ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের প্রথম সাধারণ সভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে অসম্মতি প্রকাশ করলেও শেষে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এই সূত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রাধাকৃষ্ণান কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করেন। ভারতের বিশিষ্ট দার্শনিক ড. সরোজকুমার দাসও তখন রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে ছিলেন ।


কবিগুরুর সঙ্গে রাধাকৃষ্ণানের কথোপকথোনের একটি বিশিষ্ট উল্লেখযোগ্য অংশ হল এই যে ড. রাধকৃষ্ণান রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন যে একাডেমিক বা শিক্ষায়তনের স্তরে সতত সৃজনশীল ভারতীয় দর্শন চিন্তার অগ্রগতি এক সময় হঠাৎ কেন স্তব্ধ হয়ে গেল, সে সম্বন্ধে কবিগুরু কিছু চিন্তা করেছেন কিনা। উত্তরে কবিগুরু বলেছিলেন- “অধ্যাপক মশাই ঠিকই ধরেছেন – এটা সত্যিই চিন্তার ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় আমাদের জাতির দার্শনিক প্রতিভার বিকাশ ধারা বাঁধাধরা রাস্তায় প্রকাশ না পেলেও কখনও গতিহারা হয়নি অথবা তাঁর জীবনী শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কবিগুরুর এই উত্তরে রাধাকৃষ্ণান বলেছিলেন “আপনার মতে দার্শনিক চিন্তার জীবন প্রবাহ বাঁধাধরা রাস্তায় না গিয়ে হঠাৎ বিভিন্ন খাতে আত্মপ্রকাশ করেছিল – এই তো?”

রবীন্দ্রনাথের উত্তর ছিল — ভারতের সৃজনশীল চিন্তাধারা উচ্চতর স্তরে তাঁর প্রকাশ ও অগ্রগতি রুদ্ধ করে দিয়ে একরূপ অপ্রকাশিত ভাবেই চোয়ানো জলের মতো জনতার মনোভূমিতে ঝরে পড়েছে এবং তাঁকে উর্বর করে নিয়ে নিজের কাজ করে চলেছে। জানিনা আপনি কবীর, দাদু এবং বাংলার মধ্যযুগের বাউল বা আদি ভবঘুরে কবিদের ভক্তিমূলক গীতিকবিতার মধ্যে দার্শনিক চিন্তাধারার ক্ষুদ্র অংশগুলি লক্ষ্য করেছেন কিনা। রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত চিন্তাধারাই রূপ নিয়েছিল ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের প্রথম সাধারণ সভার অধিবেশনে তাঁর সভাপতির ভাষণে। তাঁর এই ভাষণ টি “Philosophy of our people” ১৯২৬ সালে জানুয়ারি মাসে মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ মাসের বিশ্বভারতীর ত্রৈমাসিক পত্রিকাতেও সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হয়েছিল। ১৯২৬ সালে জুন মাসে লণ্ডনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের কংগ্রেসে এবং সেপ্টেম্বরে আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক দর্শন কংগ্রেসে’ যোগদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাধাকৃষ্ণানকেই প্রতিনিধি মনোনীত করেন। এই সূত্রেই তিনি প্রথমবার ইংল্যান্ড ও আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ পান। ১৯৩১ সালে ২৬ ডিসেম্বর কলকাতা টাউন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনা উৎসব পালিত হয়। সে সভায় সভাপতির আসন অলংকৃত করে রাধাকৃষ্ণান কবিগুরুকে অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। পরে ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণান দর্শনের অধ্যাপক পদে ছিলেন। এই সময় (১৯৩৮) অমিয়কুমার মজুমদার ছিলেন তাঁর ছাত্র। তিনি লিখেছেন “তিনি যেদিন প্রথম আমাদের ক্লাসে পড়াতে আসেন, সেদিনের কথা আজও বহুকালের ব্যবধানে আমার স্পষ্ট মনে আছে। পরনে শুভ্র রেশমের গলাবন্ধ লম্বা কোট আর ধুতি, মাথায় শুভ্র পাগড়ি, দুটি উজ্জ্বল সন্ধানী চোখ, অসামান্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মানুষটি সান্নিধ্যে এসে আমরা সকল ছাত্র-ছাত্রী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যখন তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন তখন আর এক বিস্ময় ! —পাঠদান শেষে তিনি যখন ক্লাস ছেড়ে চলে যেতেন, তখন আমাদের মনে একটি কথাই বারবার বাজত, শেষ হয়ে হইল না শেষ”।
১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইণ্ডিয়ান ফিলসফিকাল কংগ্রেসের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে মূল সভাপতি হিসাবে রাধাকৃষ্ণানের নাম নির্ধারণ করা হয়। সেই সময় তিনি মস্কোতে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা বিমানবন্দরে নামলে তাঁকে অভ্যর্থনা করে আনতে সভ্যরা গেলে তাঁদের তিনি প্রশ্ন করে জেনে ছিলেন সিনেট হাউসে সভা হবে। তাই তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, দর্শনশাস্ত্রের দুরূহতত্ত্ব শুনতে কত আর লোক আসবে? প্রকৃতপক্ষে শ্রোতৃমণ্ডলীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে সেনেট হাউসে স্থান সঙ্কুলান হয়নি। লাউডস্পীকার লাগিয়ে বহু লোকের শোনাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। বিদেশের বহু দার্শনিক এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন ইউইং, নরথ্রপ, কংগের, শিলপ, রেগামি চার্লস মূর প্রমুখ।

এক কথায় কলকাতা রাধাকৃষ্ণানের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিকার করে আছে। এই শহরেই বিশ্বকবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি রচনা করেন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, গড়ে তোলেন ভারতীয় দর্শন কংগ্রেস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি বিদেশে পাড়ি দেন। প্রতিভাধর রাধাকৃষ্ণানের কর্ম উপলক্ষে ভারতের যে কোনো শহরে বসবাস তাঁর জীবনে নতুন কিছু ঘটতে পারত। কিন্তু কলকাতায় তাঁর আগমন এবং বিশ্বকবির সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই।