শতবর্ষে বোস সংখ্যায়ন

বোস সংখ্যায়ন বা বোস স্ট্যাটিস্টিক্স এর উদ্ভাবক যে ভারতীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম জড়িয়ে আছে তিনি আদপে একজন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী, গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিদ্যা। কোলকাতায় জাত এই মহান মানুষটি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই শুধু ছিলেন না, সারা জীবন ধরে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাটিকেও তিনি পুষ্ট করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।” সংগীত-সাহিত্যে অবাধ বিচরণকারী, সুদক্ষ এসরাজ বাদক ঋজু এই বিজ্ঞান সাধকের বিজ্ঞানকথাতো কম বেশি আমরা সকলেই জানি।

বরণীয় এই বিজ্ঞানী হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জন্ম ১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি, উত্তর কলকাতার ঈশ্বর মিত্র লেনের পৈত্রিক বাড়িতে। বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু, মা আমোদিনী দেবী। পড়াশোনা হিন্দু স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন বিশেষ কিছু মানুষ যাদের মধ্যে বন্ধু মেঘনাথ সাহা, রসায়নে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী এবং বিশুদ্ধ গণিতে নিখিলরঞ্জন সেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন বিজ্ঞান-বিশ্বের দুই দিকপাল আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রাযকে। ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে এম.এস.সি. পাশ করেন এবং এর বছরখানেক পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে দুই তরুণ প্রতিভা সত্যেন বোস ও বন্ধু মেঘনাথ সাহা প্রথমে গণিত বিভাগে যোগদান করেন। কিন্তু বিভাগীয় প্রধান গনেশ প্রসাদের অসহযোগিতার কারণে তাঁরা দুজনে গণিত বিভাগ ছেড়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে চলে আসেন। ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালে তিনি ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষের কন্যা ঊষাবতী দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

বিদেশে লেখাপড়া করার একটা সুপ্ত ইচ্ছা সত্যেন বসু ছোটবেলা থেকেই পোষণ করতেন। ১৯১৭ সালে সায়েন্স কলেজে সদ্য শুরু হওয়া গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পঠন পাঠনের দায়িত্ব শৈলেন ঘোষ, যোগেশ মুখার্জি, জ্ঞান ঘোষ, মেঘনাদ সাহা সহ সত্যেন বসুদের ওপর ন্যস্ত হয়। ১৯১৭-১৯২০ সায়েন্স কলেজে থাকার এই সময়কালের মধ্যেই একে একে জ্ঞান ঘোষ ও যোগেশ মুখার্জি, তারকনাথ পালিত প্রদত্ত ‘পালিত স্কলারশিপ’ নিয়ে লন্ডনে চলে গেলেন উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। সত্যেন বসুর মধ্যেও অনেকদিনের লালিত ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠলো এবং সরাসরি স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছে এই কথা তুলতেই তিনি হেসে বলেন, “বিয়ে করেছো যে। ব্যাচেলার ছাত্র-গবেষকদের জন্যই পালিত স্কলারশিপ”। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্ববর্তী সময়ে তাঁর একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল বন্ধু মেঘনাথের সঙ্গে যৌথভাবে জার্মান থেকে ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’র মূল কিছু প্রবন্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সারা পৃথিবীতে এটিই প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। গ্রন্থাকারে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই লেখাগুলো প্রকাশ করে এবং বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।


কাজের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ অমর হয়ে আছেন, তা হয়েছিল ঢাকাতে থাকাকালীন। তাঁর খ্যাতির উৎস ও বিস্তার ভূমি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যেন্দ্রনাথ সারাজীবনে ২৪টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বর্তমান সময়কালের নিরিখে সংখ্যাটা নিতান্তই সামান্য মনে হলেও একটা জিনিস মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান গবেষণা সেই সময় আজকের দিনের মতো পুরোদস্তুর পেশা হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে গ্যাসের আণবিক তত্ত্বের উপর মেঘনাথ সাহার সাথে যৌথভাবে লেখা তাঁর জীবনের প্রথম প্রবন্ধ এবং অভিঘাতের দিক থেকে ১৯২৪ সালের প্রবন্ধ যেখানে নতুন সংখ্যায়ন ম্যাজিকের মত প্ল্যাঙ্ক সুত্রকে মিলিয়েছিল।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের প্রথম পর্বে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি। পরবর্তীতে গবেষণার ক্ষেত্র সামান্য বদলিয়ে চলে যান প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বে।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আলোকে কণা হিসেবে বিবেচনা করে। প্ল্যাঙ্ক সমীকরণের এই প্রথম অংশটিও আলোক কণা ধরেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু গোল বাধে সমীকরণের দ্বিতীয় অংশে যা তড়িৎগতিবিদ্যার উপর ভর করে দাড়িয়ে ছিল। প্ল্যাঙ্ক তাঁর সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করতে বলবিদ্যা থেকে সরে এসে পদার্থবিজ্ঞানে নতুন এক শাখার জন্ম দেন। সেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল সমীকরণ এর একটি অংশ তড়িৎগতিবিদ্যা মেনে চলবে, এটা মেনে নেওয়া ছিল অস্বস্তিকর-তবুও এড়ানোর পথ প্রায় অধরা। এই ত্রুটি সত্যেন বোস কে ভাবিয়ে তোলে এবং তাঁর গবেষণা সূত্র এনে দিল কাঙ্খিত সমাধান। তিনি লিখলেন “প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোর কোয়ান্টা তত্ত্ব” এবং চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন-এ। কিন্তু কিছু মৌলিক ধারণা নিয়ে রিভিউয়ারদের সন্দেহ থাকায় প্রবন্ধটি অমনোনীত হয়। থেমে না থেকে তিনি পেপারটি পাঠিয়ে দিলেন খোদ আইনস্টাইনের কাছে।

সত্যেন বোস আইনস্টাইনকে লিখলেন, “Respected Sir, I have ventured to send you the accompanying article for your persual and opinion” ১৯২৪ এর ৪ই জুন লেখা চিঠিতে পত্র লেখক লিখলেন, “আমি এই নিবন্ধে প্ল্যাঙ্কের সমীকরণটি বের করেছি ধ্রুপদী ইলেকট্রোডায়নামিকস ছাড়াই…”। তিনি আরও অনুরোধ করেন যদি এটি ছাপার যোগ্য মনে হয় তাহলে যেন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে বিজ্ঞান সাময়িকী সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক (Zeitschrift Für Physik)এ ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। চিঠির শেষদিকে লিখেছিলেন তাঁর (আইনস্টাইন) হয়তো মনে নেই কিন্তু কয়েক বছর আগে আইনস্টাইন কোলকাতার দুই ব্যক্তিকে তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত নিবন্ধগুলো অনুবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। পত্র লেখক তাদেরই একজন।

চিঠি পড়েই আইনস্টাইন ওই প্রবন্ধ নিয়ে বসে পড়লেন। তিনি দেখেন আলোর দ্বৈত চরিত্রের স্বরূপ বিষয়ে যে অস্বাচ্ছন্দ্যগুলো ছিল তা দূর হয়েছে এখানে। অবশেষে ১৯২৪ এর জুলাই মাসে সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ প্রকাশিত হলো ‘প্ল্যাঙ্কস ল’ অ্যান্ড দ্য হাইপোথিসিস অফ লাইট কোয়ান্টা’। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বাঁক বদলে বাঙালী বিজ্ঞানীর এ এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। বোস বিকিরণকে এমন এক গ্যাসের মত ভাবলেন যা ফোটন দ্বারা পূর্ণ। পারিসাংখ্যিক বলবিদ্যার সাহায্যে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা হল। প্রচলিত পারিসাংখ্যিক বলবিদ্যায় বোলৎজমানের চিন্তা অনুসারে প্রতিটি অণুর একটা নিজস্ব পরিচয় আছে, প্রত্যেক অণুকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পারা যায়। বিপরীত ক্রমে বোসের চিন্তায় আলোক কণারা সবাই এক ও অভিন্ন।

বোলৎজমানের চিন্তায় ‘বি’ অণুর জায়গায় ‘এ’ অণুকে বসালে সম্পূর্ণ নতুন বিন্যাস পাওয়া যাবে, যাকে আলাদাভাবে গণনা করতে হবে। বোসের চিন্তায় দুটি একই ধরনের কণা, স্থানান্তর করলে নূতন বিন্যাস পাওয়া যাবে না। এর ফল হল কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের ফর্মুলার নতুন প্রমাণ। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন বোস-এর পারিসাংখিক পদ্ধতি সাধারণ পরমাণুদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে।

১৯২৪ সালে তাই সত্যেন বোসের কাজ-এর উপর ভিত্তি করে জন্ম নিল নতুন এক সংখ্যায়ন, ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’ বা সংক্ষেপে ‘বোস সংখ্যায়ন’। এই ধারণা বস্তুকণার ওপর প্রয়োগে পাওয়া গেল বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট। বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এমন এক সংখ্যায়ন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পদার্থের পূর্ণ সংখ্যার স্পিন বিশিষ্ট মৌলিক কণাদের বন্টন ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ বিশ্ব জগতের যে কণাগুলোর ঘূর্ণন পূর্ণ সংখ্যা, বসুর নামানুসারে পল ডিরাক সেগুলোর নামকরণ করেন বোসন কণা। আলোর কণা ফোটন, গ্লুয়ন, হিগস বোসন, ডব্লিউ ও জেড বোসন কণা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানে ভগ্নসংখ্যার স্পিন বিশিষ্ট কণাগুলোর নাম দেওয়া হয় ফার্মিয়ন। কাজেই বস্তু জগতের একটি অংশের নামকরণ হয় আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নামে, যিনি বিজ্ঞান জগতে এস.এন.বোস. হিসাবে খ্যাত। নোবেল পুরস্কার না পেলেও এ কথা সত্য যে বিজ্ঞান-ইতিহাসে তাঁর নাম ও অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে কারণ ‘বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন’ (Bose-Einstein Condensation) সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০০১ সালে কলরাডো ইউনিভার্সিটির এরিক কর্নেল (Eric Cornell) ও কার্ল ওয়াইম্যান (Carl Wieman) এবং এম-আই-টি’র ভল্ফ্গ্যাং কেটেরি (Wolfgang Ketterie) নোবেল পান।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ক্ষেত্রে প্রফেসর বোসের বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানে এই পাথ-ব্রেকিং অবদান একদিকে যেমন পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে পুননির্মাণ করলো অন্যদিকে তেমনি অভিনব তত্ত্ব ও প্রযুক্তির বিকাশকে উৎসাহিত এবং ত্বরান্বিত করেছিল। বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (BEC) যে পদার্থের এক অনন্য অবস্থায় পূর্বাভাস দিল তা অথবা ইলেকট্রন জোড়ায় প্রয়োগ করা বোস-আইনস্টাইন ঘণীভবন এর নীতিগুলো আমাদের সুপারকন্ডাক্টিভিটি বোঝার যে ভিত্তি তৈরি করে, এমন একটি অবস্থা যা প্রতিরোধ ছাড়াই বৈদ্যুতিক প্রবাহকে প্রবাহিত করতে দেয় তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের করিডরে অনুরণিত হতে থাকে এবং উদ্ভাবনী গবেষণা ও তার অ্যাপ্লিকেশন কে প্রাণিত করলো। ১৯২৪ এর মার্চ-এপ্রিলে লেখা প্রথম গবেষণা পত্রের অব্যবহিত পরেই তিনি ‘Thermal Equilibrium in the Radiation Field in the Presence of Matter’ নামক অপর একটি পেপার লিখেছিলেন। আইনস্টাইনের কাছ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় পেপারটি প্রকাশনার সংবাদ শ্রী বসু পেয়েছিলেন ঐ বছরের ২রা জুলাই ও ৩রা নভেম্বর। প্রথম পেপারের সাথে আইনস্টাইন একটি মন্তব্যও জুড়ে দেন। সেটি ছিল “আমার মতে প্ল্যাঙ্কের সূত্রের নির্ণয় বোস যেভাবে করেছেন তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নির্ধারণ করা যায়। অন্যত্র আমি তা বিস্তারিত দেখাবো”।

১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ আইনস্টাইন দেখালেন শুধুমাত্র ফোটনই সত্যেন বোস প্রস্তাবিত পরিসংখ্যান মেনে চলে। ফোটনের নতুন এক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ফোটনের সংখ্যা সংরক্ষিত নয় এবং এর কোনো স্থির ভর (Rest Mass)নেই। আইনস্টাইন আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে আরও একটি সিদ্ধান্তে আসেন, যে কোনো গ্যাসের তাপমাত্রা সংকট তাপমাত্রার নিচে নিয়ে গেলে গ্যাসের পরমাণুগুলোর গতি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যায়। তখন তাদের মধ্যে কোন পারস্পরিক আকর্ষণ অনুভূত হয় না এবং এদের কোনো ফ্রী এনার্জিও থাকে না। অর্থাৎ তারা বোসন কণার মতো আচরণ করে ও মনে হয় পরমাণুগুলো ঘনীভূত হয়ে একত্রিত হয়ে গেছে। তখন গ্যাসের একটি অংশ ঘনীভূত হয়ে যায় এবং অন্য অংশ সম্পৃক্ত আদর্শ গ্যাস হিসাবে থেকে যায়। এই অবস্থার নাম দেয়া হয় বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা BEC। ১৯২৪ সালের পর আরও উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রফেসর বোস দুই বছরের শিক্ষা ছুটি নিয়ে ইউরোপ যাত্রা করেন। ফ্রান্সে মাদাম কুরির সাথে সাক্ষাৎ হয় ও তার ল্যাবরেটরীতে কাজের সুযোগ পান। দ্যা ব্রগলির ল্যাবেও গবেষণা করেছিলেন কিছুদিন। জার্মানিতে গিয়ে আইনস্টাইনের সাথে খোলামেলা আলোচনা হয় তাঁর এবং এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ১৯২৭ সালে দেশে ফিরে ১৯৪৫ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়কাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবাহিত করেন।

১৯৪৫ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘খয়রা অধ্যাপক’ হন। বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি, রাজ্যসভার সদস্য জাতীয় অধ্যাপক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি আসীন ছিলেন। ১৯৫৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। আজীবন বিজ্ঞান গবেষণা ও অধ্যাপনার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দেশিকোত্তম, কলকাতা, এলাহাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রী তার মধ্যে অন্যতম।বিজ্ঞানের পাশাপাশি সংগীত ও সাহিত্য প্রিয় এই মহান মানুষটি ১৯৭৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে গেলেন ৮০ বছরের কর্মজীবনের এক অমর কীর্তি। (১৯২৪-২০২৪) বোস সংখ্যায়নের শতবর্ষ পূর্তিতে স্মৃতির স্মরণী পথে আরও একবার ফিরে দেখা সেই দেশব্রতী বাঙালি বিজ্ঞান সাধককে যিনি বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি একদিকে যেমন অনুশীলন সমিতি সহ সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে গোপনে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন অন্যদিকে তেমনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রবাহটিকে নিপুনভাবে পুষ্ট করে গেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নামক সাময়িকী আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচিন্তার প্রসারের অভিমুখটি গড়ে দিয়েছিলেন এই বোসন বিজ্ঞানী।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বপরিচয় বইটি প্রফেসর সত্যেন বোসকে উৎসর্গ করে ভূমিকায় লিখলেন সেই কথাই যার নির্যাস টুকু প্রফেসর বোস নিজের মননবিশ্বে চিরকাল লালন করতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “…অবৈজ্ঞানিক মনকে বিজ্ঞানের যুক্তিনিষ্ঠতার পথে ধাবিত করানোর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা-কাঠামোর মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্বকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ যেমন বাড়ে তেমনি বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগও বেশি করে সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-কাঠামোর বাইরেও বিজ্ঞান শিক্ষার চর্চা চলতে পারে নানা উপায়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে লেখা রচনাদি পড়া। এজন্য চাই মনের স্বাভাবিক কৌতূহল এবং বিভিন্ন বিষয়ে জানার ইচ্ছে”।