আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু: বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিদ

ফাইল চিত্র

সত্যব্রত সিনহা

সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? এই বিষয়ে ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা এক শ্রোতা জরিপ এর আয়োজন করেছিল এবং ৩০ দিনের ওপর চলা জরিপে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কুড়িজনের জীবন কথা অবলম্বনে বিবিসি বাংলার ২০০৪ এর ২৬ শে মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিক বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজনের তালিকায় সপ্তম স্থানে ছিলেন এক বিজ্ঞানী যিনি দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার উপলব্ধিতে পরাধীন ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যে, – “…আঁধারের আবরণ ভাঙ্গনেই আলো। কোন্ আবরণে আমাদের জীবন আঁধারময় ও ব্যর্থ করিয়াছে? আলস্যে স্বার্থপরতায় এবং পরশ্রীকাতরতায়! ভাঙ্গিয়া দাও এসব অন্ধকারের আবরণ তাহা হইলেই তোমাদের অন্তর্নিহিত আলোকরশ্মি উচ্ছ্বসিত হইয়া দিকদিগন্ত উজ্জ্বল করিবে।” বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ তিনি – স্যার জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭)। জগদীশচন্দ্রের জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর, বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ময়মনসিংহে। বাবা ভগবান চন্দ্র দাস ও মা বামাসুন্দরী দেবী। ফরিদপুরের এক বাংলা স্কুলে তার ছাত্র জীবনের শুরু। কিন্তু ১৮৬৯ সালে পিতার বদলীর জন্য তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে স্থানান্তরিত হন। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র তিন মাসের মধ্যে এই ‘গাঁইয়া’ ছেলেটিকে হেয়ার স্কুল ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে চলে যেতে হয় এবং সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার শুরু। সেসময় জেভিয়ার্সের পদার্থ বিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক লাঁফো’র সংস্পর্শে আসেন ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮৭৭ সালে এফ.এ এবং ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে সাধারণ মানের বি.এ। এরপর লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়তে শুরু করলেন, কিন্তু দেশে থাকাকালীন তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন তা তখনও সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি। ফলতঃ ডাক্তারি পড়ার ধকল শরীর নিতে পারলো না– নষ্ট হলো একটি বছর। পরেরবছর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন তার বড় বোন স্বর্ণপ্রভার স্বামী আনন্দমোহন বসুর সাহায্যে।

১৮৮৪ সালে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে বি.এ ডিগ্রী এবং ওই একই বছরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডনে থাকার সময় অর্থনীতির প্রখ্যাত অধ্যাপক ও সাংসদ ফসেটের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। ফসেট তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপনকে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের অধ্যাপনার ব্যবস্থা করে দেওয়ার এক অনুরোধ পত্র দেন। শিক্ষা বিভাগের সচিব স্যার আলফ্রেড ক্রফটের কাছে লর্ড রিপনের সুপারিশ পৌঁছালে ভারতবিদ্বেষী ক্রফট অনিচ্ছাসত্ত্বেও জগদীশচন্দ্রকে ইম্পিরিয়াল এডুকেশন সার্ভিস এর পরিবর্তে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে বলেন। জগদীশচন্দ্র জানতেন ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে কোনও ভারতীয়কে নিয়োগ করা হয় না এবং প্রভিন্সিয়াল সার্ভিস এর বেতন ছিল ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের দুই তৃতীয়াংশ। স্বাভাবিক কারণেই এই অপমানের প্রতিবাদ স্বরুপ তিনি ঐ পদে যোগদানে অস্বীকৃত হন। এর অব্যবহিত পর লর্ড রিপনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ১৮৮৫ সালে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের অধীনে সহকারী অধ্যাপকরূপে প্রেসিডেন্সি কলেজে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত হন। শুরু হলো তাঁর কর্মজীবন। চাকরি পাওয়ার পর দেখা দেয় আর এক বৈষম্য। সমযোগ্যতা সম্পন্ন হলেও সমপদে সেসময় ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতন ছিল ইংরেজ অধ্যাপকদের বেতনের তিন ভাগের দুই ভাগের সমান। স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত তা ছিল সেই পরিমাণ বেতনেরও অর্ধেক। স্বাধীনচেতা জগদীশচন্দ্র বসু এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রতিবাদের এক অভিনব পদ্ধতি নিলেন তিনি, বেতন প্রত্যাখ্যান করেও অধ্যাপনার কাজ অব্যাহত রাখার আপোষহীন নীতি প্রমাণ করলো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবার মানুষ তিনি নন।


প্রতিবাদের মুখে দীর্ঘ তিন বছর পর কর্তৃপক্ষ অবশেষে হার মানতে বাধ্য হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবনে হেরে যাওয়াটাই সব নয়, লড়াইটা হলো আসল। এ মানসিকতার প্রতিফলন তাঁর জীবনভোর। এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সর্বতোভাবে তিনি পাশে পেয়েছিলেন স্ত্রী অবলা দাসকে যিনি লেডি অবলা বসু নামে সমধিক পরিচিত। নারী শিক্ষা ও নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে একদিকে যেমন তিনি সারাটা জীবন নিয়োজিত করেছিলেন অন্যদিকে তেমনই অল্পবয়সে বিধবা অথবা অবহেলিত নারীদের জন্য বিদ্যাসাগর বাণীভবন এবং দিদি সরলা রায়ের সাথে যৌথভাবে গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।১৯০৯ সালে ইতালির গুগ্লিয়েলসো মার্কোনি এবং জার্মানির কার্ল ফার্ডিনেন্ড ব্রোন যখন যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন- বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের বিষয়টি সারা বিশ্বের মানুষের নজরে এল। কিন্তু এই উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চার জনক জগদীশচন্দ্র বসু এর অনেক পূর্বেই বেতার তরঙ্গ সম্বন্ধীয় মৌলিক গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং ফলশ্রুতিতে ১৮৯৫ সালে কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ তৈরিতে সফল হন। আজকের দিনে মহাকাশ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, টেলিভিশন সম্প্রচার কিংবা বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে মাইক্রোওয়েভই ব্যবহৃত হয়। কমিউনিকেশন অর্থাৎ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ বিশেষ কার্যকরী। পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা- বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে Plant Perception সংক্রান্ত গবেষণা ও অর্জিত জ্ঞান নিয়ে তিনি হাজির হলেন বিশ্ববিজ্ঞানের আসরে।

১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস তাকে গ্যালিলিও ও নিউটনের সমগোত্রীয় বিজ্ঞানী রুপে উল্লেখ করেন। আলবার্ট আইনস্টাইন বললেন- “জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য প্রদান করেছেন, তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।” জগদীশচন্দ্রের কাজ করার পদ্ধতি ও তার আনুষঙ্গিক ঘটনার কথা জানলে বোঝা যায় এক-একটি কাজের নেপথ্যে কতটা শ্রম দিতে হয়েছে তাকে। অনন্ত ধৈর্য, অপরিসীম পরিশ্রম দিয়ে তিনি গেঁথেছেন জ্ঞানসাধনার পথটিকে। জার্মান বিজ্ঞানী হাইনরিস হার্জ যখন অদৃশ্য আলোক তরঙ্গ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটা তরঙ্গ তৈরি করলেন যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ০.৯৬মিটার। একটি শর্টওয়েভও করেছিলেন যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল ০.০৬৬মিটার। একই সময়ে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে ছোট্ট একটি ঘরে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই জগদীশচন্দ্র হয়ে উঠলেন পরাধীন ভারতের বিজ্ঞানের অন্যতম স্তম্ভ। প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকর্মী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ঘরে ০.০০২৫ থেকে ০.০০৫ মিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি করলেন। পাশের ঘরে তখন অপেক্ষমান ফাদার লাঁফো। ওই ঘর অতিক্রম করে পাশের পেডলারের ঘরে পৌঁছালো সেই তরঙ্গ। এর সাহায্যেই জগদীশচন্দ্র একবার গবেষণাগার থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাড়িতে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। বেতারে সংবাদ প্রেরণের সেই শুরু। জগদীশচন্দ্রের শর্টওয়েভ তথা মাইক্রোওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণা বিদেশের বিজ্ঞানীমহলে আলোড়ন ফেলে দেয়। ফলতঃ ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে D.Sc উপাধিতে ভূষিত করে এবং ওই বছরই ইউরোপে তিনি বিখ্যাত পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন ও ইলেকট্রনের আবিষ্কারক জোসেফ জন থমসন এর সাথে পরিচিত হন। পদার্থ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও পদ্ধতির প্রয়োগে জৈবিক ঘটনা অধ্যয়নের আন্তঃবিষয়ক বিজ্ঞান, বায়োফিজিক্স বা জীবপদার্থবিদ্যা বর্তমানে একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল গবেষণা ক্ষেত্র।

এতদিন পূর্বে জগদীশচন্দ্র বসু যখন পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের এই সম্মিলিত ক্ষেত্রে গবেষণা করছেন তখন জীবরসায়ন বা জীবপদার্থবিদ্যার মতো কোনও বিষয়ের অস্তিত্ত্বই ছিল না। বস্তুতপক্ষে তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম জীব পদার্থবিজ্ঞানী। জীব ও জড়ের মধ্যে সাড়ার যে ঐক্য অর্থাৎ বাইরের উদ্দীপনায় জীব ও জড় যে প্রায় একই রকমের সাড়া দেয় তার চিন্তা জগদীশচন্দ্রের পূর্ববর্তী সময়ে কেউ করেননি। ক্রমাগত উদ্দীপনা প্রয়োগের ফলে কোনও ধাতব পাত ক্লান্ত হয় এবং উত্তেজক রাসায়নিক প্রদানে সাড়া বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনাকে ১৯২৬ সালে The nervous mechanism in plant বইতে তিনি জীব এবং জড়ের একইরূপ ভৌতরাসায়নিক বিক্রিয়া রূপে বিবৃত করেন। বাংলা ভাষায় লেখা ‘অব্যক্ত-র’ একটি প্রবন্ধে তিনি লিখলেন,- “জীব যখন কোনো বাহিরের শক্তি দ্বারা আহত হয় তখন সে নানারূপে তাহার সাড়া দিয়া থাকে… বৃক্ষের আভ্যন্তরিক অবস্থা ধরা যাইতে পারিত, যদি বৃক্ষকে দিয়া তাহার সাড়াগুলি কোনো প্ররোচনায় লিপিবদ্ধ করিয়া লিখিয়া লইতে পারিতাম।” এর থেকে বোঝাই যাচ্ছে নির্বাক গাছের সাড়া একেবারে খাতায় কলমে ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন জগদীশ বসু। এছাড়াও প্রাণীর মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতির তারতম্যে গাছেদেরও যে সাড়া ও তার মাত্রা পাল্টে যায় তাও প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সমস্যা হল আঘাত অনুসারে গাছের উত্তেজনা, অবসাদ, সাড়া অথবা প্রতিক্রিয়া সবকিছু লিপিবদ্ধ করা যাবে এমন যন্ত্রপাতি কোথায়? একসময় ইউরোপের মত উন্নত দেশগুলো এজাতীয় যন্ত্র নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা খারিজ করে দিল। শেষ পর্যন্ত জগদীশ বসু কোলকাতায় বসে দেশীয় পদ্ধতি ও কারিগরদের সহায়তায় সহায়তায় নির্মাণ করলেন তরুলিপি যন্ত্র, সমতাল যন্ত্র, কুঞ্চনগ্রাফ, ক্রেস্কোগ্রাফের মত একের পর এক আধুনিক যন্ত্র। লজ্জাবতী ও বনচাঁড়াল গাছের ডালপালা কেটে কখনো অ্যাসিডে ডুবিয়ে কখনোবা গরম জলে সিক্ত করে গাছগুলোর অবসাদ ক্লান্তি এবং আহত অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার ঘটনা লিপিবদ্ধ করে চললেন।

গবেষণায় দেখা গেল উদ্ভিদের উত্তেজনার জন্য দায়ী উদ্ভিদ কোষের তড়িৎপ্রবাহ। পরবর্তীতে সালোকসংশ্লেষ, উদ্ভিদের স্নায়ুতন্ত্র, কোষে জলীয় দ্রবণের চলাচল, এসব নিয়েও তাঁর ক্লান্তিহীন গবেষণা এগিয়ে চললো গাছেদের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসায়। মূলতঃ একজন পদার্থবিদ হলেও গাছের প্রতি টান তাঁর আশৈশব। তার নিজের কথায়,- “গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়া মাত্র।” আবার তিনি লিখেছেন- “গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমাধান করতে হইলে গাছের নিকট যাইতে হইবে, বৃক্ষ লিখিত সাড়া দ্বারা তাঁর জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে।” নিরন্তর এই ইতিহাস খুঁজে চলা এবং খুঁজতে খুঁজতে যা পেয়েছেন তাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

১৯০২ সালে ‘Response in the Living and Non-Living’ বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জীব ও জড়ের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক সাড়া দেবার প্রবণতা গ্যালভানোমিটারের কাঁটার বিচ্যুতি ও লিপিগ্রাফের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন। জীবের সাড়া পরিমাপের জন্য প্রাণী টিস্যুর পরিবর্তে উদ্ভীদ টিস্যু ব্যবহার করেন এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি ছিল প্রাণী টিস্যু জটিল এবং খুব স্বল্প সময় জীবিত থাকে। ফলে দীর্ঘসময় ব্যাপী পরীক্ষার স্বার্থে উদ্ভিদ টিস্যু অধিক উপযোগী। তিনি একইভাবে দেখতে চেয়েছিলেন কোনো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের বিপরীতে উদ্ভিদ ও প্রাণী অনুরূপ সাড়া দেয় কিনা। তাঁর ভাষায়- “My own attempt, however, was directed, not towards the obtaining of a mere qualitative response, but rather to determination of weather throughout the whole range of response phenomena parallalism between animal and vegetable could be detected.” তিনি তার রেসনান্ট রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে প্রাণীদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন স্নায়ু কোষকে কৃত্রিম উপায়ে উত্তেজিত করলে যেমন সাড়া পাওয়া যায় তার সাথে বহুলাংশের সাদৃশ্য পাওয়া যায় একইভাবে উদ্দীপিত উদ্ভিদ টিস্যু থেকে প্রাপ্ত সাড়ার। উদ্ভিদের সাড়া সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনি আরও দুটি বই প্রকাশ করেন- প্রথমটি ১৯০৬ সালে Plant response: as a means of Physiological Investigations এবং দ্বিতীয়টি Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study. পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক আলো, তাপমাত্রা, মাধ্যাকর্ষণ এর প্রভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের সঞ্চালন নিয়ে গবেষণা লব্ধ ফলাফল বর্ণনা করেন তাঁর ‘Life Movements in Plants’ বইতে। এই বইতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্ভিদের উপর দৃশ্যমান আলোর অনুরূপ প্রভাব রয়েছে বেতার তরঙ্গের। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গবেষণার একটি প্রিয় বিষয় ছিল উদ্ভিদের রসাকর্ষণ বা ascent of sap। আকাশছোঁয়া উদ্ভিদে কোন্ প্রক্রিয়ায় এবং কিভাবে রস উত্তোলন ঘটে তা ছিল এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার যা বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদের রসাকর্ষণ ব্যাখ্যা করেন যে মতবাদ দ্বারা তা Pulsation Theory of Ascent Sap নামে পরিচিত। এবং এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন ১৯২৩ সালে প্রকাশিত The Physiology of Ascent of Sap বইতে।

এই মত অনুযায়ী, কান্ডের কর্টেক্স টিস্যুর সর্বনিম্ন স্তরের কোষগুলোর স্পন্দনের ফলে রস-উত্তোলন ঘটে। কর্টেক্সের স্তরের কোষের স্পন্দন তিনি বৈদ্যুতিক প্রবাহ, সুঁই ও গ্যালভানোমিটার যন্ত্রের দ্বারা দেখিয়ে দিলেন। সুঁইটি কর্টেক্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করালে গ্যালভানোমিটারের কাঁটার বিক্ষেপ প্রমাণ করে স্পন্দনের উপস্থিতি। তাঁর মতে এই স্পন্দনের ফলেই জাইলেম এর মধ্য দিয়ে রস উত্তোলিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি শ্যাল, মাকডুগাল, বেনেডিক্ট’রা দেখান স্পন্দনের সাথে রসাকর্ষণের কোনো সম্পর্ক নাই।