শ্রী রাফায়েল নাদাল
সমীপেষু,
সংখ্যা আর সৌন্দর্য এই দুইয়ের বিচারে কোনদিন আপনার কপালে এক নম্বরের শিরোপা আসবে না। কিন্তু আধুনিক টেনিসের ইতিহাসে আপনিই সর্বকালের সেরা কিনা এই বিতর্ক ও থেকে যাবে, ফেডারারের মতো স্কিলফুল, নোভাকে র মতো প্রফেশনাল আপনার টেনিস নয়, তবুও আপনার শরীর এবং চোট যদি না বারবার ক্যারিয়ারে ব্যাঘাত ঘটতো হয়তো সংখ্যার বিচারে আপনি রাফায়েল নাদাল সর্বশ্রেষ্ঠ হতেন। ডেভিস কাপ ম্যাচে পরাজিত হয়েছে যে টেনিস ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল, আজ আবার ডেভিস কাপে পরাজয়ের সাথে সাথে আপনার সেই ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটলো। এরই মাঝে আপনার বর্ণময় ক্যারিয়ারে থেকে গেলো বাইশ টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম সহ, চৌদ্দ বার বিজয়ী হয়ে ক্লে কোর্টের চিরকালীন সম্রাটের শিরোপা।
আপনার ওই হাসি, পেশি বহুল চেহারা আর বারবার সবাইকে ধন্যবাদ জানানো প্রভাবিত করেছে সারা বিশ্বকে। আপনার জন্যই একটা সাধারণ ডেভিস কাপের ম্যাচেও, ১০ হাজার দর্শক উপস্থিত হয়েছে আপনাকে বিদায় জানাতে। আবেগঘন বক্তৃতায় আপনি যখন ভালো মানুষ হিসেবে আপনাকে মনে রাখার কথা বলছেন তখন হাততালিতে ফেটে পড়ছে গোটা স্টেডিয়াম। দাঁড়িয়ে থেকে দর্শকেরা অভিবাদন করছে যা দেখেছিলাম যখন আপনি শেষবারের মতন যখন আপনার রাজত্বে অলিম্পিক খেলছিলেন। সিঙ্গেলসে চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী নোভাকের সাথে যখন ৬০ তম ম্যাচ খেলার সময় শরীর দৃশ্যতই টানতে পারছিলো না। তবু আপনার প্রত্যেক পয়েন্টের পরে গোটা স্টেডিয়ামের একপেশে চিৎকারের সাথে তুলনীয় ঘটনা মনে হচ্ছিল একমাত্র সৌরভ গাঙ্গুলিকে বাদ দিয়ে রাহুলের নেতৃত্বে ইডেনে ভারতীয় দলের ক্রিকেট ম্যাচ। পরবর্তীতে শোনা যায় ভারতীয় দল কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে বলেছিল মনে হলো বিদেশ থেকে ফিরে এলাম। বারবার মনে হচ্ছিল মিরাক্যাল ঘটুক। কিন্তু কম্পিটিটিভ স্পোর্টস এ আবেগের কোন জায়গা নেই, যেখানে হয়তো একটু ম্যানেজ করা যেত সেই ডাবলসেও দেখলাম শরীর সাথ দিল না, তবে স্পেনের টেনিসের আপনার উত্তরাধিকারীর দায়িত্ব আপনি আলকারেজকে সফলভাবে দিয়ে দিলেন। প্যারিসের লাল মাটির মাঠেই শেষ হয়ে গেছিল আপনার পেশাদার সার্কিটে ফিরে আসার সমস্ত সম্ভাবনা।
বরাবরের বিনয়ী আপনি, আজকেও খেলার শেষে বললেন আমি যা স্বপ্ন দেখেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি। কাকা টোনি নাদালের তত্ত্বাবধানে টেনিস খেলা শুরু করে তিন বছরের এক ছটফটে স্প্যানিয়ার্ড তার স্কিল আর শিশুসুলভ হাসিতে যে একদিন বিশ্বজয় করবেন, টেনিস দুনিয়াকে শাসন করবেন তা পন্ডিতেরা ভাবতেও পারেননি তখন ও যখন আপনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে উইম্বলডনের তৃতীয় রাউন্ডে পৌঁছেছিলেন। ডাবলস হলেও শুরুতেই ২০০৪ এ ভারতীয়রা দেখেছিল আপনাকে চ্যাম্পিয়নশীপের মুকুট পরতে চেন্নাই ওপেনে। ওই ২০০৪ এই আপনি অ্যান্ডি রডিককে ডেভিস কাপ ফাইনালে পরাজিত করে, টেনিস জগতে আপনার আগমন বার্তা ঘোষণা করেন। ২০০৫ সালের মিয়ামি ওপেনে ৫ সেটের লড়াইয়ে রজার ফেডারারের পরাজয়, বিশ্ব টেনিসের সর্বোচ্চ লড়াইয়ের ঘোষনা করে যা আগামী দশ বছরের বেশি সময় ধরে খেলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লড়াই হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে।
রোঁলা গারোর সাথে আপনার রোমান্সের শুরু ২০০৫ সালে। পায়ের চোট ও আপনাকে ঢুকাতে শুরু করবে এই সময় থেকেই, গ্র্যান্ড স্লাম থেকে নাম তুলে নিতে হবে আপনাকে। যখন রজার ফেডেরার মধ্যে গগনে, টেনিস বিশ্বের অবিসংবাদিত সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় কে সেমিফাইনালে হারিয়ে আপনি প্যারিসের যে রাজত্বের শিকড় গেড়েছিলেন, তা ২০২২ সাল পর্যন্ত বারংবার চোট আঘাত ছাড়া অক্ষুন্ন থেকেছে। রয়্যাল ব্লাড কিংবা অন্য বিশেষ কারণের জন্য আমরা আজও মনে করি উইম্বলডন টেনিস বিশ্বের সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ টুর্নামেন্ট। সেই ব্রিটিশ আভিজাত্যে রাজত্ব ছিল রজার ফেডারারের একতরফা, আর মাটির কোর্টের রাজা আপনার কাছে ঘাসের কোর্টে জেতার চ্যালেঞ্জটা ছিল পেশাদার জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম। ২০০৮ সালের সেই লড়াই যা টেনিসের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যাচ গুলোর মধ্যে একটা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে আপনাকে বসিয়ে দেবে অমরত্বের গদীতে। আপনার টেনিসে আমরা রোমান্টিসিজমের জায়গায় দেখতে পাবো জেদ এবং দৃঢ়তা। আপনার এবং ফেডারারের লড়াই গুলি টেনিস বিশ্বে সর্বকালের সেরা লড়াইয়ের শিরোপা পেতে থাকবে পরবর্তীতে আপনাদের সাথে এসে পড়বেন নোভাক জোকোভিচ। কিন্তু এই সাম্রাজ্যে সংখ্যার ভিতর এসে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও কখনোই রোমান্টিসিজম এবং সমর্থকদের আবেগের শিরোপা তার মাথায় আসবে না। তা ভাগ্যলক্ষ্মী বরাদ্দ রেখেছে আপনাদের দুজনের জন্যই।
প্রফেশনাল টেনিসে চূড়ান্ত সফলতার সাথে সাথেও আপনি দেশের হয়ে ডেভিড কাপে সফল। অলিম্পিকের সোনা আপনি পেয়েছেন, দেশকে বিশ্বের মঞ্চে বারবার গৌরবান্বিত করেছেন। চোট আঘাত আপনার ক্যারিয়ারকে বারবার বাধা দিয়েছে এবং আপনি শেষ পর্যন্ত আর রিকভারি করতে পারেননি। আজকে আপনার প্রফেশনাল টেনিসের জার্নি শেষ হলেও কালের ইতিহাসে আপনার অ্যাচিভমেন্ট, আপনার টেম্পারমেন্ট, আপনার মানসিকতা এবং আপনার বিনয় আগামী দিনের টেনিস খেলা কে ভালোবেসে বড় হতে থাকা প্রত্যেক শিশুর কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আর আমরা মনে রাখব “মার্লোকার” গ্রাম থেকে উঠে আসা স্প্যানিশ আর্মাডার সত্যিকারের সেনাপতি রাফায়েল নাদালের কোর্টের মধ্যে যুদ্ধ নাদ । ভালো থাকবেন আপনি, আপনার মতন বড় মনের মানুষের দরকার এই সংকীর্ণ পৃথিবীতে।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার গুণমুগ্ধ
তন্ময় সিংহ।