কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসকরাও আজ অরক্ষিত

কলকাতার আরজিকর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে উঠে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। জানা গিয়েছে, খুন করে ধর্ষণ করা হয়েছে ওই তরুণীকে। এমনটাই ইঙ্গিত মিলেছে রিপোর্টে। শরীরের মোট দশ জায়গায় ক্ষত পাওয়া গিয়েছে। যৌনাঙ্গেও রক্ত পাওয়া গিয়েছে বলে খবর সূত্রের। মৃতের পরিবারের তরফেও ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ তোলা হয়। প্রাথমিকভাবে পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে সুইসাইড কেস হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেও নানা মহলের চাপে তদন্ত শুরু করে। সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনায় উত্তাল কলকাতাসহ গোটা রাজ্য। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এসেছে। বিশেষ করে রাতে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সঞ্জয় পাল সমাজ মাধ্যমে যথার্থই লিখেছেন, “একটা সরকারি হাসপাতালে একজন মহিলা চিকিৎসক সুরক্ষিত নয়। ব্যাপারটা ভয়াবহ। এরপর আর কোনও মহিলা চিকিৎসক রাতে ডিউটি করতে ভয় পাবেন। ফলত প্রয়োজনের তুলনায় রাতের চিকিৎসক আরও কমে যাবে। চিকিৎসা পরিষেবার মান আরও খারাপ হবে। তাছাড়া মেয়েরা রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে এখন থেকে অসুরক্ষিত বোধ করবে। আর কতো ভাবে সরকার আমাদের ‘গর্বিত’ করে যাবে আর তার প্রতিদান স্বরূপ একের পর এক নির্বাচনী বৈতরণী এদের উতরে দেবো, কে জানে। গণদাবী উঠুক জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একই পদে ( সম বা নীচের স্তরের কোনও পদে) কেউ দুটো টার্মের বেশি থাকতে পারবে না। অভ্যুত্থান প্রয়োজন নেই। আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার।”

এ দেশে টিভির পর্দায় আর খবরের কাগজে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বা ‘কন্যাশ্রী’-র বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে যায় নারী নির্যাতনের নানাবর্ণ খবর। ধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এলে রাস্তার মঞ্চ থেকে বিধানসভা বা সংসদে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে গলার শিরা ফুলিয়ে টেবিল চাপড়ে হইচই করেন রাজনীতির কারবারিরা। গণমাধ্যম সরব হয়। আমজনতা সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে দেয়। প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ কয়েক দিন লম্ফঝম্প করে। তার পর সব থিতিয়ে যায়। মিছিলে মোমবাতির আলো নেভে। কামদুনি, দিল্লি, উন্নাও, তেলঙ্গানা, কুমারগঞ্জ, আরজিকর— ধর্ষিতের মিছিল ক্রমশ দীর্ঘতর হয়।


প্রায় প্রতিদিন দেশের আনাচাকানাচে আখছার ধর্ষণ হয়ে চলেছে। গত বছরের প্রথম ছ’মাসে এ দেশে ২৪ হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তবে সম্ভবত শুধু পরিসংখ্যান দিয়েও বীভৎসতার গভীরতা বিচার করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এই সমাজ ক্ষমতাধরদের দুর্বলকে নিপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে বলেই অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, ধর্মীয় রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অথবা/ এবং পারিবারিক জটিলতা, সেই সঙ্গে এবং সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও গ্রেফতারের সংখ্যা নগণ্য। অনেক সময়ে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ধর্ষকেরা আবার আরও বেশি উৎসাহে একই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অপরাধ করেও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিসম্পন্নেরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছে।

আবার যারা অপরাধ করেছে, তারাই উল্টে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে উল্টে ধর্ষিতার চরিত্র ও পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমতাবস্থায় আইন ও বিচার ব্যবস্থার জটিল আবর্তে বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ যখন সন্দেহভাজনের বেআইনি ‘এনকাউন্টার’ হত্যায় হাততালি দেয়, অবাক হওয়া যায় না। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সমাজ বা রাষ্ট্র মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক মাপকাঠিতে ছেলেমেয়ে তুল্যমূল্য শুধু সরকারি প্রচারেই, বাস্তবে তার প্রতিফলন কার্যত নেই।

বরং ‘নির্মল বাংলা’ বা ‘স্বচ্ছ ভারত’-এ ঘরে-বাইরে লিঙ্গ বৈষম্যের কুৎসিত চেহারাটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। মেয়েদের উপরে আক্রমণটা অবশ্য শুরু হয় জন্মের আগে থেকেই। গর্ভাবস্থাতেই কন্যাভ্রুণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গর্ভপাতের কাঁচি এড়িয়ে কন্যাসন্তান যদিও বা ভূমিষ্ঠ হয়, তার পরেও চলে মুখে নুন চাপা দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা। সেই বিপদও যদি তার কাটে, সেই মেয়ে যদি হাতে-পায়ে বেড়ে উঠতে থাকে, শুরু হয় শ্বাপদের চোখের নজরদারি। অজানা ধর্ষকের হিংস্র চোখ তাকে রাত-দিন মাপতে থাকে। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময়ে আশঙ্কিত, সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন তার বাবা-মা।

আজব দেশে শিশু ধর্ষণের মতো গজব ঘটনা রোধে তেলঙ্গানার চিরকুর বালাজি মন্দিরে যখন গরু পুজো হয়, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’য় সভ্যতার নিক্তিতে আদৌ কি আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করতে পারি? একজন ধর্ষককে আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। দিল্লিতে নির্ভয়ার চার ধর্ষককে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ধর্ষণ রোখা যাচ্ছে কি? ধর্ষণ একটি অসুস্থ ও চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে অস্থিরতা, রাজনীতিতে হিংসার বহিঃপ্রকাশ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ যখন তৈরি হয়, তখন এ ধরনের অবক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে। আমাদের মধ্যে বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে, এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। এ পরিস্থিতিতে ধর্ষণ সহ নানা অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যায়। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাশক্তি, শিশু কিশোরদের আচরণগত সমস্যাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। দৈনন্দিন ব্যস্ততার অজুহাতে শিশু ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত ঘটনাও আমজনতার গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার প্লাটিনাম জয়ন্তী অতিক্রম করলেও আমরা মহিলাদের সামাজিক নিরাপত্তা একেবারেই নিশ্চিত করতে পারিনি। যতই সরকার প্রচার করুক না ছেলে হোক বা মেয়ে হোক –উভয়ই সমান, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাম্যের তুলাদণ্ডে ছেলেদের পাল্লা এখনও অনেক ভারী। সাম্যের আকাশে পৌঁছাতে মেয়েদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। নারী, পুরুষ বা শিশু নির্বিশেষে ক্ষমতা ও অবস্থানে বৈষম্যের যে মানসিকতা, সেটা দূর না হলে যৌন নির্যাতনের শিকার উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না। স্বছ ভারত অভিযানের দৌড়ে লিঙ্গ বৈষম্যের অস্বচ্ছতা সব আগে দূর করতে হবে।

ধর্ষণ প্রতিরোধে পুরুষদেরও সোচ্চার হতে হবে। কেবল নারীদের চিৎকারে এই মারণ সামাজিক রোগ নিরাময় হবে না। Charity begins at home— বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যকে মান্যতা দিয়ে বাড়িতে বাচ্চাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শেখানো ভীষণ জরুরি। স্কুল পর্যায়ে বালিকাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্কুল পাঠক্রমে জীবনশৈলী পাঠ অন্তর্ভুক্ত নিয়ে আর টালবাহানা করা উচিত নয়। যৌনশিক্ষা একজন পড়ুয়াকে উপযুক্ত সংবেদনশীল দায়িত্ববান নাগরিক তৈরি করতে সাহায্য করে— এ’কথা আমরা আর কবে বুঝবো ?

সংখ্যা দিয়ে সভ্যতার অনেক সূচকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যতক্ষণ সামাজিক এ ধরনের রোগের নিরাময় সম্ভব হচ্ছে না, ততক্ষণ আমরা নিজেদের সভ্য দাবি করতে পারি না। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করে এবং জনগণকে সচেতন করে তুলে এ পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকে খোলা মনে এগিয়ে আসতে হবে। কে বলতে পারে তার আদরের শিশুটি আগামীকাল পৈশাচিক লালসার শিকার হবে না! শুধু আইন করে আর কড়া শাস্তির চোখরাঙানিতে এই যুগ-যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক শয়তানির অবসান হবে, এমন আশা করা দুষ্কর। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ঝেড়ে ফেলে দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনই দরকার ছোট থেকেই নারীর মর্যাদা সম্পর্কে আপামর পুরুষদের সচেতন করা। দুর্ভাগ্যের কথা, এখনও স্কুলের পাঠক্রমে জীবনশৈলী অচ্ছ্যুৎ। ছেলে হোক বা মেয়ে, সুস্থ সংবেদনশীল নাগরিক তৈরি করতে বাড়ি, স্কুল তথা সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শেখাতে হবে। বোঝাতে হবে, বিপদটা শুধু মেয়েদের নয়। লিঙ্গ নির্বিশেষে গোটা দেশের। গোটা সমাজের। তাদের মা-বোনদেরও।