বরুণ দাস
তিলোত্তমা-কাণ্ডে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এক সাক্ষাৎকারে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তী বলেছিলেন, আন্দোলনের স্বার্থে রোজ রোজ বের হচ্ছি, রাত্রে যখন বাড়ি ফিরি, তখন বাড়ির লোক তো বটেই, পরিচিতজনেরাও জিজ্ঞেস করেন, কিরে সমস্যার সমাধান কতদূর হলো? কিন্তু এর কোনও সঠিক জবাব দিতে পারি না। এরপরই আবেগে কেঁদে ফেলে তিনি বলেছিলেন, কারণ উত্তরটা তো আামারও ঠিক জানা নেই. আামি নিজেও বেশ হতাশ বলতে পারেন।
এটা শুধু জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তীরই জিজ্ঞাসা নয়, আান্দোলনের সঙ্গে কমবেশি যুক্ত অনেকেরই জিজ্ঞাসা কিংবা মনের কথাও। ইতিমধ্যে প্রায় একশোদিন অতিক্রান্ত। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনার শেষে জুনিয়র চিকিৎসকরাও তুলে নিয়েছেন তাঁদের অনশন-পর্ব। আন্দোলনকারীদের দাবিমতো সরকারি তরফে কিছু কিছু ‘ব্যবস্থাও’ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। যদিও তা আশানুরূপ নয় বলে দাবি আন্দোলনকারীদের। তাই আন্দোলন ‘জারি’ রেখেছেন তাঁরা।
‘পরীক্ষার জন্য’ তা ঢিমেতালে চললেও ‘রাজপথ ছাড়েননি’ আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ ট্যুইটরে আন্দোলনের স্বপক্ষে চলছে নিস্তেজ প্রচারপর্বও। কিছু মানুষ সরে গেলেও কিছু মানুষ তো এখনও আছেন এই গণ-আন্দোলনের সঙ্গে। বিশেষ করে সমাজমাধ্যম তথা ভার্চুয়াল মাধ্যমে। গত ৯ নভেম্বর কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলাগামী পদযাত্রায় জুনিয়র চিকিৎসকদের তেমন ভিড় না হলেও সাধারণ মানুষ তো ছিলেন। ছিলেন নানা সংগঠনের কর্মকর্তারাও।
যারা তিলোত্তমার খুনি ও ধর্ষকদের ‘দ্রুত বিচার চাই’ বলে সরব, তাঁদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ারও তো একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আচে। তদন্ত শেষে সেই পদ্ধতি মেনে বিচার পেতে অনেকটা সময়ই লেগে যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে। যেখানে ৫ কোটির ওপর মামলা জমে আছে গোটা দেশের বিভিন্ন আদালতে। এবং আমাদের সরকার বাহাদুর (কেন্দ্র এবং রাজ্য) ওই সমস্যার সমাধানে কিন্তু মোটেও আগ্রহী নন।
একমাত্র ফাস্ট ট্রাক-এ বিচার-পর্ব হলে দ্রুত বিচার-পর্ব সেরে ফেলা যায়। তা না হলে ৩ থেকে ৩৩ বছরও লেগে যেতে পারে বিচার পেতে। কোনও ক্ষেত্রে তারও বেশি। দিল্লির শিখ নিধন-পর্ব থেকে রেজানুর-কাণ্ড, কামদুনি থেকে পার্ক স্ট্রি কাণ্ড, বগটুই থেকে হাঁসখালি-কাণ্ড, সারদা-নারদা থেকে আনিশ হত্যাকাণ্ড তো আছেই। এছাড়া নিয়োগ দুর্নীতি থেকে গরুপাচার কাণ্ড এখনও ঝুলে আছে। তাই তিলোত্তমা কাণ্ডের বিচার কবে পাওয়া যাবে তা এখনই হলফ করে বলা খুব একটা সহজ নয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মহামান্য কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের নির্দেশে রাজ্য পুলিশের হাত থেকে সিবিআই-এর হাতে তিলোত্তমা-কাণ্ডের তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে মহামান্য শীর্ষ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলার শুনানি শুরু করেছিলেন। পরে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে (পড়ুন জটিলতায়) তাঁরা নিম্ন আদালতের হাতেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তুলে দেন। অর্থাৎ শীর্ষ আদালতের অভিমত ছিল, প্রয়োজনে তাঁরা (নিম্ন আদালত) দ্বিতীয়বার তদন্তের নির্দেশও দিতে পারেন।
জটিলতা বলতে তিলোত্তমা-কাণ্ডে খুন ও ধর্ষণের পাশাপাশি এই মামলার সঙ্গে দুর্নীতিও যোগ হয়ে যাওয়ায় অপর কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (অর্থনীতি অপরাধ সংক্রান্ত) ইডি-ও যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে সমান্তরালভাবে তদন্ত চলতে থাকে। এবং প্রতিদিনই এই সংক্রান্ত একটা-না-একটা রহস্য উন্মোচন হতে থাকে। সিবিআই এবং ইডি’র তদন্তের পরিসরও ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। এখনও চা চলছে। এবং কবে নাগাদ এই তদন্তের কাজ গুটিয়ে আনা যাবে, তা তাঁরা হয়তো নিজেরাও জানেন না। মাননীয় বিচারকরাও বিরক্ত।
তিলোত্তমা-কাণ্ডে আলোড়িত দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। কিন্তু দেশের ’আইনি পথ’ পেরিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনো অনেকটা ‘সময়ের ব্যাপার’, যেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এ লেখায়। আর আইনের এই পাকদণ্ডী পথের সুযোগেই প্রকৃত অপরাধীরা বিচার থেকে দূরে থাকতে পারে. অনেক ঘটনায়ই এটা দেখা গেছে। কেউ কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। কেউ কেউ জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম মেনে চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেন।
কেউ কেউ আবার ‘গণতান্ত্রিক পথে’ সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ কিংবা রাজ্যের আইনসভার (লোকসভা কিংবা বিধানসভা) সম্মানীয় সদস্য হয়েও যায়! অনেকেই জানেন, সারদা-নারদার ক্ষেত্রে যা হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিখ্যাত বিদেশি ব্যক্তিত্বের বহুশ্রুত পঙক্তিই আবার আমাদের উচ্চারণ করতে হয়, ‘সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ!’ এই ‘বৈচিত্র্য’ নিয়েই আজকের ভারতবর্ষ। আলেকজান্ডার বেঁচে থাকলে এর সঙ্গে হয়তো আরও কিছু মোক্ষম শব্দবন্ধ যোগ করতেন নিশ্চিত।
সময়ের পথ বেয়েই আজকের জুনিয়র চিকিৎসকরা আগামীদিনে সিনিয়র হয়ে যাবেন। তারপর পেশাগত কারণেই তাঁরা কেউ সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ঢুকে পড়বেন। ওষুধ কোম্পানির দেওয়া লোভনীয় টোপে তাঁরা অনেকেই হয়তো-বা দামি গাড়ি-বাড়ি সহ বিদেশ ভ্রমণের দিকে ঝুঁকবেন। ফেলে আসা যৌবনের লড়াকু বা সংগ্রামী মানসিকতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে। আপসের পথে হাঁটাটাই তখন তাঁদের অনেক হয়তো-বা ‘টিকে থাকা’র একমাত্র পথ হিসেবে মেনে নেবেন।
হয়তো-বা সন্দীপ-অভীক-বিরুপাক্ষ অ্যান্ড কোম্পানির এক-একটি ক্লোন হয়ে উঠবেন। আসলে এই দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যবস্থাপনায় হাতে-গোনা দু-চারজন ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে থাকেন। তাঁরা সংখ্যায় এত কম যে হিসেবের মধ্যেই আসেন না। যদিও তাঁরা তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নন। মানুষের জন্য তাঁরা কাজ করে যান আমৃত্যু। আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না তাঁদের গৌরবময় কথা ও কাহিনি। মিডিয়ার কলম ফসকে যদি কখনও বের হয় তো আমরা জানতে পারি তাঁদের অনন্য অবদানের কথা।
অন্যদিকে অভয়া-তিলোত্তমারা হারিয়ে যাবেন সময়ের সচল স্রোতে। আমাদের দুর্নিবার লোভ-লালসার কাছ। আমাদের আপসকামী মানসিকতার কাছে। আমাদের ‘মেনে নেওয়া’ আর ‘মানিয়ে নেওয়া’ মানসিকতার কাছে। যেমন হারিয়ে গেছেন এঁদের মতো আরও অনেকেই। সেলুট জানাই জুনিয়র চিকিৎসক ডা. তাপস প্রামাণিককে। আরজিকর কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনি অনেক রাঘব-বোয়ালদের ন্যক্কারজনক কথাই অকপটে ব্যক্ত করেছেন অন-ক্যামেরায়। নিজের প্রাণনাশের সমূহ সম্ভাবনা সত্ত্বেও।
আরজিকর কাণ্ডের ঘটনায় একটা বেয়াড়া প্রশ্ন কেবলই মনের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি মারে। কিছুতেই মন থেকে মুছে দিতে (আজকের কথায় যাকে বলে ‘ডিলিট’) পারি না। কী সেই বেয়াড়া প্রশ্ন? আচ্ছা, ধর্ষণ ও খুন হওয়আ পড়ুয়া-চিকিৎসক তিলোত্তমা হাসপাতালের অভিযুক্ত (বর্তমানে জেলবন্দি) সুপার সন্দীপ ঘোষ অ্যান্ড কোং-এর এতসব দুর্নীতি ও অপকর্মের ঘটনা কি একাই জানতেন? তিলোত্তমার সহপাঠীরা কেউ এর কিছুই জানতেন না? এটা কী করে সম্ভব? আমাদের সাধারণ বোধ-বুদ্ধি কী বলে?
আর যদি জানতেন তো এতদিন তাঁরা চুপ করে ছিলেন কেন? কেন মুখ খোলেননি। কেন তাঁরা এসব প্রকাশ্যে আনেননি? কেন প্রাণ দিতে হল এমাত্র পড়ুয়া-চিকিৎসক তিলোত্তমাকেই? তিনি কেন একাই ‘বলির পাঁঠা’ হলেন? অভিযুক্ত সিভিক পুলিশ (ভলান্টিয়ার) সঞ্জয় রায়ের একার পক্ষে যেমন ওই নারকী? ঘটনা ঘটানোর সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই তিলোত্তমার সহপাঠীরা কেউ কিছু জানতেন না, শুধু তলোত্তমা একাই সবকিছু জানতেন— এটাও যেন স্বাভাবিক বুদ্ধিতে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়।
কলকাতা মহানগরের অন্যতম সরকারি হাসপাতালের পড়ুয়া-চিকিৎসক তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুন হওয়ার পরেই মাঠ নেমে পড়লেন তাঁর আরজিকরী জুনিয়র সহপাঠীরা। তার আগে নয়। কেন? তাঁরা আগে দুনী:তি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদে মাঠে নামলে তিলোত্তমাকে বোধহ? এভাবে প্রাণ দিতে হতো না নিশ্চিত। আরজিকর-এ দুর্নীতি ও অন্যায়ের ঘটনা তো নতুন কোনও আখ্যান নয়। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে হাসপাতালের ডেপুটি সুপার আখতার আলি লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
তাঁকে চূড়ান্ত হেনস্থা তো বটেই, রাতারাতি অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় টালা থানায় ওই অভিযোগ এতদিন চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। স্বাস্থ্যভবনও ডেপুটি সুপার আখতার আলির অভিযোগ পেয়েও তখন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এখন যা সামনে এসেছে। এই পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় কলামে এ নিয়ে বর্তমান কলামলেখক উত্তর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনও লিখেছিলেন। তখন কেউ টু-শব্দটি করেননি কেন? এই রাজনৈতিক বা ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’র পর তাঁরা প্রতিবাদ-আন্দোলনে সরব হলেন।
তবে অপ্রিয় প্রশ্ন তুলেও জুনিয়র পড়ুয়া-চিকিৎসদের আন্দোলনের প্রতি যথাযথ সম্মান ও সমর্থন জানাই। কারণ দেরিতে হলেও তাঁদের আন্দোলন-অবস্থান-অনশন কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যা সবার স্বার্থেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আজও দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই (সাধারণ বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত মানুষের) চিকিৎসার একমাত্র অবলম্বন সরকারি হাসপাতাল। যেভাবে বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে দিনে দিনে চিকিৎসা-পরিষেবা দুর্মূল্য হয়ে উঠছে, তাতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা-পরিষেবার উন্নতি প্রয়োজন।
হাসপাতালের জুনিয়র কিংবা সিনিয়র চিকিৎসক সহ সেবিকাদের (নার্স) যেমন সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে হবে, ঠিক তেমনই তাদেরও (চিকিৎসক-সেবিকাদের) আন্তরিকভাবে চিকিৎসা-পরিষেবাটুকু দিতে হবে বিপন্ন নিঃস্ব রোগীদের। কখন নিজের প্রাইভেট চেম্বারে কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছব— এই চিন্তায় সরকারি হাসপাতালে অনিয়মিত হওয়া কিংবা রোগীদের অবহেলা বা অযত্ন করা উচিত হবে না। রোগী ও চিকিৎসকদের সম্পর্কে ধ্বস নামলেও অধিকাংশ মানুষই কিন্তু আজও আপনাদের ভগবান ভাবেন।
বাড়তি রোজগারের নেশায় এই মহত্তম পেশার স্বাভাবিক জায়গা বা আসন থেকে নিজেদেরকে সরাবেন না প্লিজ।