দুর্নীতি আর দুর্নীতি— এই শব্দটা এখন মানুষের মুখে মুখে। এমনকি কমবয়সি ছেলেমেয়েরা, যাঁরা শিক্ষার্থী, তাঁদের মনেও শব্দটি নিয়ে কৌতূহল জাগছে। তাঁরাও কমবেশি বুঝতে পারছে অনৈতিকভাবে, নিয়ম, আইন বহির্ভূত কোনও কাজ করলে এবং তা প্রকাশ্যে আসলে, তা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। রাজ্যের অনেক স্কুলেই একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়ারা ক্লাসে গিয়ে বসে বসে সময় গুনছেন শিক্ষক বা দিদিমণিরা কেন আসছেন না ক্লাস নিতে। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা তো বেজে গেছে। ক্লাস হল না—তারা পরে জানল যাঁরা ক্লাস নেবেন, সেই শিক্ষকদের চাকরি চলে গেছে— তাই তাঁরা স্কুলে আসছেন না। আর এই দুর্নীতির কবলে পড়ে তাঁদের চাকরি চলে গেছে। আর অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অবাবে ক্লাস না হওয়ার জন্য তাঁরা চরম বিপদের মুখে। তাঁদের বিভিন্ন সাবজেক্ট পড়া শেষ হবে না।
ছাব্বিশ হাজারেরও ওপর শিক্ষক/শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গেছে। তাঁদের নিয়োগের যে প্যানেল ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছিল, তা ব্যাপক কারচুপি এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে হয়েছিল বলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ তা বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকার কারণে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকরা যাঁরা মেধাবী এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করে চাকরি পেয়েছিল, তাঁরা যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা হলেও কোর্টের পক্ষে তা বিচার করা সম্ভব হল না। অর্থাৎ যোগ্য ও অযোগ্যরা একই পর্যায়ে পড়ে গেলেন। যাঁরা অযোগ্য, যাঁরা পরীক্ষার খাতায় শূন্য পেয়েছে, তাঁদের চাকরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। আর এই নিয়োগের প্যানেল যখন তৈরি হয়েছিল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, যিনি তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রবীণ শ্রদ্ধেয় মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর তাঁর উপর গভীর আস্থা ছিল এবং তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘পার্থদা’ বলে। ওই সময় শিক্ষক নিয়োগে এমন দুর্নীতি হয়েছিল যে যাঁরা অযোগ্য, তাঁদের শিক্ষক হওয়ার কোনও মাপকাঠি ছিল না—তাঁদের চাকরি হল লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে। পার্থবাবু এখন জেলের ঘানি টানছেন।
এই পাহাড়সমান দুর্নীতি প্রকাশ্যে এল যখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা চ্যাটার্জির কলকাতা ও বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা এবং সোনার অলঙ্কার উদ্ধার হল। সারা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হল এই বিপুল পরিমাণ টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের পর।
এই পার্থবাবুকে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে শিল্পমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তিনি কোনও দক্ষতার পরিচয় না দেওয়ার জন্য তাঁকে এই পদ থেকে সরিয়ে শিক্ষামন্ত্রী করলেন। যা দেখে শিক্ষক মহল অবাক হয়েছিল, কারণ শিক্ষা জগৎটাই পার্থবাবুর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। আর তাঁর মন্ত্রিত্বকালেই শিক্ষক নিয়োগে এই অনাচার। এই পার্থবাবু যখন বিরোধী নেতা ছিলেন, তখন বাম জমানার প্রশাসনের সব বিভাগীয় প্রধান সচিবদের কাছ আলাদা আলাদা চিঠি লিখে দপ্তরের কাজের হিসেব লিখিতভাবে চেয়েছিলেন। সচিবরা তাঁর এই চিঠি পেয়ে অবাক হয়েছিলেন। যতদূর জানা যায়, কোনও সচিবই তাঁর চিঠির জবাব দেননি— কাজের হিসেব দেওয়া তো দূরের কথা। পার্থবাবু তাঁর দল তৃণমূলের হয়ে সহকর্মীকে নিয়ে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মহাকরণে তাঁর অফিস কক্ষের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন। অনেকক্ষণ ধর্না চলে বামফ্রন্ট সরকারের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ তাঁদের বাধ্য করে মহাকরণ ছাড়তে।
তারপর ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে এল এবং পার্থ চ্যাটার্জি মন্ত্রী হলেন। তখন তাঁর দাপট দেখার মতো ছিল। মন্ত্রিসভায় তিনি দ্বিতীয় স্থান পেলেন। সেই পার্থ চ্যাটার্জি যখন শিক্ষামন্ত্রী হলেন— তখন দেখলেন এই সুযোগ গুছিয়ে নেওয়ার। এই গোছানোর কাজটিও তিনি করলেন অতি সন্তর্পণে তাঁর বান্ধবীর সাহচর্যে। যখন গ্রেপ্তার হওয়ার মুখে, তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন এই আশায় যে মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপরে হস্তক্ষেপ করবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী টেলিফোন ধরেননি। বিরোধীদের অভিযোগ, ২০১৬ সালের প্যানেলের অসংখ্য অযোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছিলেন ধরাধরি করে নয়, লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। যেহেতু অযোগ্য প্রার্থীরা টাকার জোরে চাকরি পেয়েছিলেন, তাই কোনও রেকর্ড যাতে না থাকে, তার জন্য তাঁদের উত্তরপত্র (খাতা) এবং সেই সঙ্গে যোগ্যদের খাতাও নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। যে কারণে কোনও প্রমাণ না পেয়ে যোগ্য প্রার্থীদের অযোগ্যদের থেকে আলাদা করতে পারেনি মহামান্য উচ্চ আদালত। তাই যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা যাঁরা অনেক বছর হল চাকরি করছেন, তাঁদেরও চাকরি গেল এবং তাঁরা অথৈ জলে পড়ে গেলেন। এই শিক্ষকদের উপার্জনের টাকায় সংসার চলছে, সন্তানসন্ততির পড়াশুনার খরচ মেটাচ্ছেন, পরিবারের কেউ অসুস্থ থাকলে তার চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন। এখন যোগ্য হয়েও সেই শিক্ষকদের চাকরি গেল। যোগ্য শিক্ষকরা যাঁরা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াতেন এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, কোন দোষে চাকরি খোয়ালেন, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। যাঁদের টাকায় সংসার চলত, তাঁরা এখন কীভাবে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবেন, বুঝতে পারছেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি এই চাকরিহারাদের পাশে আছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তিনি চাকরিহারাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের কথা শুনবেন, সান্ত্বনা জানাবেন। কিন্তু সান্ত্বনায় কি কাজ হয়? তাঁদের সংসারে তো হাহাকার নেমে এসেছে, অর্থাভাবে জর্জরিত হয়ে তাঁরা এখন দিশেহারা। সামনে শুধু অন্ধকার দেখছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল, তার দায় এখন কে নেবে? কাদের দোষে তাঁদের এই অবস্থায় পড়তে হল, তা ভেবে তারা কোনও কুলকিনারা পাচ্ছেন না।
অযোগ্য যাঁরা টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছিলেন, পরীক্ষার উত্তরপত্রে কিছু না লিখে সাদা খাতা জমা দেওয়ার জন্য শূন্য পেলেন— তাঁদের মনে হয়তো একটা অপরাধবোধ জাগ্রত হয়েছে। তাঁরা চাকরি হারালেও চাকরিটা যে অসদুপায়ে পেয়েছিলেন, তা তাঁরা এখন বুঝতে পারছেন। পাপ কোনওদিন ঢাকা থাকে না— একদিন না একদিন তা বের হবেই। তাই যোগ্যতার বলে যাঁরা চাকরি পেয়ে তা হারালেন, তাঁদের দুঃখ, বেদনা আর অযোগ্য হয়েও যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের বেদনা যোগ্যদের মতো হতে পারে না। অযোগ্যরা ভাবছেন পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখে শূন্য পেয়েও অর্থের বিনিময়ে তাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন— তাই তাঁদের কষ্ট আর যোগ্যদের কষ্ট এক হতে পারে না। এসএসসি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে তালিকা তৈরি করেছিল ২০১৬ সালে, তাতে অসংখ্য কারচুপির প্রমাণ পেয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল ঘোষণা করল। এবং ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী তাঁদের চাকরি হারালেন— এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, যা ইতিহাসে লেখা থাকবে।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তার যুগান্তকারী রায়ে অবশ্য বলেছেন, যে প্যানেল বাতিল হল এবং যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা চাকরি হারালেন, তাঁদের আবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। ফল প্রকাশ এবং আনুষঙ্গিক কাজ তিন মাস সময়সীমার মধ্যে করতে হবে। কিন্তু বর্তানে যিনি এসএসসি’র চেয়ারম্যান, এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন তিন মাসসময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পূর্ণ করা একেবারে অসম্ভব। কারণ পরীক্ষার পর ফলাফল বের হলে অনেক কাজ বাকি থাকে। যেমন সফল পরীক্ষার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়া এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য এই তিন মাস সময় যথেষ্ট নয়। তাহলে এর বিকল্প রাস্তা কী আছে, তা কেউ বলতে পারছে না। শিক্ষামন্ত্রী শুধু বলেছেন, সরকার চাকরি হারাদের পাশে থেকে তাদের জন্য কীকরা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে রায়ের পর মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে যা বলেছেন, তাই যথার্থ।
পুনরায় চাকরিহারাদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ সম্বন্ধে একজন প্রাক্তন সচিব, যিনি শাসক দল তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন এবং রাজ্যসভার সাংসদও হয়েছিলেন— পরে যে কারণেই হোক, তিনি পদত্যাগ করে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন— একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেছন, আজ যে পড়ুয়া পরীক্ষায় সফল হল, দু’দিন পর আবার তাকে পরীক্ষায় বসতে বললে সে সফল নাও হতে পারে। সুতরাং শিক্ষক-শিক্ষিকারা পরীক্ষায় সফল হয়ে ন্যায্যভাবে চাকরিতে বহাল হয়েছিলেন, তাঁদের পরীক্ষায় বসতে বললে তাঁরা সবাই সফল নাও হতে পারে। আবার যাঁরা অযোগ্য হয়েও অর্থের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরীক্ষায় সফল হতে পারেন। সুতরাং এ ব্যাপারে বিশেষ চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। একমাত্র সরকারই বলতে পারে এই ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী, যাঁরা চাকরি হারালেন, তাঁদের সম্বন্ধে কী সিদ্ধান্ত নেবে। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী?
একজন প্রাক্তন বিচারপতি যিনি বিচারকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে যোগদান করে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন, তিনি বলেছেন এখনও সময় আছে যোগ্য ও অযোগ্যদের বাছাই করা। তিনি এ ব্যাপরে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন চাকরিহারাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটি কমিটি তৈরি করা হোক— যোগ্য-অযোগ্যদের বাছাই করতে। শাসক দলের একজন সাংসদ বলেন, এই বিচারপতি তো মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন— এখন সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। আবার তৃণমূলের এক সাংসদ বলেছেন, প্রাক্তন এই বিচারপতি এবং বিজেপি সাংসদ কথা যত কম বলেন ততই ভালো।
বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য ক্ষেত্রেও। যেসব অযোগ্য শিক্ষকরা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াতেন (কী পড়াতেন একমাত্র ঈশ্বর জানেন)— তাঁরাই আবার পরীক্ষার খাতা দেখছেন। তাঁদের খাতা দেখা এবং মূল্যমান নির্ণয় করা সঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে শিক্ষক মহলে ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছে। তাদের মূল্যায়ন ঠিক না হলে তা পরীক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। যাঁরা পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে চাকরি পেলেন, যাঁরা সাদা উত্তরপত্র জমা দিলেন, এখন তাঁরাই পরীক্ষার খাতা দেকছেন— যা বিস্ময়ের। তাঁদের মূল্যায়ন কিছুতেই ঠিক হতে পারে না। এসএসসি এখন কোনদিক সামলবে, প্রশ্ন সেটাই।