• facebook
  • twitter
Tuesday, 8 October, 2024

‘ধ্রুপদী’ মুকুট কি বাংলার সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে উন্নত করবে?

ধ্রুপদী ভাষা স্বীকৃতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটা সে তর্কে না গিয়েও আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষায়, গবেষণায় কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে।

ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক এবার অন্য আরও চারটি ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা প্রদান করায় আমরা খুব খুশি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সামাজিক মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে সারা ভারতের বাংলাভাষাভাষী মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাই যে ‘বাংলা’কে অবশেষে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে এই স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম এবং আমরা আমাদের দাবির সমর্থনে যাবতীয় গবেষণার ফলাফলের তিনটি খণ্ড জমা দিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় সরকার আজ সন্ধ্যায় আমাদের গবেষণালব্ধ দাবি মেনে নিয়েছে এবং আমরা অবশেষে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক শীর্ষে পৌঁছেছি।’
ভারতীয় বাঙালিদের জন্যে এই বার্তা সত্যিই আনন্দের। তবে স্বীকৃতি ‘ছিনিয়ে’ নেওয়ার কথা কেন বললেন মুখ্যমন্ত্রী? এর উত্তর একটু পরে দিচ্ছি।

১১১ বছর আগে এশিয়ার প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সারা পৃথিবীতে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলায় সাহিত্যচর্চাও ক্রমে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে হিন্দিসহ সারা ভারতের সমস্ত ভাষার সাহিত্যিকরাই যেমন বাংলা ভাষার অগ্রণী সাহিত্যিকদের লেখা কৃতিগুলিকে শ্রদ্ধা ও সমীহ নিয়ে দেখতেন, আজও সেভাবেই দেখেন, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বিমল মিত্রের সাহিত্য ভারতের বিভিন্ন ভাষায় এত বেশি অনুবাদ হয়েছে যে তাঁদেরকে অনেকেই তাঁদের নিজের ভাষার লেখক বলেই জানেন। পরবর্তীকালে সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কিম্বা মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দি ও ইংরেজিকে যোগাযোগ রক্ষার ভাষা হিসেবে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হলে, আর সরকারিভাবে বিভিন্ন সময়ে আসামে, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ে অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হলেও অন্যান্য প্রধান ভারতীয় ভাষার সাহিত্যিকরা কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি এই শ্রদ্ধা ও সমীহর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু ২০০৪ সালে, ভারত সরকার ঘোষণা করে, যে ভাষাগুলি কিছু কঠোর মানদণ্ড পূরণ করে সেগুলিকে ভারতের ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।

২০০৬ সালের একটি প্রেস রিলিজে, কেন্দ্রীয় পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রী অম্বিকা সোনি রাজ্যসভাকে বলেছিলেন যে ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে শ্রেণিবিন্যাসের জন্য বিবেচিত ভাষাগুলির যোগ্যতা নির্ধারণ করতে যে মানদণ্ডগুলি নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলি হল, ১. ১৫০০-২০০০ বছর সময়কালের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ্যের অতি প্রাচীনত্ব; প্রাচীন সাহিত্য বা পাঠ্যসমূহের একটি ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, ২. যে ভাষার সাহিত্য প্রস্তাবকদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি মূল্যবান ঐতিহ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে; ৩. সেই ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য মৌলিক হতে হবে এবং যা অন্য বাক্-সম্প্রদায় থেকে ধার করা নয়; ৪. সেই ধ্রুপদী ভাষা এবং তার সাহিত্য সে ভাষার আধুনিক রূপ থেকে স্বতন্ত্র হওয়ায় ওই ধ্রুপদী ভাষা এবং তার পরবর্তী রূপ বা তার শাখাগুলির মধ্যে স্বল্প বিচ্ছিন্নতাও থাকতে পারে। এই সব কিছু বিবেচনা করার জন্য ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক দেশের স্বনামধন্য ভাষাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি ‘ধ্রুপদী ভাষা’ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভারত সরকার একে একে ছয়টি ভাষাকে ভারতের ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেগুলি হল – তামিল (২০০৪), সংস্কৃত (২০০৫), তেলুগু (২০০৮), কন্নড় (২০০৮), মালয়ালম (২০১৩) ও ওড়িয়া (২০১৪)। সেই তালিকায় বাংলা ভাষার নাম না থাকায় বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিকরা তখন অবাক হয়েছেন। সেজন্য ২০১৩ সালে মালয়ালম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, ভাষা আন্দোলনের প্রবীণ ও নবীন নেতৃত্ব এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে আয়োজিত প্রতিবাদ সভা, গণ কনভেনশান, পদযাত্রার মাধ্যমে, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি সহ অন্যান্য দাবি পেশ করেছেন। তারপর ২০১৪ সালে ওড়িয়া ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের দুই সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য ও অধীররঞ্জন চৌধুরী যখন পার্লামেন্টে বাংলাভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে এর জন্য পদ্ধতিগতভাবে আবেদন করতে বলেন। তারপরেও নানা স্তরে আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু এটা ঠিক যে, রাজ্য সরকারের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও তদ্বির না থাকলে এই স্বীকৃতি আসতো না, কারণ এর ফরম্যাটটাই এরকম। সেজন্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ‘ছিনিয়ে’ আনার দাবি অস্বীকার করা যায় না।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নির্দেশেই ২০২০ সাল থেকে ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ, পশ্চিমবঙ্গের নির্দেশক স্বাতী গুহ আর তাঁর টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০২৩ সালে এই আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা করা সম্ভব হয়। এই টিম শুধু আবেগ কিম্বা যুক্তি দিয়ে নয়, প্রথাগতভাবে ভারত সরকারের ওই ‘ধ্রুপদী ভাষা কমিটি’র চাহিদা অনুসারে সমস্ত তথ্য ও প্রমাণের যোগান দিয়ে গেছেন, এবং প্রমাণ করেছেন যে খ্রিস্টজন্মের তিনশো বছর আগেও, বাংলা ভাষার আদিরূপ বিদ্যমান ছিল। এই যুক্তি ও প্রমাণ কমিটি যাচাই করে দেখার পরেই অবশেষে এবার শারদোৎসবের আগে এই সুসংবাদ এলো। এবার বাংলাসহ আরও ৫ টি ভাষা এই ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা পেল। সেগুলি হল মারাঠী, পালি, প্রাকৃত এবং অসমীয়া।

‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা পাওয়ায় এই ভাষাগুলির কী লাভ হবে? ১নভেম্বর ২০০৪ তারিখের ভারত সরকারের প্রস্তাব নং ২-১৬/২০০৪-ইউএস (আকাদেমি) অনুসারে, ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসাবে ঘোষিত একটি ভাষার ক্ষেত্রে যে সুবিধাগুলি যুক্ত হবে তা হল: ১. ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষায় বিশিষ্ট পণ্ডিতদের জন্য দুটি বড় বার্ষিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২. ধ্রুপদী ভাষায় পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য একটি ‘সেন্টার অফ় এক্সিলেন্স’ স্থাপন করা হয়েছে। ৩. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষার বিশিষ্ট পণ্ডিতদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘প্রফ়েশনাল চেয়ার’ তৈরি করা হয়, এতদিন শুধু ছ’টি ধ্রুপদী ভাষাই এই সুবিধাগুলি পেয়ে এসেছে। এবার বাংলা, মারাঠী, পালি, প্রাকৃত এবং অসমীয়া ভাষাও সেই সুযোগ পাবে।

বাংলা ভাষার গৌরব তা শুধুই রবীন্দ্রনাথ নজরুল সহ অসংখ্য বিপুল প্রতিভাসম্পন্ন স্রষ্টার ভাষা বলে নয়, শুধু ভাষা শহিদদের ভাষা বলে নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভিত্তি-ভাষা বলে নয়, পৃথিবীর ষষ্ঠ বা সপ্তম বৃহত্তর জনগোষ্টীর ভাষা বা ভারতের দ্বিতীয় বহুকথিত ভাষা বলে নয়, কোনও ভাষার আসল শক্তি সেই ভাষা তার বক্তাদের কী কী দেয়, আর তার বক্তারা তাকে কী কী দেয় তার ওপর নির্ভর করে। সেই ভাষার বক্তারা তাকে কী দেওয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলে বা নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাই আসল প্রশ্ন। সেই ভাষা কি তার বক্তাদের জীবনধারণের আশ্বাস দেয়, কোনও আশা জোগায়? তা কি তার বক্তাদের দৈনন্দিন যাপনে কোনওরকম সাহায্য করে? শুধু সাংস্কৃতিক যাপন যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিক যাপনে? এখানেই আসে রাষ্ট্রের দায়িত্ব–রাষ্ট্র কি ভাষাটিকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক ভূমিকা দিয়েছে–প্রধানত এই ভাষায় লেখাপড়া করে কি ভালো চাকরি পাওয়া যায়?

ধ্রুপদী নামটা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তার কর্তব্য শেষ করছে, না আর কোনও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন করতে হবে। ধ্রুপদী ভাষা স্বীকৃতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটা সে তর্কে না গিয়েও আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষায়, গবেষণায় কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। পাশাপাশি প্রশ্ন করতে হবে রাজ্য সরকারকেও, এই ‘ছিনিয়ে’ আনার পর রাজ্য এই ভাষাকে নিয়ে কী কী নতুন সংকল্প নিচ্ছে? স্কুলের শিক্ষা, বিশেষত বাংলা শিক্ষার কোনও উন্নয়নের পরিকল্পনা কি আছে রাজ্যের?
এই স্বীকৃতির খবরে আনন্দিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমীরা এখন সামাজিক মাধ্যমে দাবি তুলেছেন, অন্যান্য রাজ্য যেমন সেই রাজ্যের প্রধান ভাষাকে স্কুল- কলেজে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাধ্যতামূলক করে, এবার পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা সরকারও একইরকম পদক্ষেপ নিক।