ডিভিসি কি ডোবানো ভাসানো কর্পোরেশন হয়েই থাকবে?

সাম্প্রতিক নিম্নচাপের কারণে দক্ষিণবঙ্গ পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেয়েছে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি হ্রাস পাওয়ার পরের পর্যায়ে, ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হওয়ায় ডিভিসি-র জলাধার থেকে জল ছাড়ায়। যে জল দক্ষিণবঙ্গে ঢুকে কার্যত তছনছ করে দিয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে। তাঁর দাবি, এত পরিমাণ জল এর আগে কখনও ছাড়া হয়নি। সুতরাং, পরিকল্পিত ভাবে বাংলায় এই বন্যা করা হচ্ছে।

দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বরাবরই প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে ডিভিসি-কে দোষারোপ এবং কেন্দ্রের অবিবেচনার প্রসঙ্গটি তোলা হয়। বাস্তবে এই দাবি অ-সত্যও নয়। এক লপ্তে আড়াই-তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছয়, ঘাটাল, পাঁশকুড়া, পুরশুড়া, খানাকুল, আরামবাগ, গোঘাট, তারকেশ্বর, উদয়নারায়ণপুর তার জ্বলন্ত প্রমাণ। একাধিক প্রাণহানিও ঘটেছে ভয়াল বন্যায়। এটাও বাস্তব যে, জলধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে ব্যারাজ। কারণ গত সাত দশকে এক বারও কেন্দ্র সেখানে ড্রেজিং-এর কাজ করেনি। ফলে, নির্ধারিত জলধারণ ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম জল জমলেই জল ছাড়তে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বয়ং জানিয়েছেন, আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে ডিভিসি-তে ড্রেজিং সম্ভব নয়। আশ্চর্য লাগে, তবে কি প্রতি বছর বন্যায় মানুষ, ঘরবাড়ি, চাষের জমি-সহ ভেসে যাওয়াই নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে দক্ষিণবঙ্গের?

রাজ্যই বা কেন নদীবাঁধগুলিকে বছরের পর বছর অরক্ষিত রেখে দিয়েছে, এ প্রশ্নও জরুরি। এই বছরও একের পর এক নদীবাঁধ ভাঙায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল-সহ একাধিক জায়গায় প্লাবন হয়েছে। অভিযোগ, বন্যার জন্য কুখ্যাত ঘাটালে নদীবাঁধ মেরামতির নির্দেশ স্বয়ং সেচমন্ত্রীর তরফ থেকে এলেও তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যে জায়গাগুলি ভূ-প্রকৃতিগত ভাবেই নিচু, সেখানে বাঁধ মেরামতির কাজ যথাযথ না হলে অতিবৃষ্টিতে পরিণাম কী হতে পারে, রাজ্য প্রশাসন জানে না? বাঁধের উপর বেআইনি নির্মাণ ঠেকাতেই বা কী পদক্ষেপ হয়েছে? বস্তুত, প্রতি বছর বন্যার পর ডিভিসি-কে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্য দায় ঠেলাঠেলির যে পর্ব চলে, তাতে রাজনীতির রসদ থাকে প্রচুর। কিন্তু প্রকৃত সমাধানসূত্র মেলে না। সর্বোপরি, কেন বার বার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতি ছাড়া ডিভিসি-র জল ছাড়ার অভিযোগ ওঠে?


নিয়ম অনুযায়ী, জল কমিশন, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং ডিভিসি-র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তা সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে যথাসময়ে খবর না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে কেন, সব পক্ষকেই তার উত্তর খুঁজতে হবে। এই উদ্যোগ ছাড়া রাজ্যের আধিকারিকদের প্রত্যাহার করে নিলে বা ডিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা বললে প্রকৃত সমাধান মিলবে না। এ-হেন জলযুদ্ধে শেষপর্যন্ত কোনও পক্ষেরই লাভবান হওয়ার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ বিষয়টির মধ্যে ক্ষোভ এবং আবেগ যতটা আছে, সমাধানের প্রচেষ্টা ততটা নেই। বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় পণ্যবাহী ট্রাক আটকানোর মধ্যেও বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় মেলেনি। সীমান্তে ট্রাক আটকালে পশ্চিমবঙ্গের বাজারেই আগুন লাগবে, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদের বুঝতে যে দেড় দিন লাগল, তা বিস্ময়কর। বন্যা এবং তৎপরবর্তী আর্থসামাজিক বিপর্যয় কঠোর বাস্তব। আবেগসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছনো যাবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ডিভিসির একজন অংশীদার তথা মালিক। স্বাধীন ভারতের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া ডিভিসি অ্যাক্ট ১৯৪৮ দ্বারা যে অংশীদারত্ব অর্পিত হয়েছে, জনসভায় দাঁডিয়ে তা শেষ করে দেওয়া যায় নাকি?

দেশের আইন, সংবিধান কিছুই না মানলে কি করে কি চলবে? এরকম কি হতে পারে, মৌখিক ভাবে, সাংবিধানিক নিয়মের মধ্যে থেকে, এসব কি বলতে বা করতে পারে একজন নির্বাচিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তাও আবার ডিভিসির একজন অংশীদার? সব জেনে বুঝে ‘ম্যান মেড’ বন্যা দুর্গত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ডিভিসির উপর দোষ চাপিয়ে রেহাই পেতে চাইলেন।

প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদে বসে এই ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। বর্তমান ডিভিসি কর্তৃপক্ষ তো সদর দপ্তর কলকাতা থেকে সরিয়ে আনার জন্য হাত-পা ধুয়ে বসেই আছে! রাঁচী তো লুফে নেবে ডিভিসি সদর দফতর কলকাতা থেকে সরিয়ে নেবার ‘প্রস্তাব’। তাতে বর্তমানে ডিভিসির হেড অফিস কলকাতায় থাকার কারণে জিএসটির শেয়ার বাবদ যে হাজার হাজার কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গ প্রতি বছরে পায়, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে, চলে যাবে ঝাড়খন্ডের ঘরে। তাতে কার ক্ষতি? সেই রাজ্যেরই ক্ষতি।

প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদে বসে এমন কথা বললে সব থেকে, বিপদে পড়ছেন ডিভিসিতে কর্মরত কর্মচারী অফিসারেরা। শহরে ততটা না হলেও গ্রামের লোক ভীষণ দুর্ব্যবহার করেন, গালি দেন ডিভিসি কর্মীদের।
অথচ মজা হলো, ডিভিসি নিজে কিন্তু জল মোটেও ছাড়ে না, ছাড়ে জল কমিশন। দেশের অনেকগুলির নদীর জলসম্পদ এই কমিশনের অধীন। দামোদর নদীর জন্য এর মেম্বাররা হলেন যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ড সরকারের সেচ দফতরের সচিবরা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। ডিভিসি শুধু এই কমিশনের কাছে তথ্য সরবরাহ করে যে আপার ভ্যালিতে কতটা পরিমান বৃষ্টিপাত হয়েছে, কতটা জল নামছে, মাইথন জলাধারে কতটা জল ধরে রাখা আছে ইত্যাদি। সেইসব তথ্য পরিসংখ্যান হিসাব পর্যালোচনা করে জল কমিশনের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন কত হাজার কিউসেক জল ছাড়তে হবে। আর হ্যাঁ, সেই সিদ্ধান্তে সই করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিও এবং সেটির প্রতিলিপি ফ্যাক্স, ইমেল করে জানানো হয় সংশ্লিষ্ট সবকটি জেলা শাষকদের দফতরে এবং কলকাতাতেও। এবং তাও জলছাডা় শুরু করার বেশ কয়েকঘন্টা আগেই। কাছাকাছি অঞ্চলে ডিভিসি কর্মীরা গাড়ী নিয়ে প্রচার করেন। কাজেই না-জানিয়ে ডি ভি সি জল ছাড়তেই পারে না।

প্রসঙ্গত, মাইথন বাঁধের জল ধরে রাখার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ৪৯০ ফিট ডিভিসি কিন্তু অনেকবারই বিপদ মাথায় করে নিয়েও ৪৮৯ ফিট পর্যন্ত জল ধরে রেখেছে, জল ছাড়েনি। কিন্তু কিছুটা জল না ছাড়লে যে বাঁধ ভেঙ্গে যাবে এবং তার ফলে কলকাতা শহর অবধি সব ভেসে যাবে, এটা বোঝবার জন্য নদী বিশারদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববর্তী আরও কয়েক বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর, ১৯৪২ সালের বিধ্বংসী বন্যা দেখে ব্রিটিশরা বাধ্য হয় দামোদর রিভার প্রজেক্ট গ্রহণ করতে এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর ড. মেঘনাদ সাহা, ডা. বিধান চন্দ্র রায়, বর্ধমানের মহারাজার মতো কিছু শিক্ষিত মানুষ এই নদী পরিকল্পনার গুরুত্ব বুঝে, পন্ডিত নেহরুর সহযোগিতায় আমেরিকার টেনেসি ভ্যালি কর্পোরেশনের সহায়তায় ও আদলে গড়ে তোলেন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন ও বাঁধ, পন্ডিত নেহরু যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন “আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান-মন্দির”।

এই নির্মাণকল্পে আমেরিকান, জার্মান এবং দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জাতির (ইংরেজ ও ফ্রান্স) ইঞ্জিনিয়র ও কোম্পানীর লোকেরা একসাথে কাজ করে গেছেন।

ডিভিসি একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান, ৭৫ বছরের উপর দেশ সেবায় নিয়োজিত ও ডিভিসি­র দেশসেবায় গৌরবময় অধ্যায় সর্বজন বিদিত। সরকার সাময়িক, আসবে যাবে। ডিভিসি দেশের সেবায় আছে আর আজীবন থাকবে। পৃথিবী বিখ্যাত বহু গুনীজন এই ডিভিসির সাথে সম্পর্কিত আর জড়িত ছিলেন। শুধুই ম্যান মেড বন্যা বলে ডিভিসিকে দোষারোপ করে লাভ নেই, বরং রাজ্য ও কেন্দ্র একযোগে কাজ করুক। নদীর নাব্যতা বাড়ানো হোক, তবেই হতে পারে প্রকৃত সমস্যার সমাধান। সেক্ষেত্রে ডিভিসিকেও আর কেউ ডোবানো ভাসানো কর্পোরেশন বলবে না।