• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 October, 2024

পশ্চিমবঙ্গে বারবার ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে কেন ?

১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের 'ভোলা'য় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট।

বিধ্বংসী ঝড় কখনো রাজনীতির রঙ দেখে আসে না। তবে যে রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ, সেখানে ঝড় নিয়েও রাজনীতি হয়। ত্রাণ নিয়ে হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। ক্ষতিপূরণের মধ্যেও ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ। সব ক্ষেত্রেই যখন বাম ও তৃণমূল জমানার তুলনা উঠে আসে, তখন ঝড়ই বা বাদ যাবে কেন। বাম জমানার শেষের দিকে বাংলাকে তছনছ করে দিয়েছিল সাইক্লোন ‘আয়লা’। গরম কালে কখনও ‘আয়লা’, কখনও ‘আমফান’, কখনও ‘যশ’-এর তাণ্ডব দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ।

ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এনডিএমএ) ঘূর্ণিঝড়কে বিস্তৃতভাবে দুটি ভাগে ভাগ করেছে:- ‘এক্সট্রাট্রপিকাল সাইক্লোন’ এবং ‘গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়’। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দেখলেই দেখা যাবে, ফি বছর এই রকম সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা । ২০০৯ সালের ২৫ মে সুন্দরবনে ছোবল মেরেছিল ‘আয়লা’। ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় একশো কুড়ি কিলোমিটার। ‘আয়লা’র দাপটে পশ্চিমবঙ্গের জেলা গুলোতে প্রাণ গিয়েছিল কমপক্ষে ১৫০ জনের। ২০১৯-এর ৩ এবং ৪ মে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে তাণ্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ । ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৭৫ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়েছিল ‘ফনী’র ছোবল! ২০২০-র ২০ মে বাংলার উপকূলে আছড়ে পড়ে ‘আমফান’। সেই ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে পশ্চিমবঙ্গে ৮০ জনের ওপরে মানুষের প্রাণ যায়। সেই ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই ২০২১ এ ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রথম ঝাপটা সহ্য করতে হয় দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্তু ওই মে মাসেই কেন বারবার ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড় ? বিশেষজ্ঞদের মতে, সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এর অন্যতম বড় কারণ। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন , সাইক্লোন একদিনে তৈরি হয় না। প্রথমে নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হয়। এরপর নিম্নচাপ তৈরি হয়। এরপর গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়। পরে অতি গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়। এরপর ‘সাইক্লোনিং স্টর্ম’ তৈরি হয়। তারপর ‘সিভিয়ার সাইক্লোন’ তৈরি হয়। এরপর ধাপে ধাপে ‘ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন’, ‘এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন’, ‘সুপার সাইক্লোন’ তৈরি হয়। সুপার সাইক্লোন সর্বোচ্চ। ঝড়ের ঘূর্ণনের গতিবেগের উপর ভিত্তি করে এটা ধার্য করা হয়।

বঙ্গোপসাগরে বেশি ঝড় হওয়ার কারণ হল আরব সাগরে বাতাসের প্রবাহ। পশ্চিম উপকূলে আরব সাগর, পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরের চেয়ে ঠান্ডা। আবহাওয়াবিদদের মতে, ঠান্ডা মহাসাগরের তুলনায় উষ্ণ মহাসাগরে ঝড় বেশি হয়।ইতিহাসের ৩৬টি মারাত্মক গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ঘটেছে। এর মধ্যে ২৬টি বঙ্গোপসাগরে ঘটেছে। ভারতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়ের সর্বোচ্চ প্রভাব দেখা গেছে ওড়িশায়। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুও-এর প্রভাবে পড়েছে । এছাড়াও, পূর্ব উপকূল সংলগ্ন রাজ্যগুলোর ভূমি, পশ্চিম উপকূল সংলগ্ন ভূমির চেয়ে বেশি সমতল। এ কারণে এখানে আঘাত হানতে থাকা ঝড়গুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। একই সময়ে, পশ্চিম উপকূলে আগত ঝড়ের গতিপথ প্রায়ই পরিবর্তিত হয়। আরব সাগরের ঝড় গুলো মৃদু হয়, ভারতে আঘাত হানা পাঁচটি ঝড়ের মধ্যে চারটি পূর্ব উপকূলে আঘাত হানে। ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর থেকে উৎপন্ন ঝড়গুলো ছাড়াও উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উৎপন্ন ঝড়গুলো দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায়।সে কারণে আমাদের দেশের পূর্ব উপকূল সর্বদা চাপের মধ্যে থাকে। রিপোর্ট অনুসারে, আরব সাগরেও ঝড় তৈরি হয়, তবে তারা সাধারণত ভারতের পশ্চিম উপকূল ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে যায়। পূর্ব উপকূলে সৃষ্ট ঝড়গুলো বেশি শক্তিশালী। নিম্নচাপ এলাকায় বাতাসের গতির উপর ভিত্তি করে হ্যারিকেনের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। যদি বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১৯ থেকে ২২১ কিলোমিটারের মধ্যে হয় তবে এটি একটি প্রবল ঝড় হিসাবে বিবেচিত হয়।

আবহাওয়াবিদদের মতে, ঝড়ের মরশুম এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর। কিন্তু ৬৫ শতাংশ ঝড়ই হয় বছরের শেষ চার মাসে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলো ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি জুড়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যায়। যার ফলে উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশে বৃষ্টিপাত হয়।’ গুজরাট ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের অ্যাসেসমেন্ট অফ ভলনারেবিলিটি টু সাইক্লোন অ্যান্ড ফ্লাড’-এর হিসাবে ৪৮ শতাংশ ঝড় ওড়িশায় এবং ২২ শতাংশ ঝড় পূর্ব উপকূলে অবস্থিত রাজ্যগুলোতে আছরে পড়ছে । সেখানে অন্ধ্র প্রদেশে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে ১৮.৫ শতাংশ ঝড় এবং তামিলনাড়ুতে ১১.৫ শতাংশ ঝড় ধাবিত হয়েছে ।গত বছর আরব ও বঙ্গোপসাগর মিলিয়ে মোট আটটি ঘূর্ণিঝড় দেখা গেছে। যার মধ্যে ছটিই সুপার সাইক্লোন। আবার ২০২০ সালের প্রথম ঘূর্ণিঝড়টিই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সুপার সাইক্লোন। পশ্চিমবঙ্গে এত ঘনঘন সুপার সাইক্লোনের আনাগোনা কিন্তু আবহাওয়াবিদদের চাপ বাড়াচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০২ সালের পর ২০০৯ সালে বাংলায় হানা দিয়েছিল ‘আয়লা’। নিয়ম মেনে তার ১০ বছর পর ‘বুলবুল’।

আবহবিদেরা ঘূর্ণিঝড়ের যে-প্রকারভেদ তৈরি করেছেন, তাতে কোনও অতি গভীর নিম্নচাপের কেন্দ্রে যখন বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত থাকে, তখন তাকে ‘ঘূর্ণিঝড়’ বলা হয়। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৯ কিলোমিটার হলে তাকে বলা হয় ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। গতিবেগ ১২০ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হলে তা ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের গতিবেগ হলে ‘সুপার সাইক্লোন’। ১৯৯৯ সালে ওড়িশায় আছড়ে পড়া ঝড়টি যেমন সুপার সাইক্লোন। তেমনই ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আঘাত করা ‘সিডার’; কিংবা ২০২০ সালে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়া আমফানও ছিল ‘সুপার সাইক্লোন’। সেদিক থেকে ‘রেমাল’ প্রবল ঘূর্ণিঝড়। শেষ মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তনের জন্যই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আর হয়ে উঠতে পারেনি সে।

আজ আসতে চলা ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ হল বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একটি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়, ভারতের ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। যা চিন্তা বাড়াচ্ছে পরিবেশবিদদের। ওড়িশা সরকার বেশ কয়েকটি জেলার জন্য একটি রেড অ্যালার্ট জারি করেছে এবং ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছে, ২৪ তারিখ ল্যান্ডফলের কথা থাকলেও দুর্যোগ যে কোনও সময় ঘনিয়ে আসতে পারে। সেই কথা মাথায় রেখে ২৩ তারিখ থেকে ৩ দিন পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, কলকাতা, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামে স্কুল গুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফেরি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জেলেদের সমুদ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাস করে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। বিশ্বের ইতিহাসে যতসব ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে এই বঙ্গোপসাগরে। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছে। ‘আমফান’ বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ২৭ নম্বর সুপার সাইক্লোন। কাতার সাম্প্রতিক এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছে, ‘দানা’। দানা আরবীতে “উদারতা” এর অর্থ বহন করে। নামটি আরবীতে “সবচেয়ে নিখুঁত আকারের, মূল্যবান এবং সূক্ষ্ম মুক্তা” এর প্রতীক। এটি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য প্রতিফলিত করে, বিশেষ করে পারস্য উপসাগরের আরব রাজ্যগুলোর মতো মুক্তা ডাইভিংয়ের জন্য পরিচিত অঞ্চলগুলোতে। ফার্সি ভাষায়, “দানা” অর্থ “জ্ঞানী”।

আবহাওয়াবিদদের মতে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে অবতল আকৃতির অগভীর উপসাগরে। এ রকম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। তবে বঙ্গোপসাগরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন সমুদ্রের উপরিতল বা সারফেসের তাপমাত্রা। এটি পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
কথা হচ্ছিল, ভারতের আবহাওয়া দফতরের প্রধান ডি মহাপাত্রের সঙ্গে। তাঁর কথায়, বঙ্গোপসাগর খুবই উষ্ণ। আর এ উপকূলজুড়ে যে রকম ঘনবসতি, সেটি ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের একজন থাকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলোতে। বঙ্গোপসাগরে বা আরব সাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, প্রতি ১০ বছরে তার মাত্র একটি হয়তো এ রকম প্রচণ্ড ক্ষমতা বা শক্তির ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।

১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ‘ভোলা’য় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট।

১৯৯১ সালের মহাঝড়, ১৯৯৫ সালের প্রবল ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন, ২০০৯ সালের ‘আয়লা’, ২০১৪ সালের ‘ফণী’, ২০২১ সালের ‘ইয়াস’ কিংবা ২০২৪ সালে ‘রেমাল’ থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কখনও ওড়িশা, কখনও-বা বাংলাদেশ সেই ঝড়ের সামনে নিজেদের বুক পেতে দিয়েছে। এমনই অভিমত আবহবিজ্ঞানীদের অনেকের। ব্যতিক্রম, ২০২০ সালের ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার গতিবেগের ‘আমফান’ বা ‘উমপুন’, যা সরাসরি আঘাত করেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূলবর্তী এলাকা।

এপ্রিল, ২০১৯ সালে ফণী সাইক্লোনের সর্বোচ্চ গতি ছিল ২০০ কিলোমিটারের বেশি। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়, ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশে। দুই দেশের ওপর দিয়েই বয়ে গিয়েছিল ঝড়। বাংলাদেশে বহু মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল সেই ঝড়ে। রাজ্যের তরফে জানানো হয়ছিল প্রায় ৫৬৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় সেই ঝড়ে। প্রায় ২৯ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সব বাড়ি মেরামত করার জন্য রাজ্য সরকার ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। তবে এতটাই ভয়াবহতা ছিল যে প্রায় ২ মাস পরও কেন্দ্রকে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব পাঠাতে পারেনি রাজ্য।

ওই বছরই নভেম্বরে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে বাংলার উপকূলে আছড়ে পড়েছিল সাইক্লোন ‘বুলবুল’। সাগরদ্বীপ ও ফ্রেজারগঞ্জের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে সেই ঝড়। কয়েক মিনিটেই তছনছ করে ‘বুলবুল’। দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দাপট চলিয়েছিল ‘বুলবুল’। ভেঙে পড়ে প্রচুর গাছ, মাটির ঘরও। নামখানা, সাগরদ্বীপ ও মৌসুনী দ্বীপে রীতিমতো তাণ্ডব চলে। নামখানায় ভেঙে যায় দু’টি জেটি। দিঘা-শঙ্করপুরেও প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেই ঝড়ে।

২০২০-র মে মাসে বর্তমান সরকারের আমলে সবথেকে ভয়ঙ্কর ঝড় ছিল এই ‘আমফান’। ২০২০ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়ে সেই ঘূর্ণিঝড়। সেই রাতে সারারাত নবান্নেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে। কেন্দ্রের কাছে মোট ১,০২,৫০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল মমতা সরকার। ২৮,৫৬,০০০ গুলি বাড়ি, ২,৫০,৫৫৬ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২১,২২,০০০ গবাদি পশুর মৃত্যুর কথাও জানিয়েছিল রাজ্য।

তৃতীয়বার তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসেছে সদ্য। ঠিক সেই সময় মে মাসে আছড়ে পড়ে সাইক্লোন ‘ইয়াস’। পারাদ্বীপ ও সাগরের মধ্যে ল্যান্ডফল হয় সেই ঝড়ের। প্রায় ১০০ কিমি বেগে আছড়ে পড়েছিল ঝড়। ক্ষয়ক্ষতি: পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। হাজার হাজার বাড়ি জলমগ্ন হয়ে যায়। অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা বলেছিল নবান্ন। এরপর ‘দুয়ারে ত্রাণ’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক হাজার কোটি টাকার সেই প্রকল্প চালু করা হয়।

২০২৪ সালের মে মাসে আমফানের পথ ধরেই এগিয়ে আসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। বাংলাদেশের খেপুপাড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের মাঝে আছড়ে পড়ে সেই সাইক্লোন। গতিবেগ পৌঁছেছিল ১৩৫ কিলোমিটারে। ঝড়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হয় দক্ষিণবঙ্গে। উত্তাল হয় সমুদ্র। রেমালের প্রভাবে বেশি ক্ষতি হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে রেহাই পায়নি পশ্চিমবঙ্গও। কোথাও গাছ পড়ে, কোথাও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৬ জনের মৃত্যু হয় সেই ঝড়ে। এছাড়াও প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয়। মৃতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করে রাজ্য সরকার।

ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হেনে, ৬০ জনেরও বেশি প্রাণ নিয়েছে। ভারী বৃষ্টির সাথে ৮০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে গেলস, এক লাখেরও বেশি মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে বাস্তুচ্যুত করেছে। নদীগুলো তাদের বাঁধ ভেঙেছে এবং কলকাতা শহরের ১০০ টিরও বেশি জায়গায় গাছ উপড়ে পড়েছে, যার ফলে সড়ক পরিবহন ব্যাহত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে রেল ও বিমান পরিবহণেও বাধা সৃষ্টি হয়। যা পথে অনেক লোক আটকা পড়ে। সেনাবাহিনীকে উদ্ধার অভিযানে নামানো হয়। ৮০,০০০ এরও বেশি মানুষকে অস্থায়ী ত্রাণ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়।

২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের নিচে থাকা ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে ‘রেশমি’, ‘বিজলি’, ‘ভিয়ারু’, ‘কোমেন’, ‘রোয়ানু’, ‘ডিয়ামু’ উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪-’১৮ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ৬৪টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রবল এবং অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়েরাই সংখ্যাগুরু।

২০২৩ ছিল এখনও অবধি উষ্ণতম বছর। আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন গত বছর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, “২০২৪ সালে ‘এল নিনো’-র প্রভাব আরও বাড়বে। বাড়বে বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা।” অর্থাৎ, ২০২৪ হতে পারে পূর্বতর রেকর্ড ভেঙে উষ্ণতম বছর। সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই বেশি পরিমাণে জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে যাবে। সমুদ্রে তৈরি হবে নিম্নচাপ বলয়। বাষ্পীভবনের হার বাড়লে ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবণতা বাড়বে। বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিও। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, মায়ানমারের উচ্চচাপ বলয় আর পশ্চিমি ঝঞ্ঝা তৈরি হওয়া বা না-হওয়াও নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যের উপর। যেভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে প্রবল, অতি প্রবল‌, সুপার সাইক্লোনের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে, বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও। সতর্ক হতে হবে আমাদের।