বেশ কিছুদিন হল বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য চলছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে যে ফলাফল হল, তাতে বিজেপি এককভাবে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে পারেনি। তার জন্য বিজেপি নেতৃত্বকে নির্ভর করতে হল বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের সমর্থনের ওপর। বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, আরএসএস গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বিজেপির হয়ে প্রচার কাজে নামেনি বলে লোকসভার ফলাফল আশানুরূপ হল না। বিজেপি নেতাদের এই উপলব্ধি হল দলের ফলাফলে।
আরএসএস এবং বিজেপির মধ্যে এই শৈত্য কাটাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সর্বপ্রথম আরএসএসের সদর দপ্তর নাগপুরে গেলেন সংঘের প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে আলোচনা করতে। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি একবার নাগপুরে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান সংঘ সভাপতি এবং সর্বপ্রথম সংঘ পরিচলকের স্মৃতিতে যে আরএসএসের একশো বছর পূর্তি হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘এই শতবর্ষের যাত্রা গৌরবময়’। যে বীজ একশো বছর আগে রোপণ করা হয়েছিল, তা এখন অক্ষয়-বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।’ আরএসএস এখন একটি পরাক্রমশালী সংগঠন, বললেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে প্রধানমন্ত্রী ও মোহন ভাগবতের দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন সংঘ এবং বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে। বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হওয়ার জন্য— এখন পর্যন্ত বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচন পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান সভাপতি জে পি নাড্ডার সময়কাল শেষ হলেও, তিনি এখন অস্থায়ীভাবে কাজ চালাচ্ছেন। তিনি এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। কে বিজেপির সভাপতি হবেন, তা নিয়ে নানা নামই আলাচনায় রয়েছে। কিন্তু সংঘের পছন্দ না হলে কাউকে সভাপতির পদে বসানো যাবে না। বিজেপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন সভাপতির পদে এমন একজনকে নির্বাচিত করতে হবে, যিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কোনও বিষয়ে চ্যালেঞ্জ জানাবেন না। আবার সংঘ চাইছে এমন একজন সভাপতি, যিনি আগামী নির্বাচনগুলিতে দল যাতে সাংগঠনিকভাবে শক্তিসালী হয়ে ওঠে, তার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। রাজনৈতিক মহল মনে করে নরেন্দ্র মোদী ও মোহন ভাগবতের মধ্যে এই বৈঠক বিজেপি এবং আরএসএসের মধ্যে সব বিরোধ থাকলেও হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লির নির্বাচনে সংঘের কর্মী-সমর্থকরা প্রাণপণে খেটেছেন— যার জন্য বিজেপি এই তিন রাজ্যেই জয়ী হয়েছে। হরিয়ানায় সংঘের কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে বিজেপির প্রার্থীদের হয়ে প্রচার চালিয়েছে। মহারাষ্ট্র ও দিল্লিতেও আরএসএস কর্মীরা বিজেপির প্রার্থীদের প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব তা স্বীকারও করেছেন।
এদিকে সর্বভারতীয় স্তরে যেমন বিজেপির সভাপতি নেই— তেমনই পশ্চিমবঙ্গেও এই দলের পূর্ণ সময়ের জন্য কোনও সভাপতি নেই। সুকান্ত মজুমদার একাধারে বিজেপির সাংসদ আবার অস্থায়ীভাবে সভাপতির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সর্বভারতীয় স্তরের বিজেপির নেতারা পশ্চিমবঙ্গের জন্য কাকে সভাপতি করা যায়, তার জন্য নেতা বাছাই পর্ব চলছে। এই রাজ্যে সভাপতির দৌড়ে রয়েছেন এই দলেরই প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। কিন্তু রাজ্য বিজেপির নেতাদের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব— যে কারণে দলের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। উত্তরবঙ্গে বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি প্রবল ছিল। কিন্তু সেখানেও বিজেপির নেতাদের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাবের জন্য আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এই দল ভালো করবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিজেপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব থাকাতে তৃণমূল কংগ্রেস তার হারানো জমি পুনরুদ্ধার করছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই যখন অবস্থা, তখন দলের সর্বভারতীয় নেতারা ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রস্তুতির কাজ এখন থেকেই শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও রাজ্য বিজেপি কর্মী ও নেতাদের নির্বাচনের জন্য সর্বস্তরে প্রচারের কাজ চালানোর কথা বলেছেন। কিন্তু যে দলের সভাপতিই নেই, সেই দলকে নির্বাচনের জন্য পরিচালনা করবে কে? তবে আরএসএসের তরফ থেকে বলা হয়েছে— বিজেপির একার পক্ষে এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। তাই ছাব্বিশের নির্বাচনে আরএসএসের কর্মীরাও দলের হয়ে প্রচারে নামছেন। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবার এবারও সুর তুলেছন ২০২৬-এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে— যেমনটা ঘোষণা করেছিলেন গত বিধানসভা নির্বাচনেও। কিন্তু বিজেপির ঝুলিতে এসেছিল মাত্র ৭৭টি আসন। এখন আছেন ৬৯ জন। বাকিরা শাসক দলে। বিরোধী দলনেতাও দলের জয়ের কথা ঘোষণা করেছেন আগামী বিধানসভা নির্বাচনে। কিন্তু বিজেপি উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার ও রাজ্যের মানুষ ভালোভাবে নেবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে আরএসএসের তৎপরতায় খুশি প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বুঝেছেন আরএসএসের কর্মীদের সহযোগিতা ও সাহায্য ছাড়া নির্বাচনে জেতা খুব কঠিন। প্রধানমন্ত্রীর এই বোধদয় হয়েছে দিল্লি, মহারাষ্ট্র এবং হরিায়নায় দলের সাফল্যের কারণে। পশ্চিমবঙ্গেও এবার আরএসএসের কর্মীরা কোমর বেঁধে নির্বাচনের প্রচারের কাজে নামবে।