যাঁর কথা কেউ ভাবে না

অনুপম মুখোপাধ্যায়

তিনি ছিলেন ‘ভিখারি গবেষক’ প্রয়াত শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায়৷ হাওড়ার শালকিয়াতে বরাবরের বাস৷ রাজ্য সরকারি বাস ডিপোতে সরকারি চাকরি করতেন৷ অকৃতদার, তাই প্রতি মাসের মাহিনা থেকে নিজের খরচ ও সংশ্লিষ্ট পরিবার প্রিয়জনের জন্য চাহিদামতো যৎসামান্য খরচখরচা করে বাকিটা ওই রাস্তার ফুটপাতে, শ্মশান ঘাটে, ময়লা ফেলার ভ্যাটের পাশে ‘ভিখারি’ নামধারী যে মানুষগুলোকে সকাল থেকে সন্ধে পড়ে থাকতে দেখতেন তাদের একটুখানি ভালো খাবার, নিয়মিত খোঁজখবর রেখে একটু পরিচ্ছন্ন জীবনের দিকে এগিয়ে দেওয়ার দরকারে নিজের কাছের এক মহানুভব ডাক্তারের অনুষঙ্গে সংগৃহীত প্রাথমিক কিছু ওষুধপত্র সবই এগিয়ে দিতেন৷ পুরুষ, মহিলা কোনও বাদবিচার ছিল না৷ সকলের অবস্থাই ধীরে ধরে উন্মোচিত হত শ্যামবাবুর কাছে৷ কারণ এই শ্রেণির মানুষদের জন্য সত্যিকারের চোখের জল পড়ত শ্যামবাবুর বুকের ভেতর যা অন্য কেউ দেখতে পেত না৷ ক্রমাগতই রেল স্টেশন থেকে বা ভবঘুরেদের জন্য আতান্তরে যাওয়া একটি নির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করতে লাগল ওনার দৈনন্দিন মেলামেশার মধ্যে৷ এইভাবেই এই গবেষকের কাজের পরিধি গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল৷ দেখা গেল শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জীবনে প্রায় ১১ হাজার ওই রকম মানুষের দুঃখ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন৷ কোথা থেকে এত দুঃখের উৎস, কোথা থেকে এমন চরিত্রদের ছন্দহীনতাতে জীবন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল— এইসব দেখিয়েছিলেন ‘অ্যানাটমি অব বেগারি’তে আর করেছিলেন ‘ট্রিটমেন্ট অব বেগারি’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাফ সমাজের জন্য, সরকারের জন্য৷ আসলে উনি একটা বেগার রিসার্চ বু্যরো করে চালাচ্ছিলেন ওই সালকিয়ার অরবিন্দ রোডে যেখানে প্রতিদিন সকালে যখন ভাঁড়ে করে চা খেতেন তখন তাঁর চারপাশেতেও ছিন্নবস্ত্র পরিহিত কয়েকজন ঘিরে থাকত৷ তাদেরও চা পান চলত৷

একবার ভিখারিদের নিয়ে লালবাজার অভিযান পর্যন্ত করেছিলেন৷ মাঝপথে পুলিশের খোঁজাখুঁজি ও যাত্রাভঙ্গ৷ তাঁর লেখা পুস্তক ‘যাদের কথা কেউ বলে না’ বাংলা কথা সাহিত্যে একটি সংযোজন রূপে গণ্য হতে থাকবে৷ বলাবাহুল্য, এই প্রতিবেদক ওই পুস্তকটির উদ্বোধনকালে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার প্রকাশকের স্বল্প পরিসরের অফিসে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেছিলেন৷


যাই হোক, ‘যাদের কথা কেউ বলে না’ পুস্তকটিতে ৪৭ জন ভিখারির অনেকটা জবানবন্দিসুলভ কথোপকথন ধরা আছে৷ সব ক্ষেত্রেই শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রশ্নকর্তা ও উত্তর গ্রহীতা৷ বেশ কয়েকটি রচনা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন প্রথমটি— ‘তোকে তো ঘরে নেওয়া যাবে না’ এই শিরোনামে নটী বিন্দু জীবন কাহিনি৷ ঢাকা জেলার ঠাটারি বাজারের বড় ব্যবসায়ী পিতার মেয়ে, কম বয়সে বিয়ে সমান সমান অর্থ প্রতিপত্তিওয়ালা বাড়ির ছেলের সঙ্গে৷ ক্রমে জীবন ওলোটপালোট, এক জ্ঞাতি আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা, পালানো ও জীবন অন্যপথে চালিত হল অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে৷ জীবন সায়াহ্নে এখন সে প্রৌঢ়া৷ গানটান শুনিয়ে রোজগার করছিল৷ আদুরে মেয়ে—গৃহবধূ—বারাঙ্গনা থেকে ভিখারি বিন্দু৷ এইভাবে কত বলা যায় শিরোনামগুলি— ‘এককালে শ্রমজীবী তথা ভোটার— গঙ্গা বেনিয়া’,‘কমরেড আমি এখন ভিখারি—পঞ্চী’, ‘পেটে রাখলে গুণ, বার করলেই খুন—সুবলা’, ‘ঋদ্ধি সিদ্ধি কুছ নেই মিলা, খালি খাঁসি মিলা— হরিনন্দ সিং’ ‘সরকার টরকার কিছু পারবে না— গীতা’, ‘সাবিত্রীর স্বর্গযাত্রা— সাবিত্রী ডোম ওরফে কালিন্দী’, ‘স্বাধীনতার জন্য ভিক্ষা করেছি আগে, এখন পেটের জন্য ভিক্ষা মাঙছি— জ্ঞানদা হাটুই’, ‘যার কেউ নেই তার কোলকাতা— জগদীপ’, ‘সিপিএমকে ভোট দিতে, আর দেবে না— রতন’, ‘শুধু খাওয়া নয়, তিন চার টাকার ওষুধ লাগে রোজ—ভিক্ষে ছাড়া কে দেবে—মনোরঞ্জন’, ‘জান দেবো তবু জামা দোবো না— কাশীনাথ’ অথবা ‘ক্ষমতা পেলে সব হনুমান হয়ে যায়—নির্মলেন্দু তপাদার’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷

আফশোষের কথা পুস্তকটি তেমনভাবে প্রশাসন, বুদ্ধিজীবী বা সাধারণ পড়ুয়াদের মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারেনি৷ তবুও তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কর্তাব্যক্তি আশ্বস্ত করেছিলেন ‘ভিখারি’ বিষয়টাই আমাদের সামগ্রিক সমাজের একটা মাথাব্যথার কারণ৷ এদের সংখ্যা দৃষ্টান্তমূলকভাবে কম করতে হবে এদেরকে বিভিন্ন কল্যাণমুখী প্রকল্পের আওতায় এনে৷ আজ পর্যন্ত কতটা কী হয়েছে পথের পাশে বা বিভিন্ন পালা পার্বনে এদের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়৷ আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন জেলায় ভবঘুরে আবাস স্থলগুলি দেখলেই বোঝা যাবে আমরা এদের বিষয়ে কতটা সংবেদনশীল৷ এইসব অসম্পূর্ণতার কথা কিন্ত্ত শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গবেষণা চলাকালীন বিভিন্ন সভা সমিতিতে বলেছেন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য৷
আদপে শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওঁর পুস্তকখানি ‘যাদের কথা কেউ বলে না’ প্রায়ই সমার্থক কারণ যে বিপুল সংখ্যক ভিখারিদের মনস্তাত্ত্বিকতার গভীরে ঢুকে দুঃখের উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্তত মনে হওয়া ৪৭ জনকে স্থান দিয়েছেন পুস্তকটিতে এবং এই ৪৭ জনই সমগ্র ভিখারি চিত্রটিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বলে মনে হয়েছিল ওনার৷ দেখা গেল, এক বৃদ্ধ ভোট দিয়ে এসেই ভিক্ষা করতে শুরু করল৷ সে অবশ্যই valid voter ছিল৷ আরেকজনের কথা ‘হ আমি যামু রাইটাস বিল্ডিং৷ আপনি ঠিক করলে, আমি কইবো গরিব ভিখারিগো কথা সেহানে৷’ ‘রন ফ্রিমায়ার’ নামে ক্যালিফোর্নিয়ার এক যুবক কিছু পুঁজি নিয়ে বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরছেন যখন কলকাতায় এলেন তখন তার পঁুজিতে টান ভিখারি সুলভ দিনযাপনের অভিজ্ঞতা ও সঙ্গে ভারতীয়দের জীবনশৈলি ইত্যাদিও ভাগ করে নিয়েছিল শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র থেকে বা বলা যায় যোগাযোগের দৌলতে৷

এরপরও একাধিক চরিত্র সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেমন জনৈক ননীবালার উক্তি— ‘ইজ্জত দিয়ে আমি ভাত খাতি চাই না’৷ ‘কুড়িয়ে খাই কিন্ত্ত ভিখারি নই’ দয়াময়ের উক্তিতে৷ কিংবা খোঁড়া রতন যেমন বলেছিল— ‘সিপিএমকে ভোট দিত, আর দেবে না—’৷ অর্থাৎ এই সব উক্তি, স্বগতোক্তির ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা মাখানো জীবনচক্রগুলো বোধহয় কিছু প্রশ্নের অবতারণা এমন করে চলেছে যেগুলির উত্তর আমরা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে দেখতে গিয়েই থমকে থমকে দাঁড়াচ্ছি, আমাদের কণ্ঠস্বর যেন সোচ্চারে উপস্থাপন করতে পারছে না৷ আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিতে যে চরিত্রগত ভুল, ত্রুটি, অন্যায়গুলি আছে সেগুলিকে চিরতরে নির্মূল করার থেকে কেমন যেন সবাই পাশ কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি, ভাবছি আমার জায়গাটা সিকিয়োর্ড থাকছে তো! তাই তো, একমুখ দাড়ি, কোঁচকানো সাদা ফুল হাতা শার্টের ভিতর যে দুর্জয় ইচ্ছাটা ঘুরপাক খেতে থাকত তা বোধহয় কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা, ইংরাজি, হিন্দি সংবাদপত্রগুলি ছাড়িয়ে ইন্ডিয়া টুডে, সানডে, সানডে অবজার্ভার, সানডে মেল, ওম্যান অবজার্ভার (জর্ডান), খালিজ টাইমস (দুবাই), সানডে ফোকাশ (হংকং), কলকাতা দূরদর্শন প্রভৃতিতে ছুঁতে পেরেছিল৷ না হলে বিবিসি’র মার্ক টুলি দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত মাটির ভাঁড়ে করে কয়েকবার চা পানের ফাঁকে ফাঁকে ‘যার কথা কেউ ভাবে না’র একটা সম্পূর্ণ ছবি অাঁকছিল গভীরভাবে কীভাবে!