প্রবীর মজুমদার
যখনই কোনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার নিজেদের সবকিছুর উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে, তখনই ভারতবাসী সেই সরকারি দলকে রীতিমতো শিক্ষা দিয়ে দেন। এইবারের নির্বাচন দেখিয়েছে, ‘অহমিকার পতন অনিবার্য’। এ কথা অনস্বীকার্য, কেন্দ্রের মতো এ রাজ্যেও বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে শাসক-বিরোধী কোনও সদর্থক শক্তির উঠে আসা প্রয়োজন ছিল। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রয়োজনে যত না, তার চেয়েও বেশি করে যে কোনও ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিসরে ফ্যাসিবাদী একটি দলকে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে দেখা, সব সময়েই আশঙ্কার। কেন্দ্রে যেমন কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়তে গিয়ে সেই কংগ্রেস দলকেই এখন উপযুক্ত সম্মান সমেত মোদি-শাহ-নাইডু-নীতিশের সরকারকে লোকসভায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে মেনে নিতে হবে, তেমনই, ২০১১-পরবর্তীতে বিরোধী-শূন্য বাংলা গড়তে গিয়ে বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নীতির কারণেই রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিসরে বিরোধীদের শূন্যস্থান বিজেপির দ্বারা পূর্ণ হয়েছে। সেই সঙ্কটের নৈতিক দায় তৃণমূল কংগ্রেসকেই বহন করতে হবে। ২৯টি লোকসভা আসনে জিতে, অথবা বিধানসভা নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একার ক্ষমতায় জিতে এসে, সেই সমস্যার সমাধান হবে না। পরিবর্তে কোনও না কোনও দিন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মতো পশ্চিমবঙ্গের জনতা যখন তৃণমূল সরকারেরও বিরোধী হয়ে উঠবে, তখন প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি-রই এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসা সুনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এ তো গেল শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বিরোধী আসন থেকে হটাতে এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ অন্য বিরোধীরাও কি সঠিক আচরণ করেছেন? প্রথমেই যে প্রসঙ্গটি উঠে আসবে, তা হল চাকরি-দুর্নীতির প্রসঙ্গ। নিঃসন্দেহে যে চরম দুর্নীতির আশ্রয় বাংলার শাসকদল নিয়েছে ও সেই লুন্ঠিত সম্পদের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে। তার বিরুদ্ধ রায়ের প্রভাব ভোটবাক্সে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু পড়েনি। তার প্রধান কারণ হল, বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ‘সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ রায়, ও তার পূর্ববর্তী সময়ে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক পদক্ষেপ। বিচারপতি দেবাংশু বসাকের রায় ‘সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এ-কথা বলার কারণ, রায়দানের অন্তত চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সংবাদমাধ্যমে কার্যত রায়ের সারাংশটুকু অবিকল উল্লেখ করে বসেন। সেই থেকেই যে কোনও রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মনে এই রায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগবে।
তাছাড়াও, আধুনিক আইনের প্রথম শর্ত বলে, “বিচারের প্রধান উদ্দেশ্যই হল অপরাধী যদি বা শাস্তি নাও পায়, তবুও, একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে বিনা দোষ অভিযুক্ত না হয়— তা সুনিশ্চিত করা।” বিচারপতি বসাকের রায় আধুনিক আইনের এই প্রথম শর্তটিকেই লঙ্ঘন করে। ৫০০০ জন প্রমাণিত ভুয়ো পরীক্ষার্থীকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তিনি কোনও ধরনের প্রমাণ ছাড়াই আরও ১৪-১৬ হাজার জনের চাকরি বাতিল করেন, তদুপরি ‘দাগি আসামী’র মতোই সুদসমেত তাদের বেতন ফেরতেরও নির্দেশ দেন। শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ এভাবে ফেরত নেওয়া যায় কিনা, তাই নিয়েই আইনি বিতর্ক রয়েছে, তদুপরি, ১৪-১৬ হাজার জন মানুষকে প্রমাণ-ব্যতীত এইভাবে অভিযুক্ত করায় বিচারব্যবস্থার প্রাথমিক দর্শনই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এরই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রাক্তন বিচারপতি, তথা চাকরিপ্রার্থীদের এককালের ‘মসিহা’ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপিতে যোগদান, বিচারবিভাগীয় ‘নিরপেক্ষতা’র গোটা বিষয়টাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এবং চাকরি-দুর্নীতির বিষয়টি নির্বাচনী-ইস্যু হয়ে উঠতে সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়।
একেই এবারের ভোট সারাদেশেই বিজেপি-বিরোধী ভোট হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তার উপরে এভাবে ‘নির্দোষ’ মানুষকে ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্যে ‘ক্ষমতা’র কাঠগড়ায় তোলা মানুষ ভাল চোখে দেখেনি। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে শাসক-বিরোধী বাম অথবা কংগ্রেস দল, তাঁরাও শুরুতে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহত্ব’ প্রচারেই কেবল সহায়তা করেননি, তদুপরি পরবর্তী ক্ষেত্রে চাকরি-দুর্নীতির বিষয়ে একাধিক সামাজিক-রাজনৈতিক মঞ্চে, ‘চাকরিপ্রার্থী’দের পাশে থাকতে চাই, এই অজুহাতে বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। শুরু থেকেই যদি বাম-কংগ্রেস রাজনীতিকেরা এককভাবে এই চাকরি-দুর্নীতির বিষয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন করতেন, তাহলে হয়তো এই আন্দোলনের রাশ কিছুটা হলেও তাঁদের হাতে থাকতে পারত এবং বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ‘সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ রায়ের বিরুদ্ধে যে জনরোষ, তার ভাগ অন্তত তাঁদেরকেও ভোটবাক্সে বইতে হত না।
দ্বিতীয়ত উঠে আসবে সন্দেশখালির ঘটনা। সন্দেশখালির বিস্তীর্ণ অংশে শেখ শাজাহানের নেতৃত্বে যে একাধিক বা অজস্র বেআইনি কার্যকলাপ চলেছে, সে-কথা তৃণমূল-নেতৃবৃন্দও স্বীকারে বাধ্য হয়েছেন। যদিও মহিলাদের উপরে অত্যাচার হয়েছে বলে রাজ্যের শাসকনেতারা এখনও অবধি মানতে অস্বীকার করেন। এতদসত্ত্বেও, যেটুকু বেআইনি ঘটনার প্রমাণ বিরোধী তথা বিজেপি নেতাদের হাতে ছিল, কেবল সেইটুকুকে ভিত্তি করেই যদি তাঁরা প্রচার চালাতেন তাহলে হয়তো তাঁরা ভোটবাক্সে লাভ করতে পারতেন। কিন্তু যে-মুহূর্তে টাকার বিনিময়ে মিথ্যে প্রচারের ঘটনা জনসমক্ষে এসে পড়ল, সেই মুহূর্ত থেকে সন্দেশখালির আন্দোলনটিকে শাসকদলের তরফে ‘অসৎ’ হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করে দেওয়া গেল। এর দায়ও বিজেপি দলকেই বহন করতে হবে। সৌভাগ্য যে বাম অথবা কংগ্রেস, এই আন্দোলনের বিষয়ে শুরু থেকেই বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এলাকার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারের ভূমিকাও সদর্থক হিসেবে উঠে এসেছে। তবুও বিজেপির মিথ্যে প্রচারের দায় এখানেও ক্রমশ শাসকের ভোটব্যাঙ্ক সুনিশ্চিত করতেই সহায়তা করেছে।
দুর্ভাগ্য এই যে – সন্দেশখালির মহিলাদের উপর যদি সত্যিই অত্যাচার হয়ে থাকে— তাহলেও, মুষ্টিমেয় কিছু মহিলার তরফে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে টাকার বিনিময়ে মিথ্যাভাষণের ঘটনা কোনওভাবে সামনে আসতেই, গোটাগুটিভাবে সকল প্রতিবাদী মহিলারই ‘সততা’র উপর সহজেই প্রশ্ন তুলে দেওয়া গিয়েছে। সামাজিক পরিসরে এমনটা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ঠিক যেভাবে প্রমাণ ছাড়াই ১৬ হাজার চাকরি বাতিলের ঘটনা, চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের উপর থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে, এমনকি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েও দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্ন তোলার পরিসর উন্মুক্ত করে দিয়েছে, একইভাবে সন্দেশখালির ‘মিথ্যাপ্রচার’ সত্যকারের নির্যাতিতা নারীদেরও দীর্ঘমেয়াদে বিচারপ্রাপ্তির বিষয়টিকেও একেবারেই অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। ভোটদখলের প্রয়োজনে ‘বিজেপি’ নামক রাজনৈতিক দল, এমন একাধিক দুষ্টকর্মের মাধ্যমে রাজ্য তথা দেশের সামাজিক, গণতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরকে যে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তার হিসেব কষতেই এখন বহু বছর লেগে যাবে বলে বোধ হয়।
সবশেষে আসা যাক ভর্তুকি প্রকল্পগুলির প্রসঙ্গে। ভোট-রাজনীতি এবং সাধারণ অর্থনীতির প্রশ্নে অবশ্যই ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা এমন ভর্তুকি-সমতুল প্রকল্পগুলিকে অন্যভাবে দেখা প্রয়োজন। দারিদ্র্য-দূরীকরণের প্রশ্নে সাধারণ গরিব মানুষের হাতে সরাসরি ব্যয়ের প্রয়োজনে অর্থ তুলে দেওয়ার বিষয়টি অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই স্বীকৃত। একাধিক বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, যথা অধ্যাপক জন মেইনার্ড কেইনস, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশেষত কল্যাণকর অর্থনীতির বিষয়ে তাত্ত্বিক বরিষ্ঠজন হিসেবে যাঁরা সারা বিশ্বে সম্মানিত, তাঁরা প্রত্যেকেই গরিব মানুষের হাতে এভাবে টাকা তুলে দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করেছেন। এভাবে সরাসরি জনগণের হাতে অর্থ দিলে তাহলে অর্থনীতির উন্নতি কীভাবে সম্ভব? সহজ করে যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, কোনও দেশে যদি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়— তার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদন কমে আসা। এই উৎপাদনের ক্ষমতা কিন্তু গরিব মানুষের হাতে থাকে না। তাঁরা কেবল উৎপাদনের প্রয়োজনে শ্রম দিয়ে থাকেন।
এখন উৎপাদন কমে আসার অর্থ হল, সেই শ্রমের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসা। অর্থাৎ, গরিব মানুষের আরও বেশি করে অর্থোপার্জনের উপায় কমে আসা। এর ফলে গরিব মানুষের হাতে অর্থের জোগান কমবে— ফলস্বরূপ যে কোনও ধরনের উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা ক্রমশ আরও কমে আসবে। ফলাফল হিসেবে উৎপাদন আরও তাড়াতাড়ি, আরও বেশি করে কমতে শুরু করবে। জনগণ আরও গরিব হতে থাকবে। অর্থাৎ এই বৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ক্রমশ অর্থনীতি দুর্বল থেকে আরও দুর্বলতর হয়ে পড়বে। এর বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানোর সমাধান কোথায়?
সরাসরি যদি জনগণের হাতে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তাহলে আবারও সামান্য করে হলেও কিছু উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা বাড়বে। শ্রমের প্রয়োজন বাড়বে। উৎপাদন বাড়ার অর্থই হল কর্মসংস্থান। অর্থাৎ আবারও সেই বৃত্তীয় পথেই অর্থনীতির শ্লথ উত্তরণ সম্ভব হবে। এমন বৃত্তীয় পথে উত্তরণ অথবা অবতরণ কোনওটিই সহজ বা চটজলদি বিষয় নয়। কিন্তু কোভিড-সময়ের অনেক আগে থেকেই গোটা ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক জায়গাতে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কোভিড-পরবর্তীতে কল্যাণকর অর্থনীতির এই পথ বেছে নেওয়া ভিন্ন উপায় ছিল না। কাজেই কোনও একটি নির্দিষ্ট দল নয়, শাসক হিসেবে প্রত্যেক দলই এমন নানাবিধ কল্যাণকর নীতির ব্যবহার শুরু করেছিল এবং বিরোধী দলগুলিও রাজনৈতিক প্রচারে এমন কল্যাণকর অর্থনীতির প্রয়োগকেই তাদেরও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছিল। এই প্রশ্নে আবারও উল্লেখ করব, এইভাবে সরাসরি অর্থদান দীর্ঘমেয়াদে সমাধান নয়। কিন্তু খাদের কিনারায় চলে যাওয়া অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সম্ভবত এই প্রক্রিয়ার সাহায্য নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। অন্তত বিশ্ববরেণ্য একাধিক অর্থনীতিবিদ এই যুক্তিতেই তাঁদের বহুল-প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সাজিয়েছেন।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই অর্থ একেবারে সরাসরি হাতে তুলে না দিয়ে কোনওভাবে কি সামান্য কোনও প্রতীকী শ্রমের বিনিময়ে দেওয়া যেত না? যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষটি অন্তত নিজেও সেই অর্থকে ‘সাহায্য’ অথবা ‘অনুদান’ না ভেবে ‘অর্জন’ ভাবতে পারত? আমাদের রাজ্য তথা দেশের বিরোধী শাসিত কয়েকটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নের জবাবে সরাসরি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাবের কথা চলে আসে। গোটা দেশে ডঃ মনমোহন সিং কর্তৃক ‘জীবিকার অধিকার’ প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিক এভাবেই ‘অনুদান’কে ‘অর্জন’ হিসেবে প্রদান করা শুরু হয়েছিল। সেই প্রকল্প আমাদের কাছে ১০০ দিনের কাজ নামে পরিচিত। ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে দেশের জিডিপি বাড়ে না। গ্রামীণ এলাকায় কিছু পরিকাঠামোগত উন্নতি হয় কেবল। তবুও অর্থনীতির অধ্যাপক ডঃ সিং, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বাজেট-ভর্তুকি দিয়ে হলেও এই প্রকল্প চালাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কারণ সাধারণ, গরিব মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনো সবসময়ে প্রয়োজন। সেই টাকাই পরবর্তীতে বৃত্তীয়-উপায়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে চলতে সক্ষম হবে। এর পাশাপাশিই গরিব সাধারণ মানুষ সেই ‘উপার্জন’কেও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করতে শিখবে।
কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে মোদি-সরকারের অব্যবস্থা ও পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ কোভিডের কারণে অর্থনীতির অবস্থা একেবারে তলানিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে লক্ষীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের যথেষ্টই যৌক্তিকতা উঠে আসে। একথাও উল্লেখ করা উচিত, লক্ষীর ভাণ্ডার ছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত ‘শ্রী’ প্রকল্পগুলি রয়েছে, সেগুলির অনেক ক-টির ক্ষেত্রেই কিন্তু অর্থের বিনিময়ে শিক্ষালাভ অথবা বিবিধ পরিসরে শ্রমের শর্ত যুক্ত রয়েছে। কাজেই সেই প্রকল্পগুলিকেও সরাসরি অনুদান বলা চলে না। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-কে অনুদান বললেও, ভেবে দেখা উচিত, মাসপিছু হাজার টাকায় গ্রামীণ একটি পরিবারে ঠিক কতখানি সাহায্য সম্ভব, সে কথা সত্যিই কলকাতায় বসে থাকা আমরা হয়তো চিন্তাও করে উঠতে পারি না। খুব সহজে যদি বলতে চেষ্টা করি আবারও, অন্তত এক সিলিন্ডার গ্যাসেরই দাম এখন ১০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেইটুকুরও যদি ‘লক্ষীর ভাণ্ডার’-এর মাধ্যমে সাশ্রয় হয়, আমরা কি সেই বিষয়টিকেও আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তসুলভ চপলতায় এক কথায় আকাশে উড়িয়ে দিতে পারি? বোধহয় পারি না একেবারেই।
শহুরে মধ্যবিত্তের পক্ষে অবশ্য প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতি কেন, অনেক সময় মোদির সরাসরি ধর্মীয় রাজনীতির বিদ্বেষ বোঝাও শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে, গ্রামীণ ভারত ঢেলে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিলেও, দিল্লি অথবা বেঙ্গালুরুর মানুষ সেই বিভাজন-রাজনীতিতেই আস্থা রেখে চলে। কাজেই তাঁদের থেকে অধিক বিচক্ষণতা আশা করব না। কিন্তু ভুলটুকু শিখে নেওয়ার মানসিকতা থাকা উচিত।
রাজ্যের বিজেপি নেতারা অধিকাংশ সময়েই কুৎসিত ভাষায় এই ‘ভিখারি’- মার্কা আক্রমণে নেমেছেন। কিন্তু সত্যিই অবাক বোধ হয়, বাম-কংগ্রেসি সমর্থকদের একাংশও সামাজিক মাধ্যমে সেই সুরে সুর মিলিয়েছেন। এই কারণেই ভোট-রক্তক্ষরণ তাদেরও অব্যাহত। সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য সরাসরি বলেছেন, যাঁরা সামাজিক মাধ্যমে ‘লক্ষীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প নিয়ে কুৎসিত প্রচার চালিয়েছে বা চালাচ্ছে, তারা সিপিএম দলের সদস্য হিসেবে বিবেচিত নয়। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, বাম রাজনীতিকে সমর্থন করুন, কিন্তু এমন উগ্র সমর্থন বামপন্থী আদর্শের সঙ্গে কোনওভাবেই সমধর্মী নয়।
বাম কর্মী-সমর্থকদের মনে রাখতে হবে, রাজ্যের প্রয়োজনে তাদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসা, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে তাদের প্রধান বিরোধী মুখ হিসেবে উঠে আসা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এখন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সামান্যতম পদস্থলন রাজ্যের গণতন্ত্রের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের দল আইএসএফের সঙ্গে জোট বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি। এবারের লোকসভা ভোটে আইএসএফ কেবল যে আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাই নয়, একাধিক আসনে আপনাদের চেয়েও বেশি ভোট পেয়ে আপনাদেরই ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছে।
ইতিপূর্বে, আপনাদেরই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাম অথবা তৃণমূল-বিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপির ঝুলিতে গিয়ে পড়তে পেরেছিল। তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক স্বীকার করেছিলেন, ‘বামের ভোট রামে’ অথবা ‘আগে রাম পরে বাম’ তত্ত্ব আদতে বাম-রাজনীতির পক্ষেই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বামপন্থী আদর্শের কোনও দল কেনই বা বিজেপি অথবা আইএসএফের মতো সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের দলের সঙ্গে নিজেদের কোনওভাবে একাত্ম হতে দেবে?
পাশাপাশি অন্যান্য বাম-গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির কাছেও প্রশ্ন রাখতে চাইব, রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিসরে সরকারিভাবে বিরোধী কণ্ঠস্বর যখন ফ্যাসিবাদী শক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে, তখন রাজ্যের প্রয়োজনে, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে, ফ্যাসিবাদ বিনাশের প্রয়োজনে বৃহত্তর বাম-ধর্মনিরপেক্ষ জোট তৈরির ক্ষেত্রেও আপনাদের সদর্থক ভূমিকা নিতে কেন দেখা যাচ্ছে না? সঠিক আদর্শের উপরে ভিত্তি করে সার্বিক ঐক্যের চেয়ে যে বড় শক্তি নেই, একথা আর কতবার সমাজ আপনাদের স্মরণ করাবে?