• facebook
  • twitter
Saturday, 11 January, 2025

মোদীর ভারতে মিডিয়ার স্বাধীনতা কোথায়

এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা সুদিনের আশা করতেই পারি। যাঁরা দেশ চালান, তাঁদের মনে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসবে, এমনটি ভাবি না। কিন্তু গণতন্ত্রে অবাধ ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কী ভূমিকা রয়েছে, তা তাঁরা উপলব্ধি করবেন, এটা আশা করা যেতেই পারে। তবে একটা কথা বলা যায়, যতই আর্থিক প্রতিকূলতা থাক, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এখনও তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে, নির্ভীক সাংবাদিকরা তাঁদের মতো করে খবর লিখে যাবেন, তা সরকারের পছন্দ হোক, বা না হোক, যাই হোক না কেন।

ফাইল চিত্র

পুলক মিত্র

নতুন বছরের শুরুতেই বিজেপি শাসিত রাজ্য ছত্তিশগড়ে খুন হয়ে গেলেন আরও একজন সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকার। বিভিন্ন চ্যানেলে চুক্তি ভিত্তিক সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন মুকেশ। তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলও ছিল। তিনি মূলত সরকারি দুর্নীতি, আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন, মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কিত খবর করতেন ৩৬ বছরের এই তরুণ সাংবাদিক। বিজাপুরের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হলেও, তাঁর খবরের সূত্রে বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন মুকেশ।

একটি রাস্তা তৈরিতে দুর্নীতি নিয়ে খবর করায় সম্প্রতি তাঁকে ঠিকাদারের হুমকির মুখে পড়তে হয়। ১ জানুয়ারি থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। এর ২ দিন পর একটি নির্মীয়মান বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে মেলে তাঁর মৃতদেহ।

সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের কথা আমরা জানি, যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। গৌরী খুন হয়েছিলেন ২০১৭-র ৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর খুনিরাও ইতিমধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। অভিযুক্তদের বীরের সম্মান দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল আরএসএসের হিন্দুত্ববাদীরা।

গৌরী বা মুকেশ নন, নির্ভীকভাবে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তে সাংবাদিক খুনের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনই তাঁদের হাজতবাস বা হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।

এসে গেল আরও একটি নতুন বছর। ২০২৫ সালে কি পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে? ভালো কিছু আশা করতে ক্ষতি কী। কিন্তু অবস্থার যে খুব বেশি বদল হবে, তেমনটি আশা করা বাতুলতা মাত্র। মূলধারার মিডিয়া যেভাবে শিরদাঁড়া বিকিয়ে দিয়েছে, তাতে সাংবাদিকদের পক্ষে খুব একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।

নববর্ষের প্রাক্কালে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ওই রাজ্যের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ২০২৩-এর মে মাস থেকে মণিপুরে যা কিছু ঘটেছে তার জন্য তিনি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। তাঁর কথায়, “আমি প্রকৃত অর্থেই অনুতপ্ত এবং আমার সমস্ত রাজ্যবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি।” এরপরই তাঁর সংযোজন, “যা কিছু ঘটার ঘটে গিয়েছে। অতীতের ভুলের জন্য আমাদের ক্ষমা করুন এবং সবকিছু ভুলে আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।” মণিপুরের মানুষ কি সরকারকে ক্ষমা করতে পারবেন? সবকিছু কি তাঁরা ভুলে যেতে পারবেন? বিগত ২০ মাসে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। জাতিদাঙ্গায় উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রীর এই ক্ষমা চাওয়া নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রথম সারির সংবাদপত্রে কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। বলতে গেলে, ক্ষতে দেওয়ার পক্ষে এই ক্ষমাপ্রার্থনা যথেষ্ট নয়? আর এত দেরিতে বোধোদয় কেন?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মণিপুরে হিংসা বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। মুখ্যমন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তিকে বড়জোর সূচনা বলা যায়, কিন্তু যথেষ্ট নয়।

এছাড়া, উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য শান্তির পথে ফিরছে, এই বার্তার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে বালির মধ্যে মুখ লুকোচ্ছে। বীরেন সিংয়ের সমালোচনা প্রাপ্য। কিন্তু মণিপুরের হিংসায় কেন্দ্রীয় সরকারের নীরব দর্শকের ভূমিকা কি উপেক্ষা করা যেতে পারে?

কেন্দ্র ওই রাজ্যে হিংসার মোকাবিলায় শুধু চরমভাবে ব্যর্থই হয়নি, সেইসঙ্গে একে যেভাবে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা আখ্যা দিয়েছে, তা দায়সারা মনোভাব ছাড়া কিছুই নয়। পক্ষপাতদুষ্ট দলীয় রাজনীতির কুৎসিত খেলার কারণে যে এই ধরনের লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, তা মানতেই চায়নি কেন্দ্র। দেড় বছরের সময় ধরে দেশের একটি রাজ্য হিংসায় জ্বলছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যও সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। শুধু তাই নয়, তাঁর মৌনতাও বিস্মিত করেছে দেশবাসীকে। মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সত্যিই বিস্ময়কর।
২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা কমে আসায় আশা করা গিয়েছিল, জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি কেন্দ্রীয় সরকার ও এর নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় সামিল হবে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু ঘটেনি। মনে হয়, জাতীয় সংবাদপত্রগুলি তাদের শিরদাঁড়া হারিয়ে ফেলেছে, যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও একটি বিষয় হল, সম্প্রচার পরিষেবা বিল এখনও আটকে রয়েছে। মূলত সরকারের বিরুদ্ধে এখনও সরব থাকা কিছু অনলাইন পোর্টালকে বাগে আনতেই এই বিল তৈরি করা হয়েছে।

যে সব সাংবাদিক এখনও পর্যন্ত স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, তাঁদের কি হুমকি, গ্রেফতার, বা আয়কর হানার মতো কঠোর পীড়নের মুখে পড়তে হবে? বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত সেরকম আশঙ্কাই দানা বাঁধছে। সরকারের ভাবনায় পরিবর্তন আসবে, এমনটি আমরা আশা করতেই পারি, কিন্তু সম্প্রচার বিল সে ধরনের কোনও বার্তা নেই।

এখনও সাত জন সাংবাদিক কারাগারে বন্দি। তাঁদের বেশিরভাগই জম্মু ও কাশ্মীরের। ৫ বছর বন্দি থাকার পর ছাড়া পেতেই ‘কাশ্মীর ন্যারেটর’-এর প্রাক্তন সম্পাদক আসিফ সুলতানকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে।

২০২২-এ গ্রেফতার হয়েছিলেন ‘কাশ্মীরওয়ালা’র সাজাদ গুল। গত বছরের অক্টোবরে জামিনে ছাড়া পান। মজিদ হায়দরি ও ইরফান মেহরাজ এখনও জেল বন্দি।

কেন্দ্র শাসিত এই অঞ্চলে নির্বাচন হলেও, ওমর আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে তেমন কিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। ওমরের হাতে ক্ষমতার কর্তৃত্ব নেই। তিনি কার্যত ক্ষমতাহীন। রাজভবন এবং মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় কার্যত পৃথক ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মূল লাগাম রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।

বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে ১৭১টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০২ নম্বর স্থানে। মোদী সরকার আগে এই রিপোর্টকে নস্যাৎ করে এলেও, এখন অন্য কৌশল নিয়েছে। এখন কেন্দ্র নিজেদের মতো করে র‍্যাঙ্কিং তৈরির কৌশল নিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদীর ভারতে সাংবাদিকদের শুধু পেশাগত স্বাধীনতা নয়, বিপন্ন তাঁদের জীবনও। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার গত বছর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৫৯ নম্বরে। এই তালিকায় ভারতের চেয়ে উপরে রয়েছে পাকিস্তান। তাদের স্থান হয়েছে ১৫২তে।

এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা সুদিনের আশা করতেই পারি। যাঁরা দেশ চালান, তাঁদের মনে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসবে, এমনটি ভাবি না। কিন্তু গণতন্ত্রে অবাধ ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কী ভূমিকা রয়েছে, তা তাঁরা উপলব্ধি করবেন, এটা আশা করা যেতেই পারে। তবে একটা কথা বলা যায়, যতই আর্থিক প্রতিকূলতা থাক, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এখনও তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে, নির্ভীক সাংবাদিকরা তাঁদের মতো করে খবর লিখে যাবেন, তা সরকারের পছন্দ হোক, বা না হোক, যাই হোক না কেন।