প্রবীর মজুমদার
শেষ হল বহুল বিজ্ঞাপিত, বহু চর্চিত, বহু দুর্ঘটনা কবলিত, বহু মানুষের মৃত্যুতে কলংকিত মহাকুম্ভ বরং বলা ভালো বিজেপির “মহাকুম্ভ”। শেষ হল জন্মজন্মান্তরের পাপ ধুয়ে ফেলার আশ্চর্য লগ্ন! যদিও এর আগেও নানা কুম্ভমেলাকে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছিল মহাকুম্ভ। যেমন, কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের ২০১৪ সালের ৩ নম্বর রিপোর্টেও ২০১৩ সালের কুম্ভমেলাকে বলা হয়েছিল মহাকুম্ভ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অবশ্য বলছেন, ২০০১ সালের কুম্ভই ছিল ১৪৪ বছরের মেলা। এদিকে বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ‘দ্য কুম্ভ মেলা’ বইতে ১৯৮৯ সালের কুম্ভমেলা নিয়ে লিখেছেন, সেবারের সাধুসন্তরা সেটিকে ১৪৪ বছরের যোগ মনে করতেন।
কিন্তু কী এই ১৪৪, যা নিয়ে প্রায় আক্ষরিক অর্থেই এত জল ঘোলা হচ্ছে? শুধু ঘোলা নয়, এবারের কুম্ভ মেলায় ভক্তদের স্নানের স্হানে জলের দূষণের মাত্রা নিয়ে ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল উত্তরপ্রদেশ দূষণ নিয়ন্ত্রক বোর্ডকে রীতিমত ভর্ৎসনা করেছে। ট্রাইব্যুনাল বলেছে, কোটি কোটি মানুষ দূষিত নর্দমার জলে স্নান করেছে । যে জল স্নানেরও অনুপযুক্ত, সেই জল তারা পান করছে। অদ্ভুতভাবে সোশাল মিডিয়ায় এত আলোচনা হয় গঙ্গা, যমুনা এবং অজ্ঞাত সরস্বতীর পৌরাণিকত্ব নিয়ে; অথচ তার সিকিভাগও হয় না গঙ্গা বা যমুনার ভয়ঙ্কর দূষিত অবস্থা নিয়ে।
মহা কুম্ভ মেলা হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের অংশ। হিন্দু পুরাণ মতে, দেবতা বিষ্ণু অমৃতের কলস দানবদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন, এবং এর কয়েক ফোঁটা পড়েছিল প্রয়াগরাজ, নাসিক, উজ্জয়িনী এবং হরিদ্বারে। সেই থেকেই এই স্থানে কুম্ভ মেলার প্রচলন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এখানে স্নান করলে পুণ্য লাভ হয় এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
খোদ উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং সেখানকার সাধুসন্তরা ঘোষণা করেছিলেন , এবারেরটাই ১৪৪ বছরের মহাযোগের মহাকুম্ভ মেলা। তিথি নক্ষত্রের অভূতপূর্ব সংযোগে অমৃতকুম্ভ পাপ ধুয়ে দেবে, মোক্ষ মিলবে। মোক্ষের বিষয়ে কতজন আগ্রহী জানা নেই, কিন্তু বহু বড়সড় ব্যক্তি যে পাপ ধুতে গেছেন তা এক রাত্রির লক্ষাধিক টাকার তাঁবু ভাড়াতেই বোঝা যায়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, অসুরদের কাছ থেকে দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত অমৃতকলস নিয়ে যাওয়ার সময়ে যাঁরা তাকে সাহায্য করেছিলেন সেই সূর্য, চন্দ্র, শনি ও বৃহস্পতি ১৪৪ বছর পরে পরে এই সারিতে আসেন, তখন সবকিছুই সম্ভব। অতএব পুণ্য করার এই অমোঘ সুযোগ কেউ ছাড়তে চাইছেন না। দেড়মাস ধরে চলতে থাকা মহাকুম্ভ নামক মহাযজ্ঞে মানুষ স্নান করতে গিয়ে ভিড়ের চাপে মরুক, রেলস্টেশনে হুড়োহুড়িতে পায়ের তলায় চাপা পড়ুক, তবু কুম্ভে যেতেই হবে। গ্রাম, শহর, সাক্ষর, নিরক্ষর, উচ্চশিক্ষিত – সবাই চলেছে কুম্ভপানে। ইস্কুলে ভাবা হচ্ছে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের মাঝে যদি ঘুরে আসা যায়, এপাড়া ওপাড়া থেকে বাস ছাড়ছে, কুম্ভের ওয়েবসাইট হাত জোড় করে বলছে আর জায়গা নেই, কিন্তু যেতে তো হবেই। খোদ এই বাংলায় ইদানীং এমন ভয়ানক ধর্মীয় উন্মাদনা বিশেষ দেখা যায়নি। তালিকায় কে নেই? ভক্তরা তো আছেনই, আছেন ছোট বড় মাঝারি বিভিন্ন মাপের নেতা, সরকারি, বিরোধী, বিপ্লবী, এমনকি ঘোর নাস্তিক। যুক্তিহীন এই জনসমুদ্রের কাছে একমাত্র লক্ষ্য বিশাল হোর্ডিং ‘পুণ্য ফলে, মহাকুম্ভ চলে’।
কুম্ভে বরাবরই জনসমুদ্র হয়। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো এই মেলাকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় জমায়েতের মর্যাদা দিয়ে এটিকে অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এবারের কুম্ভে এমন চূড়ান্ত অব্যবস্থা, মোক্ষাতুর মানুষের এমন নির্লজ্জ সম্পদ প্রদর্শন, এমন আগ্রাসী যাত্রীদল কি সত্যিই সেই ঐতিহ্য বহন করে? সবচেয়ে বড় কথা দফায় দফায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু, এখানে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের পরেও এ কোন বিবেকবর্জিত পুণ্যার্থী দল এই মৃতকুম্ভে দৌড়ে আসছে? প্রচারসর্বস্ব এই মেলায় ভিড় তৈরির দায়িত্ব কি কেউ নিলেন? মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বিপুল বিভ্রান্তি তৈরি করে সামান্য দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই কাজ শেষ! তারপর অতি দ্রুত রক্ত মুছে, লাশ সরিয়ে আবার স্নান, আবার টিকিট কাউন্টার খোলা। আবার এসো, পুণ্য করো।
এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা, ভয়াবহ মৃত্যু এবং তারপরেও চলতে থাকা মরণকুম্ভের দায় কার? দেশজুড়ে সংঘ পরিবারের রাজনীতি বহুকাল ধরে চলে আসা লোকায়তজনের কুম্ভমেলাকে নেহাত আস্থার বস্তু নয়, অধিগ্রহণ করেছে হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে। সঙ্গমে ডুব দিয়ে কার মোক্ষ লাভ হল কেউ জানে না, কিন্তু যে হিন্দু ভাবনা নাস্তিককেও ধারণ করে, তাকে করা হল সনাতন। সনাতন ধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদাররা এবারের কুম্ভমেলাকে বৃহৎ রাজনীতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র করে তুলেছে। ভিভিআইপি এবং কোটিপতিদের ডেকে এনে, মধ্যবিত্তের পুঁজি ভেঙে সরকারি কোষাগার থেকে সাহায্য দিয়ে মেলা হল। তাতে কোটি কোটি টাকা লাভও হল ছোট, বড় ব্যবসায়ীদের। ভারতীয় সংবিধানের কোথায় এই ব্যবস্থা লেখা আছে জানা নেই। কুম্ভে ডুব দিয়ে হিন্দু হল সনাতন, যার মূলে আছে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ।
তবুও ‘বিশ্বগুরু’ এবং তাঁর দোসর ‘সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী’ এই কুম্ভে সাধারণ মানুষকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলেন। যাঁরা এক রাতে এক লক্ষের পাঁচতারা তাঁবু নয়, যাঁদের দেখা গেছে ২৪ বছর আগেও একমাস ধরে দল বেঁধে গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে যেতে মাথায় পোঁটলা নিয়ে, তাঁরা যান লোকায়ত বিশ্বাসে। সেই বিশ্বাস ভাঙিয়ে, তাকে অশুচি করে গত এক দশক ধরে রাজনীতি চলছে। মানুষ কুম্ভে যেতেন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে, নিজস্ব বিশ্বাস থেকে। সেই যাঁদের কালকূট দেখেছিলেন ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ গিয়ে। সেই মানুষগুলিকে পুণ্যযোগের গপ্পো শুনিয়ে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে হত না।
এহেন শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় জমায়েতে এবছর ১৪৪ বছরের যোগ থাকুক বা না থাকুক, এমন বৈশিষ্ট্য আছে যা আগে কখনো কেউ ভাবতেও পারেনি। ভারতীয় সংস্কৃতির যে ঐতিহ্যকে হিন্দুত্ববাদীরা আকাশে তোলে সেটি হল ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। কিন্তু এবারের কুম্ভে ‘নানা ভাষা , নানা মত্, নানা পরিধান’-এর মিলিত সভ্যতার দেশে পড়শিদেরই ব্রাত্য করা হয়েছে, যা এককথায় অভাবনীয়। প্রস্তুতি পর্বেই হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন মহল থেকে মুসলমানদের মেলা থেকে বাদ দিতে বলা হয় । হিন্দু মালিকের গাড়ির মুসলমান চালক চলবে না। হিন্দু দোকানদারের মুসলমান কর্মচারী চলবে না। তীর্থে এই বিভাজন অবশ্য এর আগেই শুরু হয়েছে যখন শ্রাবণের কাঁওয়ারিয়া যাত্রায় হিন্দু ফল, মুসলমান ফল চিহ্নিত করতে হয়েছিল।
শেষপর্যন্ত কিন্তু এই বিষকুম্ভে অমৃতের স্বাদ মুসলমানরাই এনে দিয়েছেন। পুণ্যের লোভ দেখিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ, অর্থাৎ ভোটারদের, জমায়েত করার ভয়ানক পরিণতিতে পদপিষ্ট হয়ে মানুষ যখন মরছে আর দৌড়চ্ছে লাখো লাখো বিপন্ন মানুষ, তখন ‘এলাহাবাদ’ বাঁচাল ‘প্রয়াগরাজ’কে। তথাকথিত মহাকুম্ভ থেকে যে যেদিকে পারে ছুটেছে। প্রত্যেক মুসলমান মহল্লা মসজিদ, ইমামবাড়া, স্কুল, দরগা – সব খুলে দিয়েছে। নিয়ে এল শীতের কম্বল, পোশাক, খাবার আর দারুণ শীতের রাতে মাথার উপর চাঁদোয়া। ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে মানবতার কথা বলে, এ দেশ আবার তার প্রমাণ দিল। কুম্ভ থেকে যাঁদের সরিয়ে রাখা হল, সেই কুম্ভ নিজেই যেন তাঁদের কাছে এল।
লেখা শেষ করবো মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীতে কুম্ভমেলার প্রসঙ্গ উল্লেখ নিয়ে । সেই আত্মজীবনীতে একটি গোটা অধ্যায় লিখেছেন ১৯১৫ সালের হরিদ্বারের কুম্ভমেলা নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসার পর গান্ধী সেই মেলায় গিয়েছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলের ডাকে সেবার কাজে। কলকাতা থেকে ট্রেনে হরিদ্বার যাওয়ার ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর, আজও তেমন অভিজ্ঞতাই হচ্ছে মানুষের। আর দেখেছিলেন সাহারানপুর থেকে গরু ছাগলের মত গাদাগাদি হয়ে যেতে যেতে গরমে সিদ্ধ হয়েও হিন্দুরা জল খায় না, পাছে জল মুসলমানের হয়। অর্থাৎ সেদিন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দেখেছিলেন আজকের সাধুদের আগের প্রজন্মকে। তাঁরাও ভোগবাদী, যদিও আজকের মত এত দামি গাড়ি ছিল না। কিন্তু তাঁরাও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা ছিলেন না। তখনো মোহনদাস মহাত্মা হয়ে ওঠেননি, তাই হয়ত জলে ডুব দিয়েছিলেন। কাথিয়াওয়াড়ের বৈশ্যরা উপবীত ধারণ করত। স্নান সেরে ওঠার পর গান্ধীর গলায় পৈতে আর মাথায় টিকি নেই দেখে এক সাধু বড় দুঃখ পেয়েছিলেন, কারণ ওগুলি হিন্দুর চিহ্ন। গান্ধী বলেছিলেন, যে চিহ্ন শূদ্র জন্মসূত্রে ধারণ করতে পারে না, সে চিহ্ন অন্যরা কেন ধারণ করবে? আর বলেছিলেন, সমাজে অস্পৃশ্যতা দূর না হলে হিন্দুর শিখা রাখার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। বলা বাহুল্য, সেই অস্পৃশ্যতা রয়েই গেল কুম্ভে। ‘হিন্দু জল’ এবং ‘মুসলিম জল’ সম্পর্কে গান্ধীর অস্বীকৃতি এবং ১৯১৫ সালের কুম্ভ মেলা উপলক্ষে সাধুদের কুসংস্কার এবং ভণ্ডামি ১১০ বছর পার করে ২০২৫ সালের কুম্ভমেলার প্রেক্ষাপটেও অপরিবর্তিত রয়ে যায় ।