মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘অপছন্দ’ করার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে মার্কিন বিদেশ দপ্তর। পাশাপাশি, ইজরায়েলে গণহত্যার বিরোধী মাহমুদ খালিলের পর সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই ভিনদেশি ছাত্রকে ‘দেশছাড়া’ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। খালিলের মতো ভিসা বাতিল করে ‘বেআইনি অভিবাসী’ বলে দাগিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে লেকা কর্দিয়া নামের এক প্যালেস্তিনীয় ছাত্রীকে। গ্রেপ্তার না করা হলেও, খালিল ও লেকার মতো ভিসা বাতিল করে দেশছাড়া করা হয়েছে রজনী শ্রীনিবাসন নামের এক ভারতীয় ছাত্রীকে।
আহমেদাবাদের ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্ল্যানিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে বছর কয়েক আগে ‘নেহরু ফুল ব্রাইট স্কলাপশিপ’ নিয়ে প্রথমে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান এই কৃতী ছাত্রী। ‘পরিবেশ বান্ধব নগরায়ণ’ নিয়ে গবেষণা করার সুবাদে এমআইটি সহ আমেরিকার আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করার সুযোগ পান। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে গত বছর গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে তিনি সরব হন। ঠিক সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ট্রাম্প প্রশাসনের রোষের শিকার হন রজনী।
ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও হাজার তিনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায়এক বিবৃতিতে রজনী শ্রীনিবাসনের ‘হামাস যোগ’ রয়েছে বলে অভিযোগ করে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বরাষ্ট্র দপ্তর। খালিল ও লেকার মতো অজ্ঞাত কারণে রজনীর ‘এফ-১’ ছাত্র ভিসা বাতিল করে বেআইনি অভিবাসীর তকমা দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারির থেকে বাঁচতে, আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেআসেন রজনী। দেশের একজন অন্যতম কৃতী ছাত্রীর রাতারাতি শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এদিকে শুল্কনীতি সহ অন্য আরও পাঁচটি বিষয়ের মতো এ বিষয়েও টুঁ শব্দটুকু করার সাহস করেননি মোদী। উল্টে রজনীকে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ ও ‘শহুরে নকশাল’ বলে দাগানো শুরু করেছে বিজেপির আইটি সেল। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাঁকে ‘হামাসের এজেন্ট’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দুত্ববাদীরা ঢালাও প্রচার শুরু করে।
খালিল, লেকা কিংবা রজনীর মতো কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এমন কয়েক শতাধিক মার্কিন পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগের নোটিশ ছাড়াই তাদের শো কজ, সাময়িকভাবে বরখাস্ত, ডিগ্রি বাতিল, কিংবা বহিষ্কার করা শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে কলম্বিয়া সহ সেদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে সরব হওয়া ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের উপর নানাভাবে আক্রমণ শুরু করেছেন ট্রাম্প। তারই মধ্যে রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তে রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। এর আগে ‘ব্রিকস’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একাধিক হুমকি দিয়েছেন ঠিকই, তবে এই প্রথম তিনি সরাসরি কূটনৈতিক সংঘর্ষে জড়ালেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই আমেরিকার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। গত মাসেই ‘বর্ণভিত্তিক রাজনীতি’ করার অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকায় মার্কিন আর্থ-সামাজিক মদতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছেন ট্রাম্প।
আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার এক নতুন আইন ট্রাম্প প্রশাসনের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। এই আইনে ঔপনিবেশিক আমলে কৃষ্ণঙ্গদের আদিবাসীদের যে সমস্ত জমি শ্বেতাঙ্গরা জবরদখল করেছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আইন ‘শ্বেতাঙ্গদের স্বার্থ-বিরোধী’ বলে দাবি করে তীব্র বিরোধিতা করেন ট্রাম্প। আদতে এই আইনের দ্বারা মর্কিন মুলুকের এক বিশেষ প্রভাবশালী অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ বৈষম্যের পক্ষে থাকা শাসনব্যবস্থা পতনের পর, সেখানকার শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় অংশ আমেরিকায় এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের রাশি রাশি জমি এখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়ে গেছে। নতুন আইনের আওতায় সেই সমস্ত জমিই অধিগ্রহণ করে কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীদের ফেরত দেবে বলে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। খোদ ট্রাম্পের বিশেষ উপদেষ্টা এলন মাস্ক এই আইনের জোরে পৈতৃক সম্পত্তির এক বড় অংশ হারাবেন।
এছাড়া গাজায় ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের করা মামলার জেরেই তাদের ট্রাম্পের রোষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই মামলায় গত বছর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভি গ্যালান্টকে ‘যুদ্ধ অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করে আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করে।