অসীম সুর চৌধুরী
সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্পেস প্রমোশন অ্যান্ড অথোরাইজড সেন্টার’ সংক্ষেপে (INSPACe) সংস্থার চেয়ারম্যান পবন গোয়েঙ্কা ভারতের নিজস্ব জিপিএস ব্যবস্থা ‘নাভিক’ নিয়ে একটা বড় আপডেট দিয়েছেন। বলা ভালো, ভারতের নাগরিকদের একটা সুখবর শুনিয়েছেন। এক প্রেস সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, শীঘ্রই ভারতের জনগণ ‘নাভিক’-এর ব্যবহার করতে পারবে। এর জন্য সাতটা এল-১ (L-1) ব্যান্ড কম্পাঙ্কের (১৫৭৫.৪২ মেগাহার্জ) উপগ্রহ দরকার। যার একটার উৎক্ষেপণ আগেই হয়ে গেছে, আর বাকিগুলো কিছু সময়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে। মি. গোয়েঙ্কা আরও জানিয়েছেন যে, ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় ১৫০০ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত ‘নাভিক’-এর আধিপত্য বজায় থাকবে। এর মাধ্যমে কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান প্রায় নিখুঁত ভাবে দেখা যাবে। খুব জোর ১০ মিটারের এদিক-ওদিক হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় জিপিএস ‘নাভিক’ কী? আর কীভাবে এটা কাজ করবে?
জিপিএস-এর পুরো নাম ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিসটেম’। স্মার্ট ফোন নিয়ে যাঁরা অল্পবিস্তর নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের কাছে জিপিএস অতি পরিচিত নাম। এর সাহায্যে খুব সহজে ও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর যে কোনও স্থানের অবস্থান ও তথ্য পাওয়া যায়। জিপিএস ব্যবস্থা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও আবহাওয়ায় কার্যকরী এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই পরিষেবা পাওয়া যায়। স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, গাড়ি, প্লেন, জাহাজ ইত্যাদিতে জিপিএস রিসিভার (গ্রাহক যন্ত্র) অনেকদিন থেকেই রয়েছে।
১৯৭০ দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব মিলিটারির প্রয়োজনে জিপিএস প্রযুক্তির কাজ শুরু করেন। পরে আস্তে আস্তে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়, যাতে পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকে জিপিএস ব্যবহার করা যেতে পারে। ১৯৯৫ সালে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য জিপিএস উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকে শুধু মিলিটারি নয়, যে কোনও সাধারণ লোক বিনা পয়সায় এটা ব্যবহার করতে পারেন। জিপিএস প্রযুক্তি চালু করার পিছনে যে তিনজনের অবদান খুবই উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন রজার এস এসটন, আইভান এ গেটিং এবং ব্রাডফোর্ড পার্কিনসন।
জিপিএস ব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে ২৭টি কৃত্রিম উপগ্রহের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। এরা ভৃপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০ হাজার ২০০ কিমি উপরে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ২৪টি উপগ্রহ সক্রিয় থাকে, বাকি তিনটি নিষ্ক্রিয়। কিন্তু প্রয়োজন হলে কাজ করতে সক্ষম। উপগ্রহগুলো সবসময় দু’ধরনের সংকেত প্রেরণ করছে। একটা সংকেত সামরিক বাহিনীর জন্য এবং অপরটি সাধারণ মানুষের জন্য (যার কম্পাঙ্কের মান ১৫৭৫.৪২ মেগাহার্জ)। উপগ্রহ থেকে জিপিএস সংকেতগুলো আলোর গতিতে (৩,০০,০০০ কিমি/সে.) পৃথিবীতে পৌঁছয়। এই সংকেতগুলোর মধ্যে প্রধানত যে তথ্যগুলি থাকে তা হল, উপগ্রহের পরিচয়, সে কোন স্থানে রয়েছে এবং কোন সময়ে সংকেত প্রেরণ করছে। এই তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে জিপিএস রিসিভার বস্তুর অবস্থান প্রায় নিখুঁতভাবে বলে দেয়। মাত্র ১০ মিটার এদিক ওদিক হতে পারে।
জিপিএস ব্যবস্থায় সময়ের নিখুঁত পরিমাপ হওয়া খুবই জরুরি। নাহলে বস্তুর অবস্থান সঠিকভাবে বলা যাবে না। কোনও ঘড়ির সময় যদি মাত্র ০.০০০০১ সেকেন্ড ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে অবস্থানের ফারাক হয়ে যাবে প্রায় তিন কিমি। তাই জিপিএস উপগ্রহে ত্রুটিমুক্ত ঘড়ি দরকার। কিন্তু এত ক্ষুদ্র সময় মাপতে পারে আনবিক ঘড়ি, যা খুবই ব্যয়বহুল। জিপিএস উপগ্রহগুলিতে এই আনবিক ঘড়ি লাগানো থাকে, যেটা খুব নিখুঁতভাবে সময়ের পরিমাপ করে।
আমেরিকার জিপিএস ব্যবস্থার পাল্টা হিসেবে রাশিয়া ‘গ্লোনাশ’ (GLONASS) ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করে কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গায় এই প্রযুক্তি কার্যকর না হওয়ায় এটা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘গ্যালিলিও’ (GALILEO), জাপানের ‘কোয়াসি জেনিথ স্যাটেলাইট সিসটেম’ (QZSS), চিনের ‘বেইডোউ নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিসটেম’ (বিডিএস) ইত্যাদি বিভিন্ন জিপিএস চালু আছে। কিন্তু এখনও সারা পৃথিবীতে আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জিপিএস ব্যবস্থাই সবচেয়ে জনপ্রিয়।
জিপিএস ব্যবস্থা যতই নিঃশুল্ক হোক না কেন, এর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু সবসময় আমেরিকার কাছে রয়েছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি সামরিক বাহিনীও এই আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জিপিএস ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কার্গিল যুদ্ধের সময় আমাদের মিলিটারি বাহিনী বেশ কিছু জিপিএস সংক্রান্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। তাই তারপর থেকেই ভারত নিজস্ব জিপিএস ব্যবস্থা কীভাবে চালু করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এটা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’কে। শুরু হল ভারতে নিজস্ব জিপিএস ব্যবস্থা ‘ইন্ডিয়ান রিজিওনাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ (সংক্ষেপে আইআরএনএসএস)। পরে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘নেভিগেশন ইন ইন্ডিয়া কনস্টেলেশন’ (এনএভিআইসি) বা ‘নাভিক’।
২০১৩ সালের ১ জুলাই ‘নাভিক’-এর প্রথম উপগ্রহ প্রথম মহাকাশে পাঠানো হয়। তারপর ধারাবাহিকভাবে আরও ৬টি উপগ্রহ ছাড়া হয়েছে। মোট ৭টি উপগ্রহ নিয়ে তৈরি ‘নাভিক’ ব্যবস্থা ভারতের মধ্যে তো বটেই, বাইরেও প্রায় ১৫০০ কিমি পর্যন্ত কাজ করবে। এখানে দু’ধরনের কম্পাঙ্ক ব্যবহার করা হয়েছে। ২৪৯২.০২৮ মেগাহার্জ (S-ব্যান্ড) এবং ১১৭৬.৪৫ মেগাহার্জ (L-৫ ব্যান্ড)। তবে এই কম্পাঙ্কগুলি প্রতিরক্ষার কাজে ও অন্যান্য বিশেষ বিভাগে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষমতার ছোট্ট যন্ত্র যেমন মোবাইল, স্মার্ট ঘড়ি ইত্যাদিতে জিপিএস ব্যবস্থা চালাতে গেলে ১৫৭৬.৪২ মেগাহার্জ কম্পাঙ্ক (L-১ ব্যান্ড) বেশি কার্যকরী। তাই এই কম্পাঙ্কের উপগ্রহগুলো মহাকাশে পাঠানো সম্পূর্ণ হলেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে ‘নাভিক’ ব্যবস্থা।
জিপিএস ব্যবস্থার নানা সুবিধা একে দিন দিন জনপ্রিয় করে তুলেছে। জিপিএস মানচিত্রে রাস্তাঘাট ছাড়াও নানা উল্লেখযোগ্য স্থান যেমন সরকারি অফিস, হোটেল, পুলিশ স্টেশন ইত্যাদির তথ্য থাকে। বড় শহরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে জিপিএস এখন বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা সহ অন্যান্য শহরে ওলা, উবের, র্যাপিড ইত্যাদি সংস্থাগুলো যে ট্যাক্সি পরিষেবা চালু করেছে, তা পুরোপুরি জিপিএস নির্ভর। এছাড়া বর্তমান যুগে প্লেন ও জাহাজ পরিবহণ জিপিএস ছাড়া ভাবাই যায় না।
ভারতের মধ্যে ‘নাভিক’ ব্যবহার করলে আরও ভালোভাবে নানা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
১) কোথায় কোন গাড়ি, জাহাজ ও বিমান রয়েছে তার অবস্থান নিমেষের মধ্যে জানা যাবে।
২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘নাভিক’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে।
৩) ভারতের মিলিটারি ও মিসাইল ব্যবহারে নাভিক খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। নিজস্ব জিপিএস হওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় থাকবে।
৪) দেশবিরোধী জঙ্গিদের অবস্থান জানাতে ও অনুপ্রবেশ রুখতে নাভিক দারুণ সাহায্য করবে।
কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য রাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর জানিয়েছিলেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যে সমস্ত স্মার্ট ফোনের মধ্যে ‘নাভিক’ অ্যাপ ঢোকানো হবে। এরই মধ্যে বেশ কিছু নামি মোবাইল ব্র্যান্ড যেমন আই ফোন, রেড মি, ভিভো ইত্যাদি তাদের বাছাই করা কিছু মডেলে ‘নাভিক’কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই কবে ঔপনিবেশ প্রযুক্তি জিপিএসকে হঠিয়ে দেশি ‘নাভিক’-এর প্রবেশ ঘটবে তারই প্রতীক্ষায় রয়েছে দেশবাসী।
শেষে একটা খারাপ খবর দিয়ে এ লেখা শেষ করছি। গত ২৯ জানুয়ারি (২০২৫)-তে ‘নাভিক’-এর জন্য ছাড়া NVS-02 উপগ্রহ উৎক্ষেপণ পুরোপুরি সফল হল না, আংশিকভাবে হল। ওই উপগ্রহকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করা যায়নি। তবে এটা অন্য উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে।