আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে এখন চলছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন রোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘কপ-২৯’। এই সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। তাই স্বভাবতই এখন প্রশ্ন জাগে এক সপ্তাহে এই সম্মেলনে কী এমন পাওয়া গেল, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করা বা সেই সমস্যা মোকাবিলার দিকে সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলে সবার মনে আশা জাগে।
আসলে এবারের কপ-২৯’কে প্রথম থেকেই বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ঠেকানো বা তার মোকাবিলার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল গড়া বা অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা করার জন্যই চিহ্নিত করা হয়েছিল। মানে বলা হয়েছিল এবারের কপ টাকা জোগাড় নিশ্চিত করার সম্মেলন।
টাকা জোগাড় শুধু নয়— কথা শুরু হয় সেই তহবিলের পরিমাণ কত হবে, তা নিয়ে। আসলে এর আগে এই কাজে বছরে যে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার হিসেবে অর্থ সংগ্রহের লক্ষমাত্রা ধার্য হয়, তার সময়সীমা এই বছরেই শেষ হচ্ছে। ফলে স্বভাবতই অর্থ-সংগ্রহের নতুন লক্ষমাত্রা গ্রহণ করতে হবে। কোনও কোনও মহল থেকে নতুন লক্ষমাত্রার পরিমাণ বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার করার কথা বলা হচ্ছে। তবে তা নিয়ে উন্নত ও উন্নতশীল দেশগুলির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা মতপার্থক্য আছে। শিল্পোন্নত দেশগুলি এই সমস্যার কারণগুলি তৈরি করেছে বলে এই টাকা তাদের দেওয়া উচিত বলে উন্নতশীল দেশগুলি চাইলেও উন্নত দেশগুলি যে সহজেই একথা মানতে রাজি, তা নয়।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন রোধ সংক্রান্ত যে সংস্থা আছে তার নাম ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ বা সংক্ষেপে ইউএনএফসিসিসি। সেই সংস্থা এ বিষয়ে যে উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি বা হাই লেভেল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ক্লাইমেট ফিনান্স গঠন করেছে সেই সমিতি নতুন সম্মিলিত পরিমিত লক্ষমাত্রা বা এনসিজিসি বা এর আগে বচরে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার্য করা হয়েছিল সেটা বাড়িয়ে বছরে এক দশমিত তিন (১.৩) ট্রিলিয়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তারা বলেছে যে, বিভিন্ন দেশ যদি এ বিষয়ে এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নেয় তবেই বর্ধিত হারে এই ১.৩ ট্রিলিয়ন অর্থ ২০৩৫ সালের পর থেকে প্রতি বছরই লাগবে।
একদিকে যখন পৃথিবীতে অনেক দেশই এই বর্ধিত অর্থ বরাদ্দ করতে রাজি হচ্ছে না, তখন নেট জিরো নীতি নিয়ে গঠিত কর্মীগোষ্ঠী তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজোড়া উষ্ণায়ন বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য প্যারিস চুক্তিতে যে লক্ষমাত্রা ধার্য করা হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা ওই লক্ষমাত্রার অনুসারি নয়।
চিন এ বিষয়ে যে অর্থ বরাদ্দ করেছে, তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। চিন ২০১৬ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কর্মসূচিতে ইতিমধ্যেই সাড়ে চব্বিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ দিয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলি কিন্তু চিন, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আর আমিরশাহীরা (ইউএই)-কে দূষণ সৃষ্টিকারী নতুন দেশ বলে আখ্যা দিয়ে বলেছে এই দেশগুলির আরও বেশি করে অর্থ দেওয়া উচিত।
এবারের সম্মেলনের একটা আশার কথা যে, বিশ্বব্যাঙ্কের মতো বিভিন্ন বহুপাক্ষিক (মাল্টিল্যাটারাল) ব্যাঙ্ক জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কর্মসূচির জন্য তাদের বরাদ্দ প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়াবার ইচ্ছের কথা ঘোষণা করেছে, যার ফলে এই ব্যাঙ্কগুলির বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বেড়ে বছরে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে।
অন্যদিকে বেশি গ্রিন গ্যাস নির্গমন করা এবং সেই সঙ্গে জীবাশ্ম থেকে শক্তি উৎপাদনের উৎস কমানোর ৫০টি বিশ্ব বাণিজ্যের শীর্ষ সংস্থা এবং প্রায় ৭০০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যে সংযুক্ত গোষ্ঠী রয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই একটা খোলা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে তারা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছে যে তারা যেন লবায়ু পরিবর্তন রোধে স্বীকৃত এবং পরীক্ষিত নীতিই গ্রহণ করে যাতে সবুজ পণ্য ব্যবহার ও শিল্পক্ষেত্রে কার্বন পরিত্যাগের মাত্রা কমে। তারা আরও বলেছে, সঠিক নীতি গ্রহণ করলে এ বিষয়ে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব, যাতে প্রায় ৫০০-র মতো যে সবুজ শিল্প সংস্থা গড়ে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে তারা ২০৩০ সালের মধ্যেই গড়ে উঠতে পারে।
এবারের কপ-২৯ সম্মেলনে শক্তির উৎসের পরিবর্তনে খনিজের ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে কলম্বিয়া সরকার যে বিশ্বজোড়া চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে, তা কপ-২৯ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অনেক দেশই সমর্থন করেছে। এই চুক্তি হলে কোবল্ট, লিথিয়াম বিশেষজ্ঞ নিকেল প্রভৃতি খনিজের জোগান ব্যবস্থার একটা বিশ্বজোড়া মান অর্জন করা সম্ভব হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে এবং সেই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক ভাবে প্রকৃতিও সংরক্ষিত হবে।
এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১.৫ টেরাওয়াট পরিমাণ শক্তির ভাণ্ডার মজুত করা যায়, যাতে বিশ্বে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির পরিমাণ তিনগুণ বাড়ানো যায়।
অন্যদিকে কপ-২৯ সম্মেলনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা বদল হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কর্মসূচিতে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের জন্য যে তহবিল গড়ার কথা হচ্ছে, তাতে অর্থ জোগানের পরিমাণ কমে যাবে।
কপ-২৯-এর প্রথম সপ্তাহ শেষ হলো। তাতে যা অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে, তা যে বিরাটভাবে আশানুরূপ, তা নয়। বাকি আর মাত্র এক সপ্তাহ। তাই আলোচনাকারীদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। এবারে কপ-২৯ সম্মেলনের যে মূল লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আরও বেশি টাকার বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে— সেই টাকা কীভাবে তোলা যায়, সেটাই এখন এই সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।