শোভনলাল চক্রবর্তী
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের রিপোর্টের সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে উত্তরভারতের অস্বাভাবিক তাপ প্রবাহ এবং গাঙ্গেয় বদ্বীপে ঝড়ের তান্ডব। সবুজ আচ্ছাদন ক্রমশ হারাচ্ছে ভারত। পরিমাণটি উদ্বেগজনক। ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’, যারা বিশ্বের অরণ্যসম্পদের উপর নজরদারির কাজটি করে থাকে, তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে ২০২০ সাল থেকে এই পর্যন্ত ভারতে ২৩ লক্ষ হেক্টরেরও অধিক বৃক্ষ-আচ্ছাদন খোয়া গিয়েছে। রিপোর্টে এ-ও ধরা পড়েছে— ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যে আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে, তার ষাট শতাংশই দেখা গিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বের পাঁচটি রাজ্যে— অসম, মিজ়োরাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড এবং মণিপুর। এর মধ্যে শুধুমাত্র অসমেই কমেছে তিন লক্ষ চব্বিশ হাজার হেক্টর। এই তথ্য-পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি জাতীয় সবুজ আদালত নোটিস ধরিয়েছে ভারত সরকারকে।
বলা হয়েছে, ভারতে এই পরিমাণ বৃক্ষ-আচ্ছাদন হ্রাস বাস্তবে অরণ্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০; বায়ুদূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮১; এবং পরিবেশের সুরক্ষা বিষয়ক আইন, ১৯৮৬— প্রতিটিকে লঙ্ঘন করে। অর্থাৎ, ভারতের পরিবেশ রক্ষার্থে যে সমস্ত আইন এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে, সরকার হয় নিজেই তা ভাঙছে, নয়তো আইন অমান্য দেখেও চুপ থাকছে।মনে রাখা প্রয়োজন, বৃক্ষ-আচ্ছাদন হ্রাস সর্বদা অরণ্যচ্ছেদনকে বোঝায় না। অরণ্যচ্ছেদনের যাবতীয় দায়ই মানুষের। মানুষই তার চাহিদাপূরণের স্বার্থে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট অরণ্যকে পাকাপাকি বিনষ্ট করে। বৃক্ষ-আচ্ছাদন হ্রাসের পশ্চাতে মনুষ্যসৃষ্ট কারণের পাশাপাশি দাবানল, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক কারণও সমান ভাবে দায়ী। সেই ক্ষতি স্থায়ী-অস্থায়ী উভয়ই হতে পারে। কিন্তু এই পার্থক্যের কথা স্মরণে রাখলেও যে কঠোর বাস্তবটি স্পষ্ট হয়, তা হল— বৃক্ষ-আচ্ছাদন হ্রাসের চরম প্রভাব শেষ পর্যন্ত মানবসমাজের দৈনন্দিন জীবনযাপনের উপরেই আঘাত হানে। উল্লেখ্য, অরণ্য কার্বন-শোষক এবং কার্বনের উৎস— উভয় ভূমিকাই পালন করে থাকে। অরণ্য যদি অবিকৃত থাকে, অথবা গড়ে ওঠার পর্যায়ে থাকে, তখন সে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে সরিয়ে বাতাস নির্মল করে। এর ঠিক বিপরীত চিত্রটি দেখা যায় অরণ্যের মানের অবনমন ঘটলে অথবা তা ধ্বংস হলে, বাতাসে কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে। যার পরিণতি— জলবায়ু পরিবর্তন এবং তজ্জনিত কারণে পরিবেশে নানা বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি।
অর্থাৎ, অরণ্যচ্ছেদন এবং অরণ্য-আচ্ছাদন হ্রাসের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও পরিণতির দিক থেকে দু’টিই মানবসমাজের উপর আঘাত হানতে সক্ষম।এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকারের ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ। এর আগেও একাধিক আন্তর্জাতিক সমীক্ষা ভারতে দ্রুত অরণ্য-আচ্ছাদন হ্রাসের তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিল। অতঃপর তা রোধ করতে সরকারের পদক্ষেপগুলি কী, তা বিশদে জানা প্রয়োজন। কিন্তু শুধুমাত্র উন্নয়নের ধুয়ো তোলা ছাড়া এ বিষয়ে কোনও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের সঠিক দিশা পাওয়া যায় না। বরং, নির্বিচারে গাছ কাটা অব্যাহত গোটা দেশ জুড়ে। অসমে ইতিপূর্বে ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ গাছ কাটা হয়েছিল। আশ্চর্য নয়, বৃক্ষ-আচ্ছাদন হ্রাসে অসম সর্বোচ্চ স্থানটি পেয়েছে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল। এই সমস্ত অঞ্চলে সবুজ আচ্ছাদন সরে যাওয়ার অর্থ সেই বৈচিত্রের বিপুল ক্ষতি। প্রশ্ন হল, ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণটি সরকার আদৌ বুঝবে কি? বিগত কয়েক বছরে প্রাক্-বর্ষা মরসুমে বঙ্গভূমিতে ঘূর্ণিঝড়ের হানা এক প্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়লা, আমপান, ইয়াসের ধ্বংসলীলার স্মৃতি এখনও ফিকে হয়নি, এর মধ্যেই সাম্প্রতিকতম ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ফের বিপর্যস্ত হল পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূল।
রেমাল সরাসরি এ রাজ্যে আঘাত হানেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ভূমি স্পর্শ করা ঝড়ের ‘লেজের ঝাপটা’র যে প্রবল প্রভাব উপকূলবর্তী এলাকায় অনুভূত হয়েছে, তা ভয়ের। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সামুদ্রিক ঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা উভয়ই বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার কথা বহুশ্রুত। প্রতি বছর বর্ষাশুরু অথবা বর্ষাশেষে ঘূর্ণিঝড়ের আগমন সেই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। এক ঝড়ের ক্ষতি সামলে না-উঠতেই পরবর্তী ঝড়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করতে হচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়।রেমালের কারণে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৭। সরকারি সূত্রেই জানা গিয়েছে, রাজ্যে ২,৫০০টি বাড়ি পুরোপুরি এবং প্রায় ২৭,০০০ বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি চাষের জমিতে জল ঢুকে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে, চলাচলের রাস্তায় গাছ পড়ে যে অবর্ণনীয় দুরবস্থার জন্ম হয়েছে, তা ভয়ঙ্কর। কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ থেকেছে ২১ ঘণ্টা। অভূতপূর্ব ভাবে মেট্রোরেলের পাতালপথে জল প্রবেশ করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাহত হয়েছে পরিষেবা, চলেনি লোকাল ট্রেনও। রবিবার রাতে ঝড় আছড়ে পড়ার পরও সোমবার গোটা দিনের ঝড়বৃষ্টিতে জল জমে, পর্যাপ্ত সংখ্যক গণপরিবহণ পথে না বেরিয়ে থমকে দিয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনকে। প্রতি বার এই তীব্রতার ঝড়-জলের শেষে এটাই পরিচিত চিত্র। তিলে-তিলে বহু বছরের পরিশ্রমে যে যাপনচিত্র গড়ে তোলা হয়, কয়েক মুহূর্তের তাণ্ডবে তা ভেঙে চুরমার। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই কারণেই আতঙ্কের। তা বিত্তশালীদের যত না আঘাত করে, তার চেয়ে ঢের বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয় বিত্তহীনদের।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যায় পরিবেশ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা, যেখানে বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যের পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রেমালের দাপটে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উপকূলভূমি নয়, বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, ভোলার, পটুয়াখালিরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ভেঙেছে দেড় লক্ষ বাড়ি, মৃত অন্তত ১০। সামুদ্রিক ঝড়কে আটকে দেওয়া যায় না, কিন্তু তার ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বের ঝড়প্রবণ এলাকাগুলির পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটিয়ে। এ ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত উন্নত বিশ্বের। কারণ, সেই ‘ঐতিহাসিক দায়’। ভারত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি লড়ছে তাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে। সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ, পূর্বাভাসের ব্যবস্থা উন্নততর করা প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি রোখার আন্তরিক চেষ্টা চলছে। রেমাল আঘাত হানার পূর্বেই বাংলাদেশের প্রায় আট লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। নয়তো প্রাণহানি অনেক গুণ বেশি হত। এই লড়াইয়ে উন্নত বিশ্বকে পাশে দাঁড়াতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলির, বিনা শর্তে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার এর কোনও বিকল্প পথ নেই।
ভারতের বড় শহরগুলিতে গ্রীষ্মের দিন যে ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সম্প্রতি দিল্লির তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করেছে ৫০-এর আশেপাশে, যা অভূতপূর্ব। কিন্তু বর্ষাকালীন বৃষ্টিও যে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি দিতে পারছে না, বরং ক্রমবর্ধমান উত্তাপ এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার যুগলবন্দিতে অস্বস্তি ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে, সে কথা জানাল দিল্লির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই)। শহরগুলির এই তালিকায় রয়েছে বেঙ্গালুরু, কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও মুম্বই। শুধু তা-ই নয়, এত দিনের সাধারণ জ্ঞান যা বলে— দিনের বেলার উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠ রাতে দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়— তারও খোঁজ মিলছে না।
শহরাঞ্চলে রাতের স্বস্তিটুকুও উধাও হয়েছে তাপমাত্রা সে ভাবে না-কমায়। একমাত্র কলকাতাই ব্যতিক্রম। সিএসই-র তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-১০ সালের মধ্যে কলকাতার রাতের তাপমাত্রা যতখানি হ্রাস পেত, ২০১৪-২৩’এর দশকে সেই হারই অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বাকি শহরগুলির তথ্য তা বলছে না। তাই এ কথা বলাই যায়, উষ্ণায়ন যে হারে বিশ্বকে উত্তপ্ত করে তুলছে, বৃহৎ শহরগুলি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে।এমনটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। সৌজন্যে, বেপরোয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নগরায়ণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, গ্রাম ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হবে, তার পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটবে, এতে বিরুদ্ধ মত থাকা উচিত নয়। রূপান্তরের এই মডেলটিকে বলপূর্বক আটকে পিছনে হাঁটার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আপত্তি, যখন সেই রূপান্তর ঘটানো হয় পরিবেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে।
বেশ কয়েক দশক আগে পর্যন্ত জলাভূমি বুজিয়ে, গাছ কেটে নগরসভ্যতার বিকাশ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ ওঠেনি, কারণ সার্বিক ভাবে পরিবেশ সচেতনতায় ঘাটতি ছিল। বিশ্ব উষ্ণায়ন যে মানবসভ্যতার ত্রাসস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে, এবং শেষের দিনটি যে এমন হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে আসবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ধারণা যখন তৈরি হল, তখনও যে প্রশাসনিক স্তরে নড়েচড়ে বসার যথেষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, সেটাই আতঙ্কের। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শহরগুলিতে ‘হিট স্ট্রেস’-এর জন্ম হচ্ছে। তাপমাত্রাজনিত অস্বস্তির এই কুচক্র তৈরি হয় বাতাসের তাপমাত্রা, ভূমির তাপমাত্রা, এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার সম্মিলিত প্রভাবে। অন্যতম কারণ, শহরগুলি ক্রমশ কংক্রিটে মুড়েছে। ফলে ভবিষ্যতে যদি শহরের সবুজ আচ্ছাদন বৃদ্ধিও করা হয়, তা দিনের তাপমাত্রাকে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু রাতের স্বস্তি ফিরবে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শহরের লাগামছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ‘হিট আইল্যান্ড’ কথাটি বহুশ্রুত। যার অর্থ, শহরের তাপমাত্রা যখন চার পাশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। সিএসই-র রিপোর্টেও তারই প্রতিধ্বনি। দেখা গিয়েছে, যে শহরের ‘কংক্রিটায়ন’ যত বেশি, তার তাপমাত্রা বৃদ্ধিও তত বেশি। এর প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন ছিল কংক্রিটের সঙ্গে সবুজ এবং জলাভূমির মধ্যে এক সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা। উন্নয়ন ঘটানো, কিন্তু পরিবেশগত ক্ষতিকে ন্যূনতম রাখা। আশ্চর্য, পুরনো জনবসতিগুলি তো বটেই, অত্যাধুনিক সদ্য-নির্মিত নগরগুলিতেও সেই ভারসাম্য বজায় রইল না। উষ্ণতার ফাঁদে ছটফটিয়ে মরাই কি তবে নগরজীবনের ভবিতব্য?