শোভনলাল চক্রবর্তী
সময়টা ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি। স্থান: কলকাতার কাশীপুরের একটি বাগানবাড়ি যা আজ রামকৃষ্ণভক্ত পরিমণ্ডলে কাশীপুর উদ্যানবাটি নামে এক অনন্য তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত। শ্রীরামকৃষ্ণের গলায় ক্যানসার হয়েছিল। তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরে। তৎকালীন বড় বড় ডাক্তাররা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখলেন। তাঁরা বললেন, বায়ু পরিবর্তন দরকার।কলকাতার শ্যামপুকুরে একটি বাড়িতে তাঁকে রাখা হল। কিন্তু সেই জায়গা ঠাকুরের পছন্দ হল না। কারণ, স্থানের অভাব। তখন কাশীপুরের একটি বাগানবাড়িতে তাঁকে আনা হল। তাঁর চিকিৎসা চলতে লাগল। পরবর্তীকালে যাঁরা তাঁর সন্ন্যাসীসন্তান তাঁরা দিনরাত সেবা করতে লাগলেন। তাঁর যাঁরা গৃহীভক্ত তাঁরা নিয়মিত সেখানে তাঁর পাশে পাশে থেকে সেবা করে ও তাঁর দুর্লভ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতেন।শ্রীরামকৃষ্ণ থাকতেন কাশীপুর উদ্যানবাটীর দোতলার একটি ঘরে। ওই দিন বিকেল নাগাদ হঠাৎ তিনি নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নীচের বাগানে। সে দিন শরীরটা তাঁর একটু ভাল লাগছিল। নীচের বাগানে তখন প্রায় ৩০ জন শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত ছিলেন যাঁর মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত নট, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষও। তিনি চারদিকে ঠাকুরের অবতারত্ব, তাঁর বিরাটত্ব, তাঁর অনন্যতা সম্পর্কে বলে বেড়াতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নেমে এসে গিরিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী বুঝেছো?’’ গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের সামনে তখন নতজানু হয়ে বসে পড়ে বললেন, ‘‘স্বয়ং ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর কী বলব?’’ অদ্ভুত গদগদ কণ্ঠে অসামান্য ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে গিরিশচন্দ্র এই অপূর্ব কথাগুলি যেই বললেন, অমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি হল। তিনি বললেন, ‘‘তোমাদের আর কী বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক।’’
সেখানে আর যাঁরা ভক্ত ছিলেন তাঁরা হঠাৎ দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘‘ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, দৌড়ে আয়। ঠাকুর আজ কল্পতরু হয়েছেন।’’ ঠাকুরকে ঘিরে সকলে হাতজোড় করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করছেন আর সকলের অন্তরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসছে। ভিতরের সমস্ত ভাবরাশি বাইরে বেরিয়ে আসছে অনর্গল ধারায়। ঠাকুর সকলকে স্পর্শ করছেন আর বলছেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’শ্রীরামকৃষ্ণ সে দিন কল্পতরু হয়েছিলেন আর সকলকে অভয়দান করে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ অর্থ নয়, নাম নয়, যশ নয়, প্রতিপত্তি নয়, ঠাকুর সে দিন চৈতন্য বিতরণ করেছিলেন। ঠাকুর সে দিন কল্পতরু হয়েছিলেন আমাদের অন্তরস্থিত চেতনার উন্মীলনের জন্য।কল্পতরু সম্পর্কে পুরাণে বলা আছে, এ এক আশ্চর্য গাছ যার কাছে নাকি যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। সেই গাছ নিয়েই একটি গল্প আছে। পথশ্রমে ক্লান্ত এক ব্যক্তি একটি গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন। গাছটি যে কল্পতরু তা তিনি জানতেন না। হঠাৎ তিনি ভাবলেন, ‘‘খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু যদি জল পেতাম তো খুব ভাল হত।’’ ও বাবা, ভাবনা শেষ হতে না হতেই নানা রকম জল এসে হাজির। এ বার তার মনে হল, ‘‘একটু খাবার পেলে বেশ ভাল হত।’’ অমনি সুস্বাদু সব খাবার উপস্থিত। বিশ্রামের কথা ভাবতেই অমনি প্রস্তুত সুরম্য বিশ্রামাগার। এ বার তিনি ভাবলেন, ‘‘যদি কেউ একটু পা টিপে দিত, ঘুমটি বেশ ভাল হত।’’ এক সুন্দরী মহিলা অমনি উপস্থিত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ‘‘এত সুখ আমার কপালে সইবে তো? হঠাৎ যদি বাঘ এসে হাজির হয়!’’ ভাবা মাত্র বাঘ এসে হাজির হয়ে লোকটিকে খেয়ে ফেলল।এই রূপক গল্পটির অন্তরালে যে রূপটি রয়েছে তা হল, চাইতে জানতে হয়। কল্পতরু কল্পনারই গাছ। কিন্তু সে যদি বাস্তব হত তবে কী চাইতাম তার কাছে? আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষা তো পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয় না কোনও দিনই। চাইতে হবে সেই সত্যের খোঁজ যা চিরকালীন, যা অনন্তস্পর্শী।আজ থেকে এত বছর আগে শ্রীরামকৃষ্ণ এই দিনে আমাদের চৈতন্যের উন্মেষের কথা বলেছিলেন। আজ সমকালের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আজ এই চৈতন্যেরই একান্ত প্রয়োজন যার অভাবে সমস্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা ছুটে চলেছি এক অসীম অভাবের দিকে, আসন্ন ধ্বংসের দিকে। আজ কল্পতরু দিবসে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই কথাটিই চারিদিকে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হোক, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’’ দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন গদাধর। দাদার সূত্রেই দক্ষিণেশ্বরে পৌরোহিত্যের কাজে তাঁর যুক্ত হওয়া। ক্রমে হয়ে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি।
কলকাতাকে কেন্দ্র করে তখন এক বিশাল সংস্কার যজ্ঞ চলছে। সমাজ থেকে ধর্ম—প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সচেতন ও শিক্ষিত নাগরিকবৃন্দের চোখ পড়েছে এবং তাঁরা এক উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার বিষয়ে প্রত্যয়ী হয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখ তখন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কলকাতায় তখন এক দিকে ব্রাহ্মদের একেশ্বরবাদ, অন্য দিকে, হিন্দুদের বহুদেববাদ। একই সঙ্গে রয়েছে তন্ত্রসাধনা, বৈষ্ণবীয় ভাব, ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং খ্রিস্ট ধর্মের বহুল প্রচার।এই রকম একটি পরিবেশ ও সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কলকাতায় আগমন। তাঁর কর্মধারা ও জীবনযাপনকে অনেকেই গ্রাম্য ব্যক্তির পাগলামি ধরে নিলেও শ্রীরামকৃষ্ণ শুধুমাত্র রাসমণি দেবী প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের উপাসক হয়েই থাকলেন না। তিনি নিজের জীবন দিয়ে অন্য ধর্মগুলিকেও বোঝার চেষ্টা করলেন। জীবনের প্রথম পর্যায়ে ভৈরবী যোগেশ্বরীকে গুরু করেন। চলে তন্ত্রসাধনা। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর নির্দেশে শাস্ত্র অনুসারে গোকুলব্রত ও চৌষট্টি প্রকার তন্ত্রসাধনা করেন। এরপর জটাধারী নামে এক রামায়েত সাধুর কাছে রামমন্ত্র গ্রহণ করেন। এমনকি, ছ’মাস স্ত্রীবেশ ও স্ত্রীভাব ধারণ করেছিলেন কেবল ব্রজের গোপীদের ন্যায় মধুর ভাবে সাধনা করার জন্য। আচার্য তোতাপুরীর কাছে অদ্বৈত বেদান্তের নিয়ম মেনে নির্বিকল্প সমাধির সাধনায় রত হন। পরবর্তীকালে সুফি সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম ধর্মে উপদেশ গ্রহণ করেন। খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কলকাতার সিঁদুরিয়াপটির শম্ভুচরণ মল্লিকের কাছে তিনি বাইবেলের কথা শুনতেন। পানিহাটি মহোৎসব বা বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় উৎসবেও তাঁর যাতায়াত ছিল।ফলে প্রথম জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধনা তাঁকে প্রায় সকল প্রধান ও বহুল প্রচলিত ধর্মীয় পন্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল। আর তার পরিণতিতেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্যতম প্রধান বক্তব্য, ‘যত মত, তত পথ’। নিজের জীবনকে বিভিন্ন ধারার ধর্মপথে অতিক্রান্ত করে তবেই এই সিদ্ধান্তে তিনি এসেছিলেন। অবশ্য এই কথা বৈদিক ঋষিদের ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ অর্থাৎ সত্য একটাই, ঋষিরা তাকে বহু নামে বলে থাকেন—এই ভাবনা বহু প্রাচীনকালেই প্রচলিত ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই প্রাচীন সত্যকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুনরায় সমাজে প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর বক্তব্য, “আমি যার যা ভাব তার সেই ভাব রক্ষা করি। বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবের ভাবটি রাখতে বলি, শাক্তকে শাক্তের ভাব। …আমি সব ভাবই কিছু কিছু করেছি— সব পথই মানি।”
বলা চলে, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাবের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা।ধর্ম অর্থে বিভিন্ন ধর্মীয় পথগুলিকে নির্দেশ করা হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ দৃষ্টিতে সে সকল পথ অধ্যাত্মচেতনাকে সুনিশ্চিত করে। তাঁর মতে, পথ আলাদা হতে পারে, মতের বিভিন্নতাও থাকবে, কিন্তু প্রধান ইঙ্গিত ছিল অধ্যাত্ম ভাবনা ও পরিবেশে জীবন যাপন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বলতেন, ‘সংসারে থাকতে গেলে থাকতে হয় পাঁকাল মাছের মতন— সংসারের পাঁকে থাকবে, কিন্তু সংসারের পাঁক গায়ে লাগবে না।’ এইরূপ ছোট ছোট কাহিনি ও ঘটনা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে কিংবা ভক্তবাড়িতে তিনি হাজির হতেন সমন্বয়ের ভাবনা নিয়ে। বলতেন, ‘এক মায়ের পাঁচ ছেলে ও মায়ের পাঁচ রকম মাছ রান্না করার গল্প। যার যেটি সয়, তাকে সেটিই করে দেন মা।’ আসলে যার যা প্রকৃতি তাকে সেই ভাব নিয়েই থাকা উচিত— সেটাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবনার জন্যই ব্রাহ্মনেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বর্ধমান রাজার সভাপণ্ডিত পদ্মলোচন, জয়পুরের পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী, প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পণ্ডিত সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে অর্থে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেননি। কিন্তু তিনিও শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘To The Paramhansa Ramkrishna Deva’ নামক একটি কবিতা। সেটিই ‘প্রবাসী’তে বাংলায় লেখেন—“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে/ নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;/ দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি/ সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।” ছয় পঙ্ক্তির এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী আদর্শকেই চিত্রিত করেছেন। এমনকি, জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “ধর্মীয় ধ্বংসাত্মক এমন ঊষর একটি যুগেও তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদের সারসত্য উপলব্ধি করেছেন, বহু সাধনার আপাত পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বমুখর ধারাগুলি মিলিত হয়েছে তাঁর হৃদয়ের প্রশস্ততায়, তাঁর আত্মার সারল্য চিরকাল ধিক্কার জানায় পণ্ডিত আর ধর্মবেত্তাদের সমস্ত আড়ম্বর আর আত্মম্ভরিতাকে।” অন্য দিকে, শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর ‘দেশের মধ্যে নিরুদ্দেশ’ গল্পে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই সমন্বয়ী ভাবনাকেই অস্বীকারে যেন স্বীকার করে নিয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাব প্রচারের প্রায় দেড় শতক অতিক্রান্ত। বর্তমানে তাঁর এই ভাবনা নতুন করে জানা ও বোঝার সময় এসেছে। ধর্মীয় জগতের পুরোধা হিসেবে তাঁকে সরিয়ে রেখে তাঁর এই অমূল্য মতবাদকে গুরুত্ব না দিলে সময় এক দিন তার পরিণাম দেখাবে। আসলে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাবনায় নিহিত আছে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও উদার মানসিকতা। বর্তমান সমাজে যার অভাব অনেক বেশি সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং উদারচেতনাই পারে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রগতির পথে চালনা করতে। ফলে আড়ম্বর বা আত্মম্ভরিতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রত্যেকের জীবনকে অধ্যাত্ম আবহে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই ধর্মের প্রবাহ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই নতুন কোনও ধর্মের বা অনুশাসনের প্রবর্তন করেননি, কেবল নিজের জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তকে ভরে রেখেছিলেন একটি সুন্দরতম অধ্যাত্ম ভাবনায়। ‘ধর্ম’ বুঝতে চাইলে এই অর্থেই বোঝা উচিত। সংসারী ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের তিনি আলাদা আলাদা করে এই অধ্যাত্মচেতনার কথাই বলে এসেছেন বিভিন্ন সময়ে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এই ভাব সঠিক অর্থে জীবনে গ্রহণ করলেই সমাজের উন্নতি।ব্রাহ্মসমাজের অগ্রণী পুরুষ কেশবচন্দ্র সেন বাস্তবিকই বলেছেন, তিনি ধর্মসাধনের জন্য যত ক্লেশ পেয়েছেন আর কোনও সাধক এত ক্লেশ সহ্য করেননি।অবশেষে সব পথ ধরেই যখন ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করলেন, তখনই উপলব্ধি হল সকল ধর্মের উদ্দেশ্য এক ঈশ্বরপ্রাপ্তি। তাই সকল ধর্মই সমান ভাবে সত্য। সহজ সরল ভাষায় বললেন ‘যত মত তত পথ।’ অনুভব করলেন অগণিত ভক্ত তাঁর কাছে আসছে। এঁদের একদল গৃহী অন্য দল ত্যাগব্রতে দীক্ষিত সন্ন্যাসী। এঁদের দেখার জন্য ব্যাকুল ঠাকুর কেঁদে কেঁদে ডাক ছেড়ে বলেন ‘তোরা সব কে কোথায় আছিস আয়রে..।’ সেই জনস্রোত আজও আসছে। যে যেখান থেকে পারছে ছুটে আসছে ঠাকুরের পদতলে। ঠাকুর অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন প্রেম, ভক্তি আর মনুষ্যত্ববোধ। ঠাকুরের তখন বয়স চব্বিশ। জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সারদাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। মা সারদা ছিলেন তাঁর সাধন পথের মূল সহযোগী। ঠাকুর, মা সারদাকে একদিন সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে, দেবী রূপে পূজা করেন। যখন সমগ্র দেশে নারী ব্যবহারের বস্তু বিশেষ, পুরুষের ভোগ্যা, অন্দরমহলের দাসি, অসম্মান আর অবজ্ঞার পাত্রী, তখনই ঠাকুর নারীকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঠাকুরের সহজ-সরল ভাষায় যাপন পথের উপদেশগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম), আজ যা গৃহীর বেদ ‘কথামৃত’।
ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে চাপরাস দিলেন— ‘নরেন শিক্ষে দিবে। যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে’। হ্যাঁ, ঘরে বাইরে অর্থাৎ প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ) হাঁক দিয়েছিলেন। সেই হাঁক আজও ক্রমবর্ধমান। আমরা যদি সত্যি সত্যিই সেই হাঁক অনুভব করতে পারি তবেই আমাদের চৈতন্য হয়, মান এবং হুঁশ সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারি। নতুবা শুধু মাত্র ভক্তিতে গদগদ হয়ে ঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে আর দানের ভান করে, কাগজের পাতায় ছবি ও নাম ছেপে নিজের বড়াই করে লাভ কী? ঠাকুর আমিত্ব দূর করতে বলেছেন। তাঁর জীবন দিয়ে পালনও করেছেন। সে জীবন একই দেহে রাম ও কৃষ্ণের সম্মিলন। কোনও একটি সমস্যা নয়, একই সঙ্গে বহু সমস্যা সমাধানের পথ দেখালেন নিজের জীবন দিয়ে। তাই তিনি অবতার শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ অবতার। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে উদ্দেশ্য করেই স্বামীজি শ্লোক লিখেছেন— “ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে/ অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ।’’