• facebook
  • twitter
Saturday, 4 January, 2025

স্বাগত ২০২৫

শাসকের কাছে জনগণ বিচার্য ভোটের মাপকাঠিতে। তাই গণতন্ত্র ও সংবিধান এখন বিপন্ন। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাও সংকটের মুখে। হিন্দুত্বের ভয়াল বিষবাষ্পে দমবন্ধকর অবস্থা।

ফাইল চিত্র

দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’ বলে আমরা ২০২৪-কে বিদায় দিয়ে নতুন ইংরেজি বছর ২০২৫-কে স্বাগত জানালাম। বিদায় জানালাম অন্ধকার ছায়াচ্ছন্ন দিনগুলিকে, বুকের মাঝে তুলে রাখলাম আলোকোজ্জ্বল সুবর্ণ দিনগুলির স্মৃতি।
বিশ্বজুড়ে গত বছরটা ছিল ভোটের বছর. ৬০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন হয়েছে ২০২৪ সালে। প্রায় সর্বত্রই দেখা গেল ক্ষমতাসীন শাসক দলকে বিপন্ন করে সামনে এগিয়ে এসেছে শাসিতের ক্ষোভ। কোথাও সরে যেতে হয়েছে শাসকদের, আবার কোথাও তাঁরা ফিরে এসেছেন আগের থেকেও অনেক কম আসন নিয়ে। অর্থাৎ অনেকটা শক্তিহীন হয়ে। সরে যেতে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট পার্টি ও গ্রেট ব্রিটেনের টোরি পার্টিকে। আর ভারতে শাসক দলের ৪০০ আসন পাওয়ার সদম্ভ ঘোষণাকে ভর্ৎসনা করে আগের চেয়ে অনেক কম আসনে তাঁদের সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে জাগ্রত জনগণ।

বছর যায়, বছর আসে। নিজেকে পাল্টে ফেলার আশায় বুক বাঁধে মানুষ। সে আশা যখন মরীচিকা হয়ে ওঠে, তখন আবার নতুন অঙ্গীকার। যা আগের বছর হয়ে ওঠেনি, হয়তো জীবনের কোনও বছরই হয়ে উঠবে না, তাও একদিন সম্ভব হতে পারে বলে ভরসা নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে পথ চলাটাই দস্তুর হয়ে ওঠে মানবজীবনে।

যা কিছু পুরনো, তাকে বিদায় করে দিয়ে, যা কিছু নতুন—তাকে সাদরে জীবনে নিয়ে আসার মধ্যেই রয়েছে সময়ের অনিবার্য বহমানতা। এইভাবে নতুন আসে, পুরনো বিদায় নেয়। এই ধারাবাহিকতা চিরকালীন। ২০২৪ শেষ হল, ২০২৫ শুরু হল। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার মুহূর্তে আনন্দের সঙ্গে বিষাদ যে মিশে থাকে, হাসির মধ্যে এই বেদনার ব্যঞ্জনা যে স্বাভাবিক, তা অস্বীকার করা যায় না। সময়কে ধরে রাখা যায় না। সময় এক ক্লান্তিহীন এবং অনিবার্য বহমানতা। সুতরাং সময়ের স্রোতে ভাসতে ভূবনের সমস্ত কিছুই প্রতি মুহূর্তে পুরনো হচ্ছে।

সময়ের এই অনিবার্য বহমানতার কারণেই একটি ধারায় নতুনের প্রতি টানই হয়ে উঠেছে উচ্চারিত পরিচয়। যা কিছু নতুন তাকেই গ্রহণ করার মধ্যে নিজের আধুনিকতা এবং ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’। অন্য ধারাটির প্রধান চালিকাশক্তি ‘নস্টালজিয়া’ বা অতীত ও পুরাতনের জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও স্মৃতিমেদুরতা। ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’— এই প্রবাদবাক্য যে ফাঁপা, সারবত্তাহীন বুলি নয়, তা জীবনের অভিজ্ঞতা আমাদের পদে পদে বুঝিয়ে দেয়।
বছরের শেষ সপ্তাহে আমরা হারালাম এক দূরদর্শী, প্রাজ্ঞ, সুবিবেচক প্রধানমন্ত্রীকে। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রয়াত হলেন। তিনি বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু যেটুকু বলতেন তা আদ্যন্ত সুবিবেচনা ও সুচিন্তিত। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদীর দেশ চালনার ধরন দেখে মনমোহন বলেছিলেন, দেশের মানুষকে একটা আস্থা দিতে হয় যে দেশের সরকার তাঁদের কথা ভাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটা মোটেই করছেন না। দেশজোড়া হিন্দুত্বের আস্ফালনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পবাক নেতার এমন ভর্ৎসনা তখন অনেকটাই অসন্তুষ্ট করেছিল। কিন্তু মৃদু হলেও বাক্যবাণটির লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ এখন এদেশে আর নতুন কিছু নয়। যতদিন যাচ্ছে, ততই প্রমাণ হচ্ছে শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরুরও সামাজিক-অর্থনৈতিক ভালমন্দও এখন শাসকের কাছে নন-ইস্যু।

শাসকের কাছে জনগণ বিচার্য ভোটের মাপকাঠিতে। তাই গণতন্ত্র ও সংবিধান এখন বিপন্ন। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাও সংকটের মুখে। হিন্দুত্বের ভয়াল বিষবাষ্পে দমবন্ধকর অবস্থা। পুরাতনের এই জঞ্জাল সরিয়ে গণতন্ত্রের পরিবেশ কলুষমুক্ত করতে হবে। ‘জন্মের প্রথম লগন’-এর মতোই ২০২৫-কে স্বাগত। অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ ঘটুক নতুন ইংরেজি বর্ষে।